শীত এসে গ্যালো। ক্রান্তীয় সমতলভূমির গৃহস্থের কাছে যা মূলত একটি ধারণামাত্র। গনগনে আগুনের আঁচ বাঁচিয়ে আলোটুকু উপভোগ করার আয়েসে যতখানি বিচক্ষণতা ও পিছুটান থাকে।
ভোরের আলো ফুটবার আগেই হাড়কাঁপানো উত্তুরে হাওয়ার শাসন তুচ্ছ করে মাতৃময়ী খেজুরগাছের কোল থেকে ছিনিয়ে আনা হবে অমৃতধারা। সুরাপ্রতিম বনেদি পানীয়। বিশালাকার লোহার কড়াইতে জ্বাল দিয়ে তার লাস্যময় তারল্যে যোগ হবে সান্দ্রতার আভিজাত্য, প্রস্তুত হবে পাটালিগুড়। যা নবান্নের ধান্যজাত চিঁড়ে-মুড়ি-খৈ এর মোয়ার এক ও অদ্বিতীয় সংযোজী উপাদান। এবং দুগ্ধজ মিষ্টান্নের সমাদৃত অলংকার। মুড়কি আর জয়নগরের ধাত্রীমাও বটে। মহানাগরিক এইসব স্বর্গসুখ থেকে অনেকাংশে বঞ্চিত। তারা বালাপোষের আড়মোড়া মেখে কেবল ঋতু উদযাপনের স্বার্থে চিনিদুধে সম্পৃক্ত বাজারচলতি কফির আস্বাদ নিয়ে 'শীতের সকাল' রচনা লিখতে শিখেছে।
ঝকঝকে রোদ উঠলে অবশ্য সবেতেই নিশ্চিন্তির মফস্বলী ছায়া নেমে আসে। দুপুরের আলসে রোদ্দুরে দার্জিলিং ও নাগপুরী কমলালেবুর স্বাদ এবং রূপটানে খোসার উপযোগিতা নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা হয়। আর দুধেল সাদা কাপড়ের চৌকো টুকরোয় অনন্য কুটিরশৈল্পিক দক্ষতায় বিউলি ও মুসুর ডালের বড়ি দেবার ধুম। নাকউঁচু বড়ি, নানারকম গয়না বড়ি। মাছের ঝোল, শুক্তো বা অন্যান্য পদ অনুযায়ী বিবিধ উপাদান ও আয়তনের বড়ি। বিবস্বানীয় তেজ ম্লান হয়ে এলে কাঁচা নরম বড়ির শরীরে অভঙ্গুর কাঠিন্য জমে। গৃহকর্মে নিতান্ত অনুৎসাহী লক্ষ্মীছাড়া ষষ্ঠবর্ষীয়া বিকেল হতেই অসম্পূর্ণ ভাতঘুম ফেলে নধর কড়াইশুঁটির দানা ছাড়াতে বসে। কচুরীর মখমলি পুর তয়ের হবে তাতে। কিংবা ছড়ার বইয়ের খোকাদের মত ছোটোছোটো গোলগাল নতুন আলুর দম। উষ্ণ জলে ডোবানো সুসিদ্ধ আলুর খোসা আলতো হাতে ছাড়িয়ে নেবার বেশী রন্ধনপটুতা যখন গড়ে ওঠবার বয়স হয়নি।। বৈকালিক ঘরোয়া আসর জমিয়ে রাখবে ফুলকপির সিঙ্গাড়া। আলু-পেঁয়াজকলি ভাজার মধ্যবিত্ত ঘ্রাণের সুবাদে তড়িৎগতিতে শেষ হবে পাটিগণিতের কঠিনতম অনুশীলনী। মাঝেমধ্যে পোড়ানো হবে হৃষ্টপুষ্ট বেগুন, আর কুচনো পেঁয়াজ-লঙ্কা-ধনেপাতার সঙ্গতে বন্ধ জানলার বাইরের নিরুপায় হিম সেই আদিম আনন্দের আঁচটুকু পেয়েই ধন্য হয়ে যাবে।
আচারের জন্য লাল টোপাকুল জমানো হয় বাজারদর পড়লেই। যার ঝালনুনে জারিত নরম শাঁসের লোভ সংযম আর সন্ন্যাসগ্রহণ সমার্থক। অবশ্য নারকেলী কুলের ওপর বসন্তপঞ্চমীর নিষেধ। সেসব এক অন্য রমজানের কাহন। যার শেষে অপেক্ষা করে থাকে ভেজানো চাল-ডাল-কলার মহাপ্রসাদ আর ঢালাও খিচুড়ি-বাঁধাকপি-বেগুনীর প্রতিশ্রুতি। তার অনেক আগেই সেরে ফেলা হয়েছে বড়দিন, ইংরেজি নববর্ষ ও মকরসংক্রান্তির যাবতীয় উদযাপন। মাখন আর ডিমের আদুরে প্রশ্রয়ে হাতেগড়া কেক, শুধু ভ্যানিলা বা কোকোর মিশ্রণে, কাজুবাদাম ও চেরীর মোরব্বার রাজমুকুটে যে তামাম খৃষ্টীয় ধর্মবিশ্বাসকে অগ্রাহ্য করতে পারে। হেলেদুলে হাজির হয় রসবড়া, পায়েস ও পিঠেপুলির বিপুল সম্ভার। মোহময় নলেনগুড়ের নকশী চাঁদোয়ার নীচে নানাবিধ আকৃতির ভাপা-সেদ্ধ-ভাজা এবং ঘন এলাইচি দুগ্ধস্নাত ঊর্বশীর সমাবেশ যত।
আরো একটু সাশ্রয় করে উঠতে পারলে কোনো পুকুর ঘেরা বাগানবাড়ীর আশেপাশে চড়ুইভাতি। যেখানে পাখীদের ঠোঁটের ডগা থেকে খসে পড়বে কাঠবাদাম। হুড়োহুড়ি করে কুড়িয়ে নিয়েই রসুইঘরে ছুট্টে গিয়ে নোড়া দিয়ে পাথুরে খোলস ফাটিয়ে নিতে হবে। সেখানে থরেথরে মন ভালো করে দেওয়া রঙচঙে সব্জীর সমাহার, আর মশলাপাতির সুবাস। কাশ্মীরী লঙ্কার ঝালহীন রক্তবর্ণ সুষমায় বালখিল্য বিস্ময় জাগবে। সর্ষেক্ষেতের তুমুল তরঙ্গে অনেক অনেক দূরে একলা পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করবে। কাশ্মীরের চেয়েও দূরে। যেখানে আরো শীত আছে, শৈত্য নেই।
রান্না শেষ হতে এখনো ঢের দেরী। তারপরে শতরঞ্চিতে সারিসারি পাত পড়বে। শালপাতার থালায় পিন দিয়ে আটকানো গোল করে কাটা কলাপাতা যত্ন করে ধুয়ে রাখা হবে। হাঁক দিয়ে জড়ো করা হবে ব্যাডমিন্টন বা অন্তাক্ষরী খেলতে থাকা - আসন্ন শিশুর জন্য কদমফুলের ঘন্টিবাঁধা মোজা বুনতে বুনতে ভিনদেশী সুখাদ্যের রন্ধনপ্রণালী আদানপ্রদান করতে থাকা - শহরতলিতে কাঠাপ্রতি জমির দাম নিয়ে তর্কে মত্ত অবসরবিলাসীদের। এইসবের ভীড় থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া শখের চিত্রকর, কলমচি বা সুরসাধকদের খুঁজতে যাওয়া হবে। দেরী হয়ে যাবে কত। তাই শেষবেলার গুনতিতে বেখেয়ালী ভুল হয়ে যাবে। সবাই কি ফিরতি ম্যাটাডোরে উঠেছে?
অন্যমনস্ক হাত ফসকে উলের গোলা গড়িয়ে গ্যাছে অনেক অনেক দূর। যেইসব উপকথায় দুঃখিনী বালিকাদের গল্প ছিল, তাদের দেশে। পরনে তার লালনীল সোয়েটার, হনুমান টুপি আর ধূসর হাতমোজা। পিঠে তার শালগমের বোঝা। ...
নিখুঁত নীল রাতে ভীষণ তুষারঝড় উঠুক। পর্ণমোচীর শাখায় শাখায় বিঁধে যাক গড্ডলিকা। পরিযায়ীর বিস্তৃত ডানায় শিশিরভেজা আকাশপ্রদীপ তখন নিভু নিভু।
Comments
Post a Comment