তথাকথিত আস্তিকতা বলতে যা বোঝায়, কোনোকালেই আমার তা ছিল না। আমাদের ঘরে সন্ধ্যেবেলার শাঁখবাতি নেই, নীলষষ্ঠীর উপোস নেই। ভাস্কর্য আর মৃৎশিল্পের নিদর্শন স্বরূপ বুদ্ধ-খৃষ্ট-নানকের মূর্তি সাজানো আছে। প্রাচীন সাহিত্যের অংশ হিসাবে ধর্মগ্রন্থ আছে। দেশবিদেশের সনাতন লোকাচারের ইতিহাস জানবার, এবং যুক্তিহীন বিশ্বাসজনিত আনুগত্যের অভ্যাসকে অতিক্রম করেও তাকে যথাসম্ভব নিরপেক্ষভাবে সম্মান করার শিক্ষাটুকু আছে। আছে হালখাতায় বাংলা বর্ষপঞ্জী সংগ্রহ। ঈদের বিরিয়ানি আর ফিরনির যুগলবন্দীতে জন্নতলাভ। চৌকাঠে আর ছাদে হেমন্তের শিরশিরে হাওয়া উপেক্ষা করে দীপাবলির মোমবাতি জ্বালানো আছে। আলো ভাগ করে নেবার আকুলতা আছে, আলোয় ফেরবার আর্তি আছে।
আর আছে সরস্বতীপুজো, ঘরকুনো মুখচোরা কিশোরীর একমাত্র আপন উৎসব। সহপাঠিনীর ছোট্ট ফোকলা ভাইবোন, চাঁদা চাইতে এসে বানান বলতে গিয়ে ঘাবড়ে যাওয়া পাড়ার সমিতির ছেলেছোকরা, বা নির্বিবাদী গৃহপরিচারিকার অনভ্যস্ত উচ্চারণে শৈশবেই আমার পিতৃমাতৃদত্ত নামের দৈবী উত্তরণ ঘটেছিল। তারপর আর নিজের সারসত্য সন্ধানে বেরিয়ে পড়া ছাড়া উপায় ছিল না। সেই শুরু আজন্মের সারস্বত সাধনার। আমি চিরকাল কমপ্ল্যান আর আধগ্রাস খিচুড়ি-লাবড়া খেয়ে শূন্যহাতে অঞ্জলি দিয়েছি। সংস্কৃত শেখবার আগে মন্ত্রোচ্চারণ করবার ইচ্ছে হয়নি, কারণ ব্যাকরণের বিশুদ্ধতা রক্ষায় আমার ধনুকভাঙা পণ। গৃহকর্মে অনিচ্ছুক ডানপিটে গ্রন্থকীটকে ভোরবেলা ঘুম থেকে তুলে ইস্কুলের পুজোয় ফলমূল কাটতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর তারপর তীব্র বাসন্তী রঙের খসখসে শাড়ী পরে কাছেপিঠের সব ইস্কুলে চরে বেড়ানো। আঁকা-নাচ-গানবাজনা-আবৃত্তি আর ক্যারাটে-জিমন্যাস্টিকের ইস্কুল। বারোয়ারী ক্লাব ও কিছু অবস্থাপন্ন পরিবার, যাঁরা পুজো করতেন খোলা চাতালে, আর সামনের রাস্তা দিয়ে যাওয়া অচেনা মানুষজনকে ডেকে সাদরে প্রসাদ বিতরণ করতে যাঁদের ভাঁড়ারে কখনো টান পড়েনি। এইসবই তো হাতেকলমে পাঠশালা। ব্যায়তো বৃদ্ধিমায়াতি ক্ষয়মায়াতি সঞ্চয়াৎ।। আর থাকত দুয়েকটি শ্রেণীকক্ষ জুড়ে হস্তশিল্পের প্রদর্শনী: রুমালে হরেকরকম সেলাই, কৃত্রিম-মাটির পুতুল, টেবিলের ঢাকনায় ফেব্রিক, তুলোর ভল্লুক, কাগজের পাখী ও শৌখিন ব্যাগ, আসন ও হাতপাখা, উলের মোজা-টুপি-সোয়েটার, শোলার পুষ্পরাজি, কাঁচ ও চুমকিতে ঝকমকিয়ে ওঠা বটুয়া, আনকোরা কোলাজ এবং আইসক্রিমের কাঠি দিয়ে বানানো কলমদানি, ট্রে আর চাঁদমালা। নিরাসক্ত ভান করে কেবল নিজের জিনিসটির কাছেই ফিরে ফিরে আসা, যাতে সকলের দৃষ্টি (ও প্রশংসা) আকর্ষণ করা যায়। এরপরেও, কেবল স্বতন্ত্র প্রতিনিধিত্বের বালখিল্য নেশায় নিজেদের ঘর সাজানোর হিড়িক। মার্বেল, ভেলভেট আর ক্রেপ কাগজের কোনটায় শিকল আর কোনটায় দেওয়ালে সাঁটা নকশা মানানসই, তা নিয়ে মননশীল আলোচনা। বেঞ্চটেঞ্চ সাজিয়েগুছিয়ে রাখা, যাতে সারা ঘরে ঘুরে ঘুরে দশবছুরে আমাদের শিল্পকীর্তি দেখতে লোকজনের সুবিধা হয়। আমি সেই হুড়োহুড়ির ফাঁকে ডায়াসে উঠে গহন কালো বোর্ডের বুকে রঙবেরঙের চক দিয়ে আল্পনা আঁকি, কপালে তার দৃঢ় হরফে 'আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে'-র জয়তিলক।। আরেকটু বড় হতে হতে এসে পড়ল পার্লে-জি আয়োজিত প্রতিযোগিতা। সেসময় আমি সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার হওয়ার এঁড়ে স্বপ্ন দেখি। তাই বিষয়বস্তুর অভাব হয়নি। বাড়ন্ত ছিল উপকরণ। রাজ্য সরকারী অনুদানপ্রাপ্ত মধ্যবিত্ত ইস্কুলে যা স্বাভাবিক। তবু উৎসাহে ভাঁটা পড়েনি ছাত্রশিক্ষক কারো। মায়েদের নুনহলুদের গন্ধ মাখা ছাপার শাড়ীতে খালি পায়ে এঘর-সেঘর কী ছুটোছুটি! বনেদী বাড়ীর মহল না বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ তা বোঝা ভার। টিফিনের সময় খেলাধুলো বিসর্জন দিয়ে তিলতিল করে গড়ে তোলা সাধের 'থিম': সাঁওতাল পরগণা, আঙ্কোর ভাট, 'নারীর মূল্য' অথবা শিশুশ্রমের বিরোধিতা। পাশাপাশি সামঞ্জস্য রেখে ইতিহাস, ভূগোল বা বিজ্ঞানভিত্তিক মেলা। পুজোর দিন কোম্পানীর কর্তাব্যক্তিদের গদগদ আপ্যায়ন। লোকালয়ের আর কোনো ইস্কুল (লক্ষণীয়, তার প্রায় সবই ছেলেদের ইস্কুল) যে আমাদের টেক্কা দিতে পারেনি তা নিয়ে মুহূর্তের আত্মসন্তুষ্টি। একজন্ম পেরিয়ে দধিকর্মা আর গোটাসেদ্ধয় সেঁচে নেওয়া ভাণ্ডারের বাদবাকি উচ্ছিষ্টের অধিকার। সামান্যের সমন্বয়। হোমের ধোঁয়াকুন্ডলী সামলে আমাদের কুটিরশিল্পে অর্জিত জ্ঞান সেই থার্মোকলের টুকরো, পেন্সিলের ছিলকে, অভ্রর চেকনাই আর রঙচঙে আর্ট-সেলোফেন-কার্ট্রিজ কাগজের ভাঁজপড়া মোড়কেই থমকে গিয়েছে।
এরপরের সাতবছরের বিবরণ নিতান্ত কষ্টকল্পনা। নতুন ইস্কুলে সম্পূর্ণ পৃথক পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা মেয়েদের ভিড়ে বেমানান একলা হয়ে যাবার শুরু। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানকে ভালোবাসতে শিখে একটু একটু করে বাকহীন জগতের নিভৃত শরিক হয়ে পড়া। যার রেশ কিছুটা হলেও থেকে যাবে পরবর্তী পাঁচ বছরে। সরস্বতীপুজো বলতে তখন সৌজন্যের খাতিরে দুপুরবেলায় ইস্কুলের নিয়মমাফিক পংক্তিভোজন। নেহাতই অতিথির মত, কারণ সে ইস্কুলের স্বেচ্ছাসেবী ছাত্রীকুলের গণ্ডি আমি পেরোতে পারিনি। এককালের নকশালী আঁতুড়ঘর মহাবিদ্যালয় সঙ্গত কারণেই ধর্মীয় আচরণের সংকীর্ণ সীমানা পেরিয়ে গিয়েছিল। ছিল কেবল অশিক্ষক কর্মচারীদের নিজস্ব একটি ছোটোখাটো পুজো, আর নামমাত্র চাঁদার বিনিময়ে দিনকয়েক পর ম্রিয়মান লুচি-বোঁদের ঠোঙা। কলকাতার শেষ দু'বছরের বাণীবন্দনার বিন্দুমাত্র স্মৃতি নেই আমার। সে এক তুমুল অস্থির সময়। গভীর ক্ষত আড়াল করে নির্লিপ্তির মুখোশ পরে থাকবার আপ্রাণ চেষ্টা। সেই অভ্যাস জারি ছিল আরো দুই বছর - যখন দেশের পশ্চিম প্রান্তে আরো একবার ভিন্ন (এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিরুদ্ধ অসহিষ্ণু) মানসিকতার মানুষজনের আসরে সহাবস্থানের পাঠ নিতে একরকম বাধ্য হতে হয়েছিল। একের পর এক পাকদণ্ডী পেরিয়ে আসা, ছিঁড়ে যাওয়া পুরনো শৃঙ্খল। তবু পথ ফুরোয় না, ধুলোকাদা-আগাছায় জড়িয়ে যায় অনাবৃত পা, দমবন্ধ খুপরিতে মন বসে না। কোথায় ঝড়ের শেষ, কোথায় মোহরকুঞ্জ? 'হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে।'
তারপর, কালাপানি পার করে আরো পশ্চিমে সরে আসা। পৃথিবীর ঘূর্ণনের প্রতিবাদে পিছিয়ে যাওয়া কয়েক পল। এদেশে আসবার সময় সম্ভবত খানিক অভিমানেই Buckeye বাঙালীর সঙ্গে যোগাযোগ করবার ইচ্ছে হয়নি। এতকিছু ছেড়েই যখন আসা, আর কী লাভ শিকড়ের ফাঁদে পড়ে? মায়া বড় বিষ- একবার ছুঁলেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ে কোণায় কোণায়। তাই অবসরসঙ্গী বাংলা বই, অনুষ্ঠানাদিতে পরবার শাড়ী-জুতো আর আনুষঙ্গিক অলঙ্কার- কিছুই আনা হয়নি। নিজেকে আনন্দযজ্ঞ থেকে একেবারেই সরিয়ে নেবার জন্য ঘেরাটোপের বুনোটখানি সবে পোক্ত হতে চলেছে তখন। তবু, শেষরক্ষা হল না। এখানকার বঙ্গভাষীদের মধ্যে যে অনন্যসাধারণ আত্মীয়তা, তা এড়িয়ে যাওয়া কেবল অসাধ্য নয়, নিটোল মূর্খামি। তাই মৌসুমী বর্ষায় পুষ্ট আকর্ষের ভরসায় নতুন করে লতিয়ে উঠল পিছুটান। প্রাক হেমন্তের সম্মিলনীতে বিজয়যাত্রার শুভারম্ভ। কাঁটাতারের অন্যপারে পড়শিদের জয়ডঙ্কায় সামিল হবার অবকাশ। এমনি করেই চলছিল। তারপর, তুষারপাতের রেশ ফুরোতে না ফুরোতেই বসন্তের আগুনে ঝরে পড়ল বিদ্যারত্নের তূণ। কালান্তক শীতঘুম ছেড়ে, নির্বাসনের খোলস ফেলে রেখে ঘিরে ধরতে লাগল সুখস্মৃতির জলতরঙ্গ। এক এক ঝটকায় সরে যাচ্ছিল আবছায়ার পরত। ঘরোয়া এক হাতেগড়া পত্রিকা, তা নিয়েও ক্ষমতাজনিত মনান্তর আর বোঝাপড়া - যা হয়তো অবধারিত ছিল। আর ছিল প্রথম বিশ্বের অতিব্যস্ত যাপনের ফাঁকফোকরেও সাপ্তাহিক মহড়ার সুযোগ খুঁজে নেওয়ার তাগিদ। নাটকের মধ্যেকার পর্দানশীন রঙ্গরসের বহুস্তরীয় অধ্যবসায়। অনাদরে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা দুয়োরানীর সম্পদ বারোভূতে লুটেপুটে খায়। সেই আপাততুচ্ছ কড়ি আর ঝিনুক জড়ো করে মঞ্চস্থ করবার প্রয়াস। আদিকালের যাত্রা-থিয়েটার, কালজয়ী অপেরা, সংগ্রামী গণনাট্য আর টুকরো নৃত্যগীতিকাব্যের রূপকে বঙ্গসন্তানের সহজাত সংস্কৃতিচর্চার ঐতিহ্য আর মফস্বলী সারল্য ফিরিয়ে আনবার ঐক্যবদ্ধ দুঃসাহস। যা কিছু প্রাচীন ও অতীত, তাই যে আদপে ভূত - তার শৈল্পিক স্মারক হয়ে থাকবার বিনম্র চেষ্টা.. [https://www.youtube.com/watch?v=4cLGq8pxnzo]
যা যাবার, তা তো গেছেই। অবশেষটুকু আগলে রাখা হোক। বেঁচে থাক প্রবাদপ্রতিম বাগধারা। ধ্বসে যাওয়া পাঁচিলের মেরামতি হোক। হড়কা বানের মুখে ভেসে যাবার আগে মজবুত সাঁকোয় পারাপার অব্যাহত থাক। হাতে হাত রেখে বেঁধে বেঁধে বাঁচবার, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঐশ্বর্য রক্ষার শপথ থাকুক। এর বেশী সভ্যতার দাবি কবেই বা ছিল!
এই তো অকালবোধন। বোধিলাভের কোনো কাল নেই।
এই তো অকালবোধন। বোধিলাভের কোনো কাল নেই।
Comments
Post a Comment