Skip to main content

শেষবারের মতো

-নে-ক দিন পরে। 
 
হাওড়া স্টেশনে ট্রেন ঢুকবে কিছুক্ষণের মধ্যে। সাঁতরাগাছি পেরোনোর পরেই সকলের একটু একটু করে মালপত্র নামাবার ব্যস্ততা। আমার দুটো মাত্র ছোটো ছোটো ব্যাগ, তাই মটকা মেরে পড়ে থাকব। নীচের বার্থ হলে পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাব, অন্ধকারের ঘনত্ব থেকে বুঝে নেব ট্রেন কত লেট (ঠিকঠাক সময়ে চললে সে ট্রেন অন্তত ভারতীয় নয়)। লোকজন সারি বেঁধে দরজার কাছে জড়ো হতে থাকবে। যাদের সঙ্গে জিনিস বেশী তাদের উৎকণ্ঠাও বেশী। দূরপাল্লার ট্রেন সাধারণত নির্দিষ্ট কিছু প্ল্যাটফর্মেই আসে, তাই প্ল্যাটফর্মের নম্বর আন্দাজ করতে পারার বাহাদুরি এখানে খাটবে না। ট্রেনের এক একটা কামরা প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে থাকবে, আর দক্ষ অভিজ্ঞ মালবাহীরা লাফ দিয়ে উঠেই দরদাম করতে শুরু করে দেবে। দু-পাঁচ টাকা নিয়েও দর হবে বোধহয়। শিল্প যত সূক্ষ্ম হয় ততই তার কদর বেশী আমিও এর মধ্যে চোখটোখ কচলে উঠে বসব। অত রাতে "মন্দ্রিত করিয়া তোলে জীবনের মহামন্ত্রধ্বনি" এইসব ভেবেটেবে মন ভালো হয়ে যাবে। 
 
সকলে যখন সমস্ত মালপত্রের সঙ্গে দলের বাদবাকিদের গুনে নিতে ব্যস্ত, ট্রেন থেকে নেমে আমি চলমান ভিড়ের মাঝের ফাঁকফোকর দিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করব। শীতাতপ কামরা থেকে ইঞ্জিন অনেকখানি দূরে, পেরিয়ে আসতে হবে স্লীপার আর বাকি সব অসংরক্ষিত কামরা। ভিড়ের চরিত্র বদলাবে। একেবারে সামনের দিকে মাছের পেটি আর কার্ডবোর্ডের বাক্সের স্তূপ। সব শব্দ ঘ্রাণ পেরিয়ে আমি সম্মোহিতের মত হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যাব (মহিলাদের) ওয়েটিংরুমের দিকে। তিনতলায়। চেনাপথ, তাই ঘুমচোখেও ভুল হবে না। ফার্স্ট বাস আসতে ঢের দেরী।

ওয়েটিংরুমের মেঝে-চৌকি-বেঞ্চিতে রাতজাগা মানুষের অপেক্ষা আর ক্লান্তি। আমি কোনো একটা বেঞ্চের এককোণে ব্যাগট্যাগ রেখে বসব। ঘরের দায়িত্বে থাকা মাসি জিজ্ঞেস করে যাবে স্নান বা প্রাতঃকৃত্যাদি সারবার সম্ভাবনা আছে কিনা, কেউ কাজকর্ম সেরে টাকা না দিয়ে পালাবার চেষ্টা করলে তাকে উদোম খিস্তি করবে, ওইটুকু থেকেই ওর অনেকটা রোজগার। লাউডস্পীকারে অনবরত মালগাড়ী, লোকাল আর এক্সপ্রেসের ঘোষণা, কিশোরী আর মাঝবয়সী মেয়েদের স্নানান্তে সস্তার লিপস্টিক-নেলপালিশ-পাউডারের সাজগোজ সম্পর্কিত কলকাকলি - ঘুম আসা মুশকিল। এর মধ্যে মা-বাবার ফোন মার মধ্যরাতে ট্রেন থাকলে বাবা-মা ঘুমোয় না, আর এদিকে আমি ঘুমোতে চেয়েও পারি না আমি সশরীরে অক্ষত অবস্থায় ফিরেছি, আর আমাকে আনতে না আসলেও চলবে - এইসব জানিয়ে ফোন রেখে দিই। 
 
এই করে রাত পার হয়ে যায়। ওয়েটিংরুমের লাগোয়া ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াই। অন্ধকার পাতলা হয়ে আসে অনেকটা, নীচে ট্যাক্সি,ঠেলাওলা ও নিত্যযাত্রীদের সংখ্যা আর আওয়াজ বাড়ে। সামনে আবছা কুয়াশায় গঙ্গার অবয়ব আস্তে আস্তে স্পষ্ট হতে থাকে। ওদিকে হাওড়া ব্রীজের সব আলোও নিভে গেছে ততক্ষণে। ফার্স্ট বাস ছাড়বে কিছুক্ষণ পরেই।
 
নীচে নেমে আসি। বাংলা-ইংরাজী-হিন্দী খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিনের স্টল, গরম চা-ডিমসেদ্ধ-পাঁউরুটি ঘুগনির দোকান ছাড়িয়ে সাবওয়ে। ওতে রাস্তা কম পড়ে কিনা জানি না, আমি প্রতিবারই মাটির ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে বাস অবধি পৌঁছই। ডানলপ বা নাগেরবাজার যেকোনোদিকের বাস হলেই হল, দমদম রেলস্টেশন আর সিঁথির মোড়ের মাঝামাঝি থাকার এইটুকুই সুবিধে। 
 
ভোরের বাস। ভরতে সময় নেয়। তারপর ড্রাইভার কন্ডাক্টরকে হাঁক দিয়ে বাসে তোলে। মাঝেমাঝে উল্টোটা‍ও হয়। আমি জানলার ধারে বসি, আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টিকিট কেটে ফেলি, যাতে বাকি রাস্তা কেউ বিরক্ত না করে। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের হাঁটার গতিতে চলতে চলতে বাস হাওড়া ব্রীজ পার হয়। এইসময়টুকু অধৈর্য যাত্রীদের বাস চাপড়ানিতেও কাজ হয় না। লেডীজ সীট থেকে দ্বিতীয় হুগলি সেতু তেমন ভালো করে দেখা যায় না, কিন্তু ছোট্ট ছোট্ট স্নানের ঘাট, সংলগ্ন মন্দির আর দাঁড়টানা নৌকো দেখা যায়, গঙ্গা দেখা যায়।

বড়বাজার। ফুটপাথ বলে এখানে কিছু ছিল না কোনোদিন। রাস্তা জুড়ে দুধারে ফুলের পসরা, ভাঁড়ের চা থেকে মোমো-চাউমিন হরেকরকম খাবারের সম্ভার, জামাকাপড় আর বাসনকোশনের দোকান। পুরসভার 'বিপজ্জনক বাড়ী' নোটিশ টাঙানো শতাব্দীপ্রাচীন স্থাপত্য, বন্ধ রেশনের দোকানের বেঁকে যাওয়া সাইনবোর্ড - এইসবের মধ্যে দিয়ে গজেন্দ্রগতিতে চলে বাস। কন্ডাক্টর এসময় লোক ডাকে না, যার যেমন দরকার হাত দেখিয়ে চলন্ত বাসে উঠে পড়ে। কেবল বড় বড় বাক্সপেঁটরা নিয়ে এক একটা দল আসে, তখন বাস থামে। এই করেই বাসের অনেকটা ভর্তি হয়ে যায়। 
 
গন্তব্য আর চরিত্র অনুযায়ী বাসের যাত্রাপথ বদলায়। নাগেরবাজার মিনিবাস হলে অলিগলি দিয়ে, যা প্রস্থে মিনিবাসের সমান, মিনার্ভা থিয়েটার পেরিয়ে এসে সেন্ট্রাল এভিনিউতে পড়ে। সেক্ষেত্রে স্বভাবতই সময় যায় অনেকটা। ডানলপ/দক্ষিণেশ্বরগামী বাসগুলো মহাত্মা গান্ধী রোড ধরে সেন্ট্রাল এভিনিউ-এর ক্রসিংয়ে আসে। সেই ক্রসিং, যেখানে সম্ভবত আমাদের কথা ভেবেই মেট্রো আর লাল সিগনালের মধ্যে কিছু বোঝাপড়া ছিল, যা গত তিন বছর ধরে সপ্তাহে পাঁচদিন পার হয়ে এসেছি। বাগুইহাটি/এয়ারপোর্টের বাসও একই রাস্তা ধরে আসে, ক্রসিং পেরিয়ে সোজা চলে যায় আরও দুটো বাসস্টপ। কলেজ স্ট্রীট। আমার হুড়মুড়িয়ে নেমে যেতে ইচ্ছে করে। 
 
তারপর আর কী, বিধান সরণি তো হাতের তালুর চেয়েও বেশী চেনা (হাতের তালুতে এমনিতে দেখার কী আছে জানি না যদিও)। সেই সপ্তাহে পাঁচদিনের ব্যাপার। ঠনঠনিয়া কালীবাড়ী পেরোলেই বাস প্রায় ভর্তি, বাকী রাস্তা অতিসম্পৃক্তিকরণ। বিবেকানন্দ রোডের ক্রসিংয়ে ইচ্ছে করে দাঁড়াবে অনেকক্ষণ, যেমন দাঁড়াবে হাতিবাগান ক্রসিংয়েও। বৈকুণ্ঠ হাউস, বেথুন স্কুল, হেদুয়ার সুইমিং পুলের শান্ত পরিবেশ পেরিয়ে এসে পড়বে হাতিবাগান-ফড়িয়াপুকুর-শ্যামবাজারের মহাহাট। পলিথিনের চাঁদোয়ার নীচে চল্লিশ টাকার টেবিল ক্লথ থেকে শুরু করে কাঁচের শোরুমে বহুমূল্য সোনার গয়না স-ব সওদা হয়। অত সকালেও অনেক দোকানই খুলে যায়। পাঁচ মাথার মোড় আসার আগে থেকেই বাসের গতি কমে, ট্রামগুলো পর্যন্ত ঢিকঢিক করতে করতে এগিয়ে যায়। 
 
ওদিকে সেন্ট্রাল এভিনিউ অনেকটা ফাঁকা ফাঁকা। তখনও দু-একটা জায়গায় সোডিয়ামের আলো নেভেনি। ফুটপাথে, পুরনো বড় বাড়ীর রোয়াকে-চাতালে মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে লোকজন। দু-একটা ছোটোখাটো দোকান খোলে। রাস্তার কলে সরাসরি গঙ্গার ঘোলা জল আসে, ওতেই অনেকে চোখমুখ ধুয়ে নেয়। বেশ জোরেই ছোটে বাস; একের পর এক মেট্রো স্টেশন, নবীন দাশের রসগোল্লার দোকান আর বলরাম মন্দির পার করে যায়, চিত্তরঞ্জন এভিনিউ হয়ে ভূপেন বোস এভিনিউতে এসে পড়ে। বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা ওঠে বাসে। অধিকাংশই হিন্দি মাধ্যমের (স্বাভাবিক, উত্তর কলকাতায় দু-একটা মাত্র ইংরাজী মাধ্যম, তাও তেমন নামী নয়, আর বেশীরভাগই বাংলা মাধ্যম, যেখানে মূলত কাছাকাছি এলাকার ছেলেমেয়েরাই আসে)। আমার পাশে এসে বসলেও নিজের হিন্দির উৎকর্ষের কথা ভেবে আলাপ করার সাহস পাই না, যদিও আমাদের পাড়ার অবাঙালীরা আমাদের মতই সাবলীল বাংলা বলে থাকে। ঘুরেফিরে এ বাসও সেই পাঁচ মাথার মোড়ে আসে। বাদবাকি রাস্তায় সেরকম কিছু হয় না। ভোরের কলকাতার এইখানেই মোটামুটি ইতি। দমদমে নামলে তাও অটোস্ট্যান্ডে পৌঁছনো অবধি টাটকা সবজি আর ফলের খোলা বাজার, যাতে ধুলো উড়ে না আসে তাই রাস্তায় জল ছেটানো দশকর্মা-মিষ্টি-তেলেভাজা-প্যাকেটের দুধ-মাংসের দোকান, বাড়ী বাড়ী যারা কাগজ দেয় তাদের তৎপরতা এইসব চোখে পড়ে; সিঁথিতে নামলে সেটাও হয় না। বাস থেকে নেমেই রাস্তা পার হয়ে অটোর লাইন। খুচরো না থাকলে আবার নেমে যেতে হবে। 
 
অটো যেদিক দিয়েই আসুক না কেন, কোনো অজ্ঞাত কারণে আমাদের বাড়ীর সামনের রাস্তাটুকু পার করতে পারলেই ভাড়া একটাকা বেশী। তাই একটু আগে নামি। বাকীটা হেঁটেই আসি। তেত্রিশ ঘন্টা ট্রেনযাত্রার পর সেটা যে পরম সুখকর তা নয়, তবুও ওই। পুরনো অভ্যাস।

মিষ্টির দোকানে জিলিপির লম্বা লাইন, নতুন ফ্ল্যাটের নীচে গ্যারেজের সামনে বড় আঁশবঁটিতে রুই-কাতলাদের জনস্বার্থে আত্মত্যাগ, মোড়ের কলে রিকশাওয়ালাদের দাঁতন, সদ্য মেরামত করা ক্লাবঘর - এইসব পেরিয়ে আসি। মা প্রতিবার কোন দিক দিয়ে আসছি সেটা ভুল অনুমান করে, তাই রাস্তার দিকের একফালি বারান্দায় বসে থাকলেও আমাকে দেখতে পায় না।
.
.
যেখানে উনিশ বছর থেকেছি, আর শেষ দেড় বছর নিতান্তই গার্হস্থ্য কারণে থাকা হয়ে ওঠেনি; ভাঙা ঘুণ ধরে যাওয়া সদর দরজা, নিয়মিত ঝাঁট না পড়া উঠোন আর ফেটেফুটে নষ্ট হয়ে যাওয়া লাল মেঝের দালান পেরিয়ে, প্লাস্টারবিহীন দেওয়াল ধরে এবড়োখেবড়ো সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসার পর সেখানেই কেমন কেমন লাগে। অচেনা লাগে।
.
এক বছর বাদে ফিরে আসার রোম্যান্টিসিজমের এখানেই ক্ষান্তি।

Comments

Popular posts from this blog

হে সই-সব,

আমিও যে কোনোকালে শিশু ছিলাম, আর প্রতিটি দিন বাঙ্ময় শিশুদিবস ছিল, তার প্রমাণ এই নিম্নোল্লিখিত 'কবিতা'গুচ্ছ।  জীবনবিমার কোম্পানি প্রতি বছর একটা করে ডাইরি দিত, কীজানি কার বারোমাস্যা লিখবার প্রেরণা। তার পাতায় পাতায় রীতিমত তারিখ দিয়ে, চার-পাঁচ লাইন জুড়ে জুড়ে ঈগলের ঠ্যাঙের মত হাতের লেখায় আমি হিজিবিজি জমিয়ে রাখতাম। আবার ভাবতুম পেন্সিলের কোম্পানির নাম কেন বেছে বেছে অপ্সরা বা নটরাজ হয়, আর খাতার কোম্পানি গুডবয়। তখন ধারণা ছিল, পৃথিবীর (একেবারে বিশ্বস্তরে না ভাবলে ঠিক সেই গুরুত্বটা অনুধাবন করা মুশকিল হয়ে যেত) স-ম-স্ত কবিতাই আট পংক্তির। ফলতঃ, সেই সাড়ে চার বছর বয়সে মৌলিক কিছু একটা লেখবার চেষ্টা করে দেখা গেল, "উঠল বাউল সকালেতে একতারাটি নিয়ে, একতারাটি পরের দিনই হায়রে, ভেঙে গিয়ে সে ভাঙা মনে কাঁদতে গেল বনের ধারে গিয়ে- " ছ'লাইনের বেশী এগোল না। এর পরে কী হওয়া উচিৎ কিছুতেই বুঝতে পারলাম না। আমার লেখা প্রথম 'কবিতা' একটি সার্থক ছোটগল্প হতে হতেও হল না।   এর পরেরটা সম্ভবত সদ্য উপেন্দ্রকিশোর পড়বার ফল। প্রথম শ্রেণীতে পড়তে বাংলা আর ইংরেজি ক্ল...

ল্যাদকথন: একটি শনিবাসরীয় চলভাষালাপ

[সময়কাল ও স্থান: অপ্রাসঙ্গিক। ল্যাদ স্থানকালাতীত।]  আমি: হ্যাঁ বলো। মা: কী করছিস? আমি এই একটু দুধচা করলাম, চিনিছাড়া। [স্লা......র্প]  (রোজ এইভাবেই কথোপকথন শুরু হয়)  আমি: এই একটু লেবুচা আর ল্যাদ খাচ্ছি। মা: অ্যাঁ! কী খাচ্ছিস? আমি: ল্যাদ, ল্যাদ।  মা: (কীরকম একটা দ্বিধান্বিত গলায়) বুঝতে পারছিনা। (ঘাড় ঘুরিয়ে বাবাকে) টিভিটা কমাও না! সারাদিন চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খবর দেখেই যাচ্ছে! তুমুন একটা নতুন খাবারের নাম বলল, ঠিক করে শুনতেই পেলাম না।  আমি: !!!!!!! মা: (এবার আমার দিকে ফিরে) হ্যাঁ বল।  আমি:  নতুন খাবার আবার কী? বললাম তো ল্যাদ।  মা: ও! আমেরিকান খাবার?  আমি: উফফ এতে আমেরিকান কোত্থেকে এল? আশ্চর্য্য! ল্যাদ জানো না? মা: (খচে গিয়ে) তোরা আজকাল কী খাস কী বলিস আমি বুঝতে পারি না। বিদেশী খাবারের নাম আমি কীকরে জানব?  আমি: বারবার বলছি এটা খাবার না। ল্যাদ। বুঝেছো? লয়ে যফলা আকার - ল্যাদ।  মা: (ভুরু কুঁচকে) মানে? আমি: ল্যাদ মানে ল্যাদ। এইটা না বোঝার কী আছে?  মা: (ভীষণ কাঁইমাই করে) ধুর আমি বুঝতে পারছি না। আমি কি অ...

খুকির প্রত্যাবর্তন, ও ধন্যবাদগাথা

সেই সময়ের কথা। যখন পাশের পাড়াকে মনে হত পৃথিবীর শেষ প্রান্ত, আর মাসিক পত্রিকার শিশুবিভাগে কাঁচাহাতের গল্প-কবিতা লিখে পাঠাবার সময় বাদামী খামের বাঁদিকে গোটা গোটা অক্ষরে লিখতাম "প্রযত্নে.. বাবার নাম"। যখন যাবতীয় সৃষ্টিশীল শিল্পচর্চার বিপরীতে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানকে মনে হত গম্ভীর প্রাণহীন ব্যাপারস্যাপার; অন্যদিকে কল্পবিজ্ঞান আর খবরের কাগজে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কথা পড়ে রুশদেশী উপকথার অজানি-দেশের-না-জানি-কী এর মত অদ্ভুত ঘোরলাগা রোমাঞ্চ হত। তালগোল পাকিয়ে যেত সব। যখন বিদেশ মানে আমার কাছে বাংলার বাইরের সমগ্র বিশ্ব - কোনোকালেই যার ধারেকাছে পৌঁছানো হবে না আমার। এইসব ছাইপাঁশ ভাবতে ভাবতে যখন শীতের নিস্তব্ধ দুপুর বা গরমের ভ্যাপসা বিকেলে স্কুলের বারান্দায়-পার্কের মাঠে এমনকি জনবহুল বাজারহাটেও কেমন করে যেন নিজের মধ্যে ভীষণভাবে একা হয়ে যেতাম। অন্তরীপের মত।  তারপর, জীবন গিয়েছে চলে একটি দশক পার। যেসব মানুষের সাথে প্রতিদিন কথাবার্তা হয়, যাদের ওপর আমার দৈনন্দিন যাপন অনেকখানি নির্ভর করে থাকে, সেইসব মুখ বদলেছে। নতুন মুখের ভিড়ে ছোট্ট...

আলোকমঞ্জীর

।১। বিনোদিনীর ঘুম ভাঙে ভোরবেলায়। ছোট্টবেলাকার অভ্যেস। গেরামে বেড়ে উঠলে যেমনটি হয়। সেই যে গো, গাঁয়ের নামটি অঞ্জনা আর নদীর নামটি খঞ্জনা। ভাদ্দরমাস পেরোল কি পেরোল না, সেখেনে ভোরের দিকে হিম পড়ে। আর সারারাত ধরে টুপটাপ ঝরে পড়ে শিউলি। তার বুকের কাছটা ভোরের সুয্যির মত টকটকে কমলা। এতো সন কেটে গেল, সেই শিরশিরে হাওয়াটুকু রয়ে গেছে অমলিন। আর আছে বালিকাবেলার কড়ি ও কোমল। বিনোদিনী, আর তার শিউলিফুল পাতানো সই, স্নেহলতা। তাদের কোঁচড় ভর্তি শিশিরভেজা ফুল। ঘাটের কাছে ছলাৎ ছল, গল্প বলে নদীর জল। এমনি সময় নাম না জানা কোনো পাখি ডেকে উঠলেই বিনোদিনীর অবুঝ  মন  উথালপাথাল করে ওঠে...  ।২। নতুন পাড়ায় আসার পর  থেকে ভাবনার একটাও বন্ধু হয়নি। উফ, এরা আবার কীনা পাড়াকে বলে সোসাইটি। ভাবনা ওদের চেয়ে ঢের বেশী ইংলিশ স্টোরিজ পড়ে, তাই বলে কি ওরকম থেমে থেমে বেঙ্গলি বলে? এমা, না না, বেঙ্গলি না, বাংলা। ওদের পাশের ফ্ল্যাটের দিদুন কেমন মিষ্টি মিষ্টি বাংলা বলে, ওর মা তো অমনি বলে না। দিদুন বলে কিনা, মা তোমার ...

আলু-থালু

মেয়েটিকে একলা দেখে প্রৌঢ়া সহযাত্রিণী শুধোলেন, তাঁদের পরিবারের সঙ্গে রাতের খাবার ভাগ করে খেতে তার কোনো আপত্তি আছে কীনা। বাড়ী থেকে বানিয়ে আনা গরম খাবার, একেবারেই সাদামাটা; তবে সঙ্গে বাচ্চা ও বয়স্ক মানুষ আছে- তারা প্যান্ট্রির হাবিজাবি খেতে পারেনা। আর স্টেশনে দাঁড়ালেই খুচরো ভাজাভুজি মুখরোচক যা বিক্রি করতে আসে তার গুণমান তো কহতব্য নয়। একা মানুষের অবশ্য রান্না করে আনা ভারী ঝক্কি।    এর আগে মেয়েটিকে নিয়ে একপ্রস্থ আলোচনা হয়েছে ট্রেনের কুপে। ঢলঢলে টিশার্ট আর অনেকগুলো পকেটওয়ালা প্যান্ট, উবুঝুঁটি, মশমশে কেডস, ঢাউস ব্যাগপত্তর, তার ওপর এই দেড়দিনের দীর্ঘ যাত্রায় সঙ্গীহীন - এমন অসৈরণ ব্যাপার তাঁদের ছেলেবেলায় দেখা যেত না। আধুনিক না ছাই! ভয়ডর নেই মনে - সংস্কারের ঘটশ্রাদ্ধ করে ছেড়েছে। আর খাবারেরও বলিহারি - কীসব বার্গার-চিপ্স-আলুভাজা হ্যানাত্যানা! এইজন্যই অমন ঘাড়েগর্দানে একাকার। মেয়েমানুষ নয় একটু ভারী চেহারা হওয়া ভালো, তা বলে এতটা! মেয়েটি হেডফোনের আড়াল থেকে গুঞ্জনের আভাস পেয়েছে, আর করুণায় হেসেছে। সনাতনী আর সেকেলের মধ্যেকার কয়েক যোজন দূরত্ব যারা দেখতে পায়নি, তাদের অভিধ...

অসংলগ্ন

জ্বরের ঘোরে সবকিছু অন্যরকম লাগে। কপাল জুড়ে কাঠকয়লার উনুন। ওমের বদলে ছ্যাঁকা। মর্গের মতো ভয়াল ঠান্ডা হাতপায়ের তালু। লক্ষণ সুবিধের নয়।  ইন্দ্রিয়ের আশেপাশে শেকল পড়ে গ্যাছে। অবসাদের চেয়েও ভারী। বা শান্তিনিকেতনী শাল। আরো ওজনদার। শাল বলতে আবার বনেদী কাঠের কথা মনে আসে। নিরক্ষীয় বর্ষাপ্রবণ অঞ্চলের আদিম মহারণ্য। ঘন, অন্ধকার। কারাগারের কুঠুরির মতো। চেনা আসবাব, দৈনন্দিন ব্যবহার্য সালভাদর দালির চিত্রকল্পের মতো, ধনুষ্টঙ্কারের যন্ত্রণার মতো গলে পড়তে থাকে এঁকেবেঁকে। সাততলার জানলার জাল দিয়ে রাতের নাগরিক আকাশ বা রাজপথ অলস আলকাতরার মতো কালো মনে হয়। ঘর গরম রাখার যন্ত্রে একঘেয়ে আওয়াজ। শ্রুতিনির্বন্ধ। ঝিঁঝির ডাকের মত আচ্ছন্ন লাগে। ঘর্মক্লান্ত গরমের দিনে পুরোনো পাখার আওয়াজে যেমন ঝিম ধরে আসতো। বেসিনে জল পড়ার শব্দ শুনে নোঙর মাস্তুল ডিঙি নৌকার কথা মনে পড়ে। ইন্দ্রনাথের কথা, হাকলবেরি ফিনের কথা, ফটিকচাঁদের কথা। অপক্ক হাতে দিনান্তের সৈকতে তাজা মাছ কেনাবেচার প্যাস্টেল ছবি আঁকার কথা।  খিদিরপুর  ডকে প্রথমবার বাণিজ্যিক জাহাজ...

বীণা ও বাণী

তথাকথিত আস্তিকতা বলতে যা বোঝায়, কোনোকালেই আমার তা ছিল না। আমাদের ঘরে সন্ধ্যেবেলার শাঁখবাতি নেই, নীলষষ্ঠীর উপোস নেই। ভাস্কর্য আর মৃৎশিল্পের নিদর্শন স্বরূপ বুদ্ধ-খৃষ্ট-নানকের মূর্তি সাজানো আছে। প্রাচীন সাহিত্যের অংশ হিসাবে ধর্মগ্রন্থ আছে। দেশবিদেশের সনাতন লোকাচারের ইতিহাস জানবার, এবং যুক্তিহীন বিশ্বাসজনিত আনুগত্যের অভ্যাসকে অতিক্রম করেও তাকে যথাসম্ভব নিরপেক্ষভাবে সম্মান করার শিক্ষাটুকু আছে। আছে হালখাতায় বাংলা বর্ষপঞ্জী সংগ্রহ। ঈদের বিরিয়ানি আর ফিরনির যুগলবন্দীতে জন্নতলাভ। চৌকাঠে আর ছাদে হেমন্তের শিরশিরে হাওয়া উপেক্ষা করে দীপাবলির মোমবাতি জ্বালানো আছে। আলো ভাগ করে নেবার আকুলতা আছে, আলোয় ফেরবার আর্তি আছে। আর আছে সরস্বতীপুজো, ঘরকুনো মুখচোরা কিশোরীর একমাত্র আপন উৎসব। সহপাঠিনীর ছোট্ট ফোকলা ভাইবোন, চাঁদা চাইতে এসে বানান বলতে গিয়ে ঘাবড়ে যাওয়া পাড়ার সমিতির ছেলেছোকরা, বা নির্বিবাদী গৃহপরিচারিকার অনভ্যস্ত উচ্চারণে শৈশবেই আমার পিতৃমাতৃদত্ত নামের দৈবী উত্তরণ ঘটেছিল। তারপর আর নিজের সারসত্য সন্ধানে বেরিয়ে পড়া ছাড়া উপায় ছিল না। সেই শুরু আজন্মের সারস্বত সাধনার। আমি চিরকাল কমপ্ল্যান আর আধগ্রাস ...

টাঙলা

বাংলা শব্দে গোলগাল একটা ব্যাপার আছে। যেমন অক্ষর, তেমনি ধ্বনি। মাত্রা টেনে বর্ণমালা গাঁথবার রীতি দেবনাগরীতেই ছিল। কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত তীক্ষ্ণতার বদলে বাংলা অক্ষরে যা আছে তা হল কোমলতা, স্নিগ্ধতা, শান্ত নিবিড় একটা ভাব। শাপলার ডাঁটা, ফলসার থোক, শালিধানের চিঁড়ে বা কুবোপাখির ডাক ভাবলে যেমনটা হয়। সংস্কৃত শব্দে যুক্তাক্ষরের ঝঙ্কারে আভিজাত্য আছে, দৃপ্ত গৌরব আছে, প্রচ্ছন্ন অহংও বুঝি আছে। বাংলায় সেই যুক্তবর্ণকে বেণীপুতুলের মত-মেটে কুঁজোর মত-কেঠো ঘোড়ার মত গড়েপিটে-ছেঁচে-ডেবে নেওয়া হয়েছে; যাতে ধার কম, স্বরের আধার বেশী। তাই ব-ম-য-ফলায় (যেমন- নিঃস্ব, পদ্ম, সখ্য ইত্যাদি) স্বতন্ত্র বর্ণের আঘাতের বদলে দ্বিত্বব্যঞ্জনে জিভকে আরাম দেবার একটা আলসে চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। আলসে অবশ্য কোঠাবাড়ির ছাদেরও হয়, যেখানে নুনহলুদ ছোপ ফুলছাপা শাড়ির পাশে আচারের বয়াম ঝিমোয়। যেমন অক্ষর, তেমনি ধ্বনি। এঁটেল মাটির মত ভিজে ভিজে, হেঁটে গেলে যাতে পদচিহ্ন পড়ে। তার ওপর দিয়ে ধুলো উড়িয়ে টগবগিয়ে ঘোড়সওয়ার যায় না, পদাতিক কাহারের কাঁধে পালকি যায় দুলকি চালে। তা বলে কি একেবারেই তেজ ন...

পাড়া

ঘর-বারান্দা, বাড়ী, পাঁচিলের চৌহদ্দি। ছোটোখাটো বস্তি। সারিসারি জবরদখল হয়ে যাওয়া সরকারী খাসজমি। রেশন, তেলেভাজা-বইখাতা-বাসন আর মনিহারির দোকান, মুদিখানা, বস্ত্রালয়, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। দুবেলা সব্জী আর মাছের অস্থায়ী বাজার। খেলার মাঠ, পার্ক, বাঁধানো রক, ক্লাবঘর। পুরসভা বা পঞ্চায়েতের ব্লকের ভেতরে একখন্ড রাজনৈতিক সংজ্ঞাহীন অঞ্চল, স্বতন্ত্র সভ্যতা। তথাকথিত আত্মীয়তার ঊর্ধ্বে, নিছক পরিচয়ের সূত্রে গড়ে ওঠা স্বাজাত্যবোধ। পাড়া। সবাই সবার খোঁজ রাখে। পথেঘাটে দোকানবাজারে নিতান্ত সাধারণ বারোমাস্যার আদানপ্রদান। ডিগ্রী পাশ বা চাকরির খবরে স্বস্তি আসে, বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে রক্ষণশীল গুঞ্জন ওঠে, সুস্থসবল সন্তানের জন্মে খুশীর হাওয়া বয়। রাতবিরেতে শ্মশানবন্ধু জোগাড় করতে কখনো বেগ পেতে হয় না। সন্ততিত্যজ্য অশীতিপর বৃদ্ধা, কিঞ্চিৎ মানসিক ভারসাম্যহীন অবিবাহিতা প্রৌঢ়া বা বহুজনের সংসারে এককোণে খুদকুঁড়োর মত পড়ে থাকা স্নায়ুরোগাক্রান্ত যুবকের পারিবারিক ইতিহাস ছাপোষা জনজীবনে দুশ্চিন্তা, সহানুভূতি আর অনিশ্চয়তাবোধের সঞ্চার করে। কেউ বাড়ী বিক্রি কর...