অ-নে-ক
দিন পরে।
হাওড়া
স্টেশনে ট্রেন ঢুকবে কিছুক্ষণের মধ্যে। সাঁতরাগাছি পেরোনোর
পরেই সকলের একটু একটু করে
মালপত্র নামাবার ব্যস্ততা। আমার দুটো মাত্র ছোটো ছোটো
ব্যাগ,
তাই
মটকা মেরে পড়ে থাকব। নীচের
বার্থ হলে পর্দা সরিয়ে বাইরে
তাকাব,
অন্ধকারের
ঘনত্ব থেকে বুঝে নেব ট্রেন
কত লেট (ঠিকঠাক
সময়ে চললে সে ট্রেন অন্তত
ভারতীয় নয়)।
লোকজন সারি বেঁধে দরজার কাছে
জড়ো হতে থাকবে। যাদের সঙ্গে
জিনিস বেশী তাদের উৎকণ্ঠাও
বেশী। দূরপাল্লার ট্রেন
সাধারণত নির্দিষ্ট কিছু
প্ল্যাটফর্মেই আসে,
তাই
প্ল্যাটফর্মের নম্বর আন্দাজ
করতে পারার বাহাদুরি এখানে
খাটবে না। ট্রেনের এক একটা
কামরা প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে
থাকবে, আর
দক্ষ অভিজ্ঞ মালবাহীরা লাফ
দিয়ে উঠেই দরদাম করতে শুরু
করে দেবে। দু-পাঁচ
টাকা নিয়েও দর হবে বোধহয়। শিল্প যত সূক্ষ্ম হয় ততই তার কদর বেশী। আমিও এর মধ্যে চোখটোখ কচলে
উঠে বসব। অত রাতে "মন্দ্রিত
করিয়া তোলে জীবনের মহামন্ত্রধ্বনি" এইসব
ভেবেটেবে মন ভালো হয়ে যাবে।
সকলে
যখন সমস্ত মালপত্রের সঙ্গে
দলের বাদবাকিদের গুনে নিতে
ব্যস্ত,
ট্রেন
থেকে নেমে আমি চলমান ভিড়ের
মাঝের ফাঁকফোকর দিয়ে সামনে
এগিয়ে যাবার চেষ্টা করব।
শীতাতপ কামরা থেকে ইঞ্জিন
অনেকখানি দূরে,
পেরিয়ে আসতে হবে স্লীপার আর বাকি
সব অসংরক্ষিত কামরা। ভিড়ের
চরিত্র বদলাবে। একেবারে সামনের
দিকে মাছের পেটি আর কার্ডবোর্ডের
বাক্সের স্তূপ। সব শব্দ ঘ্রাণ
পেরিয়ে আমি সম্মোহিতের মত
হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে
যাব (মহিলাদের)
ওয়েটিংরুমের
দিকে। তিনতলায়। চেনাপথ,
তাই
ঘুমচোখেও ভুল হবে না। ফার্স্ট
বাস আসতে ঢের দেরী।
ওয়েটিংরুমের
মেঝে-চৌকি-বেঞ্চিতে
রাতজাগা মানুষের অপেক্ষা আর
ক্লান্তি। আমি কোনো একটা
বেঞ্চের এককোণে ব্যাগট্যাগ
রেখে বসব। ঘরের দায়িত্বে থাকা
মাসি জিজ্ঞেস করে যাবে স্নান
বা প্রাতঃকৃত্যাদি সারবার
সম্ভাবনা আছে কিনা,
কেউ
কাজকর্ম সেরে টাকা না দিয়ে
পালাবার চেষ্টা করলে তাকে
উদোম খিস্তি করবে,
ওইটুকু
থেকেই ওর অনেকটা রোজগার।
লাউডস্পীকারে অনবরত মালগাড়ী,
লোকাল আর এক্সপ্রেসের ঘোষণা,
কিশোরী আর মাঝবয়সী মেয়েদের স্নানান্তে
সস্তার লিপস্টিক-নেলপালিশ-পাউডারের
সাজগোজ সম্পর্কিত কলকাকলি
-
ঘুম আসা মুশকিল। এর মধ্যে মা-বাবার
ফোন। আমার
মধ্যরাতে ট্রেন থাকলে বাবা-মা
ঘুমোয় না, আর
এদিকে আমি ঘুমোতে চেয়েও পারি
না। আমি
সশরীরে অক্ষত অবস্থায় ফিরেছি, আর আমাকে আনতে না আসলেও চলবে
-
এইসব
জানিয়ে ফোন রেখে দিই।
এই
করে রাত পার হয়ে যায়। ওয়েটিংরুমের
লাগোয়া ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াই।
অন্ধকার পাতলা হয়ে আসে অনেকটা,
নীচে
ট্যাক্সি,ঠেলাওলা ও নিত্যযাত্রীদের সংখ্যা আর আওয়াজ বাড়ে। সামনে আবছা
কুয়াশায় গঙ্গার অবয়ব আস্তে আস্তে স্পষ্ট হতে থাকে। ওদিকে
হাওড়া ব্রীজের সব আলোও নিভে
গেছে ততক্ষণে। ফার্স্ট বাস
ছাড়বে কিছুক্ষণ পরেই।
নীচে
নেমে আসি। বাংলা-ইংরাজী-হিন্দী
খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিনের
স্টল,
গরম
চা-ডিমসেদ্ধ-পাঁউরুটি
ঘুগনির দোকান ছাড়িয়ে সাবওয়ে।
ওতে রাস্তা কম পড়ে কিনা জানি
না, আমি
প্রতিবারই মাটির ওপর দিয়ে
হেঁটে হেঁটে বাস অবধি পৌঁছই।
ডানলপ বা নাগেরবাজার যেকোনোদিকের
বাস হলেই হল,
দমদম
রেলস্টেশন আর সিঁথির মোড়ের
মাঝামাঝি থাকার এইটুকুই
সুবিধে।
ভোরের
বাস। ভরতে সময় নেয়। তারপর
ড্রাইভার কন্ডাক্টরকে হাঁক
দিয়ে বাসে তোলে। মাঝেমাঝে
উল্টোটাও হয়। আমি জানলার
ধারে বসি, আর
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টিকিট কেটে
ফেলি,
যাতে
বাকি রাস্তা কেউ বিরক্ত না
করে। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের
হাঁটার গতিতে চলতে চলতে বাস
হাওড়া ব্রীজ পার হয়। এইসময়টুকু
অধৈর্য যাত্রীদের বাস চাপড়ানিতেও
কাজ হয় না। লেডীজ সীট থেকে
দ্বিতীয় হুগলি সেতু তেমন ভালো
করে দেখা যায় না,
কিন্তু
ছোট্ট ছোট্ট স্নানের ঘাট,
সংলগ্ন
মন্দির আর দাঁড়টানা নৌকো
দেখা যায়,
গঙ্গা
দেখা যায়।
বড়বাজার।
ফুটপাথ বলে এখানে কিছু ছিল
না কোনোদিন। রাস্তা জুড়ে
দুধারে ফুলের পসরা,
ভাঁড়ের
চা থেকে মোমো-চাউমিন
হরেকরকম খাবারের সম্ভার,
জামাকাপড় আর বাসনকোশনের দোকান। পুরসভার
'বিপজ্জনক
বাড়ী'
নোটিশ
টাঙানো শতাব্দীপ্রাচীন
স্থাপত্য,
বন্ধ
রেশনের দোকানের বেঁকে যাওয়া
সাইনবোর্ড -
এইসবের
মধ্যে দিয়ে গজেন্দ্রগতিতে
চলে বাস। কন্ডাক্টর
এসময় লোক ডাকে না,
যার
যেমন দরকার হাত দেখিয়ে চলন্ত
বাসে উঠে পড়ে। কেবল বড় বড়
বাক্সপেঁটরা নিয়ে এক একটা দল আসে,
তখন
বাস থামে। এই করেই বাসের অনেকটা
ভর্তি হয়ে যায়।
গন্তব্য আর চরিত্র অনুযায়ী বাসের
যাত্রাপথ বদলায়। নাগেরবাজার
মিনিবাস
হলে অলিগলি দিয়ে, যা
প্রস্থে মিনিবাসের সমান, মিনার্ভা
থিয়েটার পেরিয়ে এসে সেন্ট্রাল
এভিনিউতে পড়ে। সেক্ষেত্রে
স্বভাবতই সময় যায় অনেকটা।
ডানলপ/দক্ষিণেশ্বরগামী
বাসগুলো মহাত্মা গান্ধী রোড
ধরে সেন্ট্রাল এভিনিউ-এর
ক্রসিংয়ে আসে। সেই ক্রসিং,
যেখানে
সম্ভবত আমাদের কথা ভেবেই মেট্রো আর লাল সিগনালের মধ্যে কিছু
বোঝাপড়া ছিল,
যা
গত তিন বছর ধরে সপ্তাহে পাঁচদিন
পার হয়ে এসেছি। বাগুইহাটি/এয়ারপোর্টের
বাসও একই রাস্তা ধরে আসে,
ক্রসিং
পেরিয়ে সোজা চলে যায় আরও দুটো
বাসস্টপ। কলেজ স্ট্রীট। আমার
হুড়মুড়িয়ে নেমে যেতে ইচ্ছে
করে।
তারপর আর কী,
বিধান
সরণি তো হাতের তালুর চেয়েও
বেশী চেনা (হাতের
তালুতে এমনিতে দেখার কী আছে
জানি না যদিও)।
সেই সপ্তাহে পাঁচদিনের ব্যাপার।
ঠনঠনিয়া কালীবাড়ী পেরোলেই
বাস প্রায় ভর্তি,
বাকী
রাস্তা অতিসম্পৃক্তিকরণ।
বিবেকানন্দ রোডের ক্রসিংয়ে
ইচ্ছে করে দাঁড়াবে অনেকক্ষণ,
যেমন
দাঁড়াবে হাতিবাগান ক্রসিংয়েও।
বৈকুণ্ঠ হাউস,
বেথুন
স্কুল,
হেদুয়ার
সুইমিং পুলের শান্ত পরিবেশ
পেরিয়ে এসে পড়বে
হাতিবাগান-ফড়িয়াপুকুর-শ্যামবাজারের
মহাহাট। পলিথিনের চাঁদোয়ার
নীচে চল্লিশ টাকার টেবিল ক্লথ
থেকে শুরু করে কাঁচের শোরুমে
বহুমূল্য সোনার গয়না স-ব
সওদা হয়। অত সকালেও অনেক দোকানই
খুলে যায়। পাঁচ মাথার মোড় আসার আগে থেকেই বাসের গতি
কমে,
ট্রামগুলো
পর্যন্ত ঢিকঢিক করতে করতে
এগিয়ে যায়।
ওদিকে
সেন্ট্রাল এভিনিউ অনেকটা
ফাঁকা ফাঁকা। তখনও দু-একটা
জায়গায় সোডিয়ামের আলো নেভেনি।
ফুটপাথে,
পুরনো
বড় বাড়ীর রোয়াকে-চাতালে
মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে লোকজন।
দু-একটা
ছোটোখাটো দোকান খোলে। রাস্তার
কলে সরাসরি গঙ্গার ঘোলা জল আসে,
ওতেই
অনেকে চোখমুখ ধুয়ে নেয়। বেশ
জোরেই ছোটে বাস;
একের
পর এক মেট্রো স্টেশন,
নবীন
দাশের রসগোল্লার দোকান আর
বলরাম মন্দির পার করে যায়,
চিত্তরঞ্জন
এভিনিউ হয়ে ভূপেন বোস এভিনিউতে
এসে পড়ে। বিভিন্ন স্কুলের
ছাত্রছাত্রীরা ওঠে বাসে।
অধিকাংশই হিন্দি মাধ্যমের
(স্বাভাবিক,
উত্তর
কলকাতায় দু-একটা
মাত্র ইংরাজী মাধ্যম,
তাও
তেমন নামী নয়, আর
বেশীরভাগই বাংলা মাধ্যম,
যেখানে
মূলত কাছাকাছি এলাকার ছেলেমেয়েরাই আসে)। আমার পাশে এসে বসলেও নিজের
হিন্দির উৎকর্ষের কথা ভেবে আলাপ করার সাহস পাই না,
যদিও আমাদের পাড়ার অবাঙালীরা আমাদের মতই সাবলীল বাংলা
বলে থাকে। ঘুরেফিরে এ বাসও
সেই পাঁচ মাথার মোড়ে আসে।
বাদবাকি রাস্তায় সেরকম কিছু
হয় না। ভোরের কলকাতার এইখানেই
মোটামুটি ইতি। দমদমে নামলে
তাও অটোস্ট্যান্ডে পৌঁছনো
অবধি টাটকা সবজি আর ফলের খোলা
বাজার,
যাতে
ধুলো উড়ে না আসে তাই রাস্তায়
জল ছেটানো দশকর্মা-মিষ্টি-তেলেভাজা-প্যাকেটের
দুধ-মাংসের
দোকান,
বাড়ী
বাড়ী যারা কাগজ দেয় তাদের
তৎপরতা এইসব চোখে পড়ে;
সিঁথিতে
নামলে সেটাও হয় না। বাস থেকে
নেমেই রাস্তা পার হয়ে অটোর
লাইন। খুচরো না থাকলে আবার
নেমে যেতে হবে।
অটো
যেদিক দিয়েই আসুক না কেন,
কোনো
অজ্ঞাত কারণে আমাদের বাড়ীর
সামনের রাস্তাটুকু পার করতে
পারলেই ভাড়া একটাকা বেশী।
তাই একটু আগে নামি। বাকীটা
হেঁটেই আসি। তেত্রিশ ঘন্টা
ট্রেনযাত্রার পর সেটা যে পরম
সুখকর তা নয়,
তবুও
ওই। পুরনো অভ্যাস।
মিষ্টির
দোকানে জিলিপির লম্বা লাইন,
নতুন
ফ্ল্যাটের নীচে গ্যারেজের
সামনে বড় আঁশবঁটিতে রুই-কাতলাদের
জনস্বার্থে আত্মত্যাগ,
মোড়ের
কলে রিকশাওয়ালাদের দাঁতন,
সদ্য
মেরামত করা ক্লাবঘর -
এইসব
পেরিয়ে আসি। মা প্রতিবার
কোন দিক দিয়ে আসছি সেটা ভুল
অনুমান করে,
তাই
রাস্তার দিকের একফালি বারান্দায়
বসে থাকলেও আমাকে দেখতে পায়
না।
.
.
.
যেখানে
উনিশ বছর থেকেছি, আর
শেষ দেড় বছর নিতান্তই গার্হস্থ্য
কারণে থাকা হয়ে ওঠেনি;
ভাঙা
ঘুণ ধরে যাওয়া সদর দরজা,
নিয়মিত
ঝাঁট না পড়া উঠোন আর ফেটেফুটে
নষ্ট হয়ে যাওয়া লাল মেঝের
দালান পেরিয়ে,
প্লাস্টারবিহীন
দেওয়াল ধরে এবড়োখেবড়ো সিঁড়ি
বেয়ে উঠে আসার পর সেখানেই
কেমন কেমন লাগে। অচেনা লাগে।
.
এক
বছর বাদে ফিরে আসার রোম্যান্টিসিজমের
এখানেই ক্ষান্তি।
Comments
Post a Comment