Skip to main content

বীণা ও বাণী

তথাকথিত আস্তিকতা বলতে যা বোঝায়, কোনোকালেই আমার তা ছিল না। আমাদের ঘরে সন্ধ্যেবেলার শাঁখবাতি নেই, নীলষষ্ঠীর উপোস নেই। ভাস্কর্য আর মৃৎশিল্পের নিদর্শন স্বরূপ বুদ্ধ-খৃষ্ট-নানকের মূর্তি সাজানো আছে। প্রাচীন সাহিত্যের অংশ হিসাবে ধর্মগ্রন্থ আছে। দেশবিদেশের সনাতন লোকাচারের ইতিহাস জানবার, এবং যুক্তিহীন বিশ্বাসজনিত আনুগত্যের অভ্যাসকে অতিক্রম করেও তাকে যথাসম্ভব নিরপেক্ষভাবে সম্মান করার শিক্ষাটুকু আছে। আছে হালখাতায় বাংলা বর্ষপঞ্জী সংগ্রহ। ঈদের বিরিয়ানি আর ফিরনির যুগলবন্দীতে জন্নতলাভ। চৌকাঠে আর ছাদে হেমন্তের শিরশিরে হাওয়া উপেক্ষা করে দীপাবলির মোমবাতি জ্বালানো আছে। আলো ভাগ করে নেবার আকুলতা আছে, আলোয় ফেরবার আর্তি আছে।

আর আছে সরস্বতীপুজো, ঘরকুনো মুখচোরা কিশোরীর একমাত্র আপন উৎসব। সহপাঠিনীর ছোট্ট ফোকলা ভাইবোন, চাঁদা চাইতে এসে বানান বলতে গিয়ে ঘাবড়ে যাওয়া পাড়ার সমিতির ছেলেছোকরা, বা নির্বিবাদী গৃহপরিচারিকার অনভ্যস্ত উচ্চারণে শৈশবেই আমার পিতৃমাতৃদত্ত নামের দৈবী উত্তরণ ঘটেছিল। তারপর আর নিজের সারসত্য সন্ধানে বেরিয়ে পড়া ছাড়া উপায় ছিল না। সেই শুরু আজন্মের সারস্বত সাধনার। আমি চিরকাল কমপ্ল্যান আর আধগ্রাস খিচুড়ি-লাবড়া খেয়ে শূন্যহাতে অঞ্জলি দিয়েছি। সংস্কৃত শেখবার আগে মন্ত্রোচ্চারণ করবার ইচ্ছে হয়নি, কারণ ব্যাকরণের বিশুদ্ধতা রক্ষায় আমার ধনুকভাঙা পণ। গৃহকর্মে অনিচ্ছুক ডানপিটে গ্রন্থকীটকে ভোরবেলা ঘুম থেকে তুলে ইস্কুলের পুজোয় ফলমূল কাটতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর তারপর তীব্র বাসন্তী রঙের খসখসে শাড়ী পরে কাছেপিঠের সব ইস্কুলে চরে বেড়ানো। আঁকা-নাচ-গানবাজনা-আবৃত্তি আর ক্যারাটে-জিমন্যাস্টিকের ইস্কুল। বারোয়ারী ক্লাব ও কিছু অবস্থাপন্ন পরিবার, যাঁরা পুজো করতেন খোলা চাতালে, আর সামনের রাস্তা দিয়ে যাওয়া অচেনা মানুষজনকে ডেকে সাদরে প্রসাদ বিতরণ করতে যাঁদের ভাঁড়ারে কখনো টান পড়েনি। এইসবই তো হাতেকলমে পাঠশালা। ব্যায়তো বৃদ্ধিমায়াতি ক্ষয়মায়াতি সঞ্চয়াৎ।। আর থাকত দুয়েকটি শ্রেণীকক্ষ জুড়ে হস্তশিল্পের প্রদর্শনী: রুমালে হরেকরকম সেলাই, কৃত্রিম-মাটির পুতুল, টেবিলের ঢাকনায় ফেব্রিক, তুলোর ভল্লুক, কাগজের পাখী ও শৌখিন ব্যাগ, আসন ও হাতপাখা, উলের মোজা-টুপি-সোয়েটার, শোলার পুষ্পরাজি, কাঁচ ও চুমকিতে ঝকমকিয়ে ওঠা বটুয়া, আনকোরা কোলাজ এবং আইসক্রিমের কাঠি দিয়ে বানানো কলমদানি, ট্রে আর চাঁদমালা। নিরাসক্ত ভান করে কেবল নিজের জিনিসটির কাছেই ফিরে ফিরে আসা, যাতে সকলের দৃষ্টি (ও প্রশংসা) আকর্ষণ করা যায়। এরপরেও, কেবল স্বতন্ত্র প্রতিনিধিত্বের বালখিল্য নেশায় নিজেদের ঘর সাজানোর হিড়িক। মার্বেল, ভেলভেট আর ক্রেপ কাগজের কোনটায় শিকল আর কোনটায় দেওয়ালে সাঁটা নকশা মানানসই, তা নিয়ে মননশীল আলোচনা। বেঞ্চটেঞ্চ সাজিয়েগুছিয়ে রাখা, যাতে সারা ঘরে ঘুরে ঘুরে দশবছুরে আমাদের শিল্পকীর্তি দেখতে লোকজনের সুবিধা হয়। আমি সেই হুড়োহুড়ির ফাঁকে ডায়াসে উঠে গহন কালো বোর্ডের বুকে রঙবেরঙের চক দিয়ে আল্পনা আঁকি, কপালে তার দৃঢ় হরফে 'আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে'-র জয়তিলক।। আরেকটু বড় হতে হতে এসে পড়ল পার্লে-জি আয়োজিত প্রতিযোগিতা। সেসময় আমি সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার হওয়ার এঁড়ে স্বপ্ন দেখি। তাই বিষয়বস্তুর অভাব হয়নি। বাড়ন্ত ছিল উপকরণ। রাজ্য সরকারী অনুদানপ্রাপ্ত মধ্যবিত্ত ইস্কুলে যা স্বাভাবিক। তবু উৎসাহে ভাঁটা পড়েনি ছাত্রশিক্ষক কারো। মায়েদের নুনহলুদের গন্ধ মাখা ছাপার শাড়ীতে খালি পায়ে এঘর-সেঘর কী ছুটোছুটি! বনেদী বাড়ীর মহল না বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ তা বোঝা ভার। টিফিনের সময় খেলাধুলো বিসর্জন দিয়ে তিলতিল করে গড়ে তোলা সাধের 'থিম': সাঁওতাল পরগণা, আঙ্কোর ভাট, 'নারীর মূল্য' অথবা শিশুশ্রমের বিরোধিতা। পাশাপাশি সামঞ্জস্য রেখে ইতিহাস, ভূগোল বা বিজ্ঞানভিত্তিক মেলা। পুজোর দিন কোম্পানীর কর্তাব্যক্তিদের গদগদ আপ্যায়ন। লোকালয়ের আর কোনো ইস্কুল (লক্ষণীয়, তার প্রায় সবই ছেলেদের ইস্কুল) যে আমাদের টেক্কা দিতে পারেনি তা নিয়ে মুহূর্তের আত্মসন্তুষ্টি। একজন্ম পেরিয়ে দধিকর্মা আর গোটাসেদ্ধয় সেঁচে নেওয়া ভাণ্ডারের বাদবাকি উচ্ছিষ্টের অধিকার। সামান্যের সমন্বয়। হোমের ধোঁয়াকুন্ডলী সামলে আমাদের কুটিরশিল্পে অর্জিত জ্ঞান সেই থার্মোকলের টুকরো, পেন্সিলের ছিলকে, অভ্রর চেকনাই আর রঙচঙে আর্ট-সেলোফেন-কার্ট্রিজ কাগজের ভাঁজপড়া মোড়কেই থমকে গিয়েছে।          
    
এরপরের সাতবছরের বিবরণ নিতান্ত কষ্টকল্পনা। নতুন ইস্কুলে সম্পূর্ণ পৃথক পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা মেয়েদের ভিড়ে বেমানান একলা হয়ে যাবার শুরু। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানকে ভালোবাসতে শিখে একটু একটু করে বাকহীন জগতের নিভৃত শরিক হয়ে পড়া। যার রেশ কিছুটা হলেও থেকে যাবে পরবর্তী পাঁচ বছরে। সরস্বতীপুজো বলতে তখন সৌজন্যের খাতিরে দুপুরবেলায় ইস্কুলের নিয়মমাফিক পংক্তিভোজন। নেহাতই অতিথির মত, কারণ সে ইস্কুলের স্বেচ্ছাসেবী ছাত্রীকুলের গণ্ডি আমি পেরোতে পারিনি। এককালের নকশালী আঁতুড়ঘর মহাবিদ্যালয় সঙ্গত কারণেই ধর্মীয় আচরণের সংকীর্ণ সীমানা পেরিয়ে গিয়েছিল। ছিল কেবল অশিক্ষক কর্মচারীদের নিজস্ব একটি ছোটোখাটো পুজো, আর নামমাত্র চাঁদার বিনিময়ে দিনকয়েক পর ম্রিয়মান লুচি-বোঁদের ঠোঙা। কলকাতার শেষ দু'বছরের বাণীবন্দনার বিন্দুমাত্র স্মৃতি নেই আমার। সে এক তুমুল অস্থির সময়। গভীর ক্ষত আড়াল করে নির্লিপ্তির মুখোশ পরে থাকবার আপ্রাণ চেষ্টা। সেই অভ্যাস জারি ছিল আরো দুই বছর - যখন দেশের পশ্চিম প্রান্তে আরো একবার ভিন্ন (এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিরুদ্ধ অসহিষ্ণু) মানসিকতার মানুষজনের আসরে সহাবস্থানের পাঠ নিতে একরকম বাধ্য হতে হয়েছিল। একের পর এক পাকদণ্ডী পেরিয়ে আসা, ছিঁড়ে যাওয়া পুরনো শৃঙ্খল। তবু পথ ফুরোয় না, ধুলোকাদা-আগাছায় জড়িয়ে যায় অনাবৃত পা, দমবন্ধ খুপরিতে মন বসে না। কোথায় ঝড়ের শেষ, কোথায় মোহরকুঞ্জ? 'হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে।'
                               
তারপর, কালাপানি পার করে আরো পশ্চিমে সরে আসা। পৃথিবীর ঘূর্ণনের প্রতিবাদে পিছিয়ে যাওয়া কয়েক পল। এদেশে আসবার সময় সম্ভবত খানিক অভিমানেই Buckeye বাঙালীর সঙ্গে যোগাযোগ করবার ইচ্ছে হয়নি। এতকিছু ছেড়েই যখন আসা, আর কী লাভ শিকড়ের ফাঁদে পড়ে? মায়া বড় বিষ- একবার ছুঁলেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ে কোণায় কোণায়। তাই অবসরসঙ্গী বাংলা বই, অনুষ্ঠানাদিতে পরবার শাড়ী-জুতো আর আনুষঙ্গিক অলঙ্কার- কিছুই আনা হয়নি। নিজেকে আনন্দযজ্ঞ থেকে একেবারেই সরিয়ে নেবার জন্য ঘেরাটোপের বুনোটখানি সবে পোক্ত হতে চলেছে তখন। তবু, শেষরক্ষা হল না। এখানকার বঙ্গভাষীদের মধ্যে যে অনন্যসাধারণ আত্মীয়তা, তা এড়িয়ে যাওয়া কেবল অসাধ্য নয়, নিটোল মূর্খামি। তাই মৌসুমী বর্ষায় পুষ্ট আকর্ষের ভরসায় নতুন করে লতিয়ে উঠল পিছুটান। প্রাক হেমন্তের সম্মিলনীতে বিজয়যাত্রার শুভারম্ভ। কাঁটাতারের অন্যপারে পড়শিদের জয়ডঙ্কায় সামিল হবার অবকাশ। এমনি করেই চলছিল। তারপর, তুষারপাতের রেশ ফুরোতে না ফুরোতেই বসন্তের আগুনে ঝরে পড়ল বিদ্যারত্নের তূণ। কালান্তক শীতঘুম ছেড়ে, নির্বাসনের খোলস ফেলে রেখে ঘিরে ধরতে লাগল সুখস্মৃতির জলতরঙ্গ। এক এক ঝটকায় সরে যাচ্ছিল আবছায়ার পরত। ঘরোয়া এক হাতেগড়া পত্রিকা, তা নিয়েও ক্ষমতাজনিত মনান্তর আর বোঝাপড়া - যা হয়তো অবধারিত ছিল। আর ছিল প্রথম বিশ্বের অতিব্যস্ত যাপনের ফাঁকফোকরেও সাপ্তাহিক মহড়ার সুযোগ খুঁজে নেওয়ার তাগিদ। নাটকের মধ্যেকার পর্দানশীন রঙ্গরসের বহুস্তরীয় অধ্যবসায়। অনাদরে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা দুয়োরানীর সম্পদ বারোভূতে লুটেপুটে খায়। সেই আপাততুচ্ছ কড়ি আর ঝিনুক জড়ো করে মঞ্চস্থ করবার প্রয়াস। আদিকালের যাত্রা-থিয়েটার, কালজয়ী অপেরা, সংগ্রামী গণনাট্য আর টুকরো নৃত্যগীতিকাব্যের রূপকে বঙ্গসন্তানের সহজাত সংস্কৃতিচর্চার ঐতিহ্য আর মফস্বলী সারল্য ফিরিয়ে আনবার ঐক্যবদ্ধ দুঃসাহস। যা কিছু প্রাচীন ও অতীত, তাই যে আদপে ভূত - তার শৈল্পিক স্মারক হয়ে থাকবার বিনম্র চেষ্টা..  [https://www.youtube.com/watch?v=4cLGq8pxnzo]

যা যাবার, তা তো গেছেই। অবশেষটুকু আগলে রাখা হোক। বেঁচে থাক প্রবাদপ্রতিম বাগধারা। ধ্বসে যাওয়া পাঁচিলের মেরামতি হোক। হড়কা বানের মুখে ভেসে যাবার আগে মজবুত সাঁকোয় পারাপার অব্যাহত থাক। হাতে হাত রেখে বেঁধে বেঁধে বাঁচবার, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঐশ্বর্য রক্ষার শপথ থাকুক। এর বেশী সভ্যতার দাবি কবেই বা ছিল! 

এই তো অকালবোধন। বোধিলাভের কোনো কাল নেই।  

Comments

Popular posts from this blog

হে সই-সব,

আমিও যে কোনোকালে শিশু ছিলাম, আর প্রতিটি দিন বাঙ্ময় শিশুদিবস ছিল, তার প্রমাণ এই নিম্নোল্লিখিত 'কবিতা'গুচ্ছ।  জীবনবিমার কোম্পানি প্রতি বছর একটা করে ডাইরি দিত, কীজানি কার বারোমাস্যা লিখবার প্রেরণা। তার পাতায় পাতায় রীতিমত তারিখ দিয়ে, চার-পাঁচ লাইন জুড়ে জুড়ে ঈগলের ঠ্যাঙের মত হাতের লেখায় আমি হিজিবিজি জমিয়ে রাখতাম। আবার ভাবতুম পেন্সিলের কোম্পানির নাম কেন বেছে বেছে অপ্সরা বা নটরাজ হয়, আর খাতার কোম্পানি গুডবয়। তখন ধারণা ছিল, পৃথিবীর (একেবারে বিশ্বস্তরে না ভাবলে ঠিক সেই গুরুত্বটা অনুধাবন করা মুশকিল হয়ে যেত) স-ম-স্ত কবিতাই আট পংক্তির। ফলতঃ, সেই সাড়ে চার বছর বয়সে মৌলিক কিছু একটা লেখবার চেষ্টা করে দেখা গেল, "উঠল বাউল সকালেতে একতারাটি নিয়ে, একতারাটি পরের দিনই হায়রে, ভেঙে গিয়ে সে ভাঙা মনে কাঁদতে গেল বনের ধারে গিয়ে- " ছ'লাইনের বেশী এগোল না। এর পরে কী হওয়া উচিৎ কিছুতেই বুঝতে পারলাম না। আমার লেখা প্রথম 'কবিতা' একটি সার্থক ছোটগল্প হতে হতেও হল না।   এর পরেরটা সম্ভবত সদ্য উপেন্দ্রকিশোর পড়বার ফল। প্রথম শ্রেণীতে পড়তে বাংলা আর ইংরেজি ক্ল...

খুকির প্রত্যাবর্তন, ও ধন্যবাদগাথা

সেই সময়ের কথা। যখন পাশের পাড়াকে মনে হত পৃথিবীর শেষ প্রান্ত, আর মাসিক পত্রিকার শিশুবিভাগে কাঁচাহাতের গল্প-কবিতা লিখে পাঠাবার সময় বাদামী খামের বাঁদিকে গোটা গোটা অক্ষরে লিখতাম "প্রযত্নে.. বাবার নাম"। যখন যাবতীয় সৃষ্টিশীল শিল্পচর্চার বিপরীতে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানকে মনে হত গম্ভীর প্রাণহীন ব্যাপারস্যাপার; অন্যদিকে কল্পবিজ্ঞান আর খবরের কাগজে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কথা পড়ে রুশদেশী উপকথার অজানি-দেশের-না-জানি-কী এর মত অদ্ভুত ঘোরলাগা রোমাঞ্চ হত। তালগোল পাকিয়ে যেত সব। যখন বিদেশ মানে আমার কাছে বাংলার বাইরের সমগ্র বিশ্ব - কোনোকালেই যার ধারেকাছে পৌঁছানো হবে না আমার। এইসব ছাইপাঁশ ভাবতে ভাবতে যখন শীতের নিস্তব্ধ দুপুর বা গরমের ভ্যাপসা বিকেলে স্কুলের বারান্দায়-পার্কের মাঠে এমনকি জনবহুল বাজারহাটেও কেমন করে যেন নিজের মধ্যে ভীষণভাবে একা হয়ে যেতাম। অন্তরীপের মত।  তারপর, জীবন গিয়েছে চলে একটি দশক পার। যেসব মানুষের সাথে প্রতিদিন কথাবার্তা হয়, যাদের ওপর আমার দৈনন্দিন যাপন অনেকখানি নির্ভর করে থাকে, সেইসব মুখ বদলেছে। নতুন মুখের ভিড়ে ছোট্ট...

ল্যাদকথন: একটি শনিবাসরীয় চলভাষালাপ

[সময়কাল ও স্থান: অপ্রাসঙ্গিক। ল্যাদ স্থানকালাতীত।]  আমি: হ্যাঁ বলো। মা: কী করছিস? আমি এই একটু দুধচা করলাম, চিনিছাড়া। [স্লা......র্প]  (রোজ এইভাবেই কথোপকথন শুরু হয়)  আমি: এই একটু লেবুচা আর ল্যাদ খাচ্ছি। মা: অ্যাঁ! কী খাচ্ছিস? আমি: ল্যাদ, ল্যাদ।  মা: (কীরকম একটা দ্বিধান্বিত গলায়) বুঝতে পারছিনা। (ঘাড় ঘুরিয়ে বাবাকে) টিভিটা কমাও না! সারাদিন চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খবর দেখেই যাচ্ছে! তুমুন একটা নতুন খাবারের নাম বলল, ঠিক করে শুনতেই পেলাম না।  আমি: !!!!!!! মা: (এবার আমার দিকে ফিরে) হ্যাঁ বল।  আমি:  নতুন খাবার আবার কী? বললাম তো ল্যাদ।  মা: ও! আমেরিকান খাবার?  আমি: উফফ এতে আমেরিকান কোত্থেকে এল? আশ্চর্য্য! ল্যাদ জানো না? মা: (খচে গিয়ে) তোরা আজকাল কী খাস কী বলিস আমি বুঝতে পারি না। বিদেশী খাবারের নাম আমি কীকরে জানব?  আমি: বারবার বলছি এটা খাবার না। ল্যাদ। বুঝেছো? লয়ে যফলা আকার - ল্যাদ।  মা: (ভুরু কুঁচকে) মানে? আমি: ল্যাদ মানে ল্যাদ। এইটা না বোঝার কী আছে?  মা: (ভীষণ কাঁইমাই করে) ধুর আমি বুঝতে পারছি না। আমি কি অ...

আলোকমঞ্জীর

।১। বিনোদিনীর ঘুম ভাঙে ভোরবেলায়। ছোট্টবেলাকার অভ্যেস। গেরামে বেড়ে উঠলে যেমনটি হয়। সেই যে গো, গাঁয়ের নামটি অঞ্জনা আর নদীর নামটি খঞ্জনা। ভাদ্দরমাস পেরোল কি পেরোল না, সেখেনে ভোরের দিকে হিম পড়ে। আর সারারাত ধরে টুপটাপ ঝরে পড়ে শিউলি। তার বুকের কাছটা ভোরের সুয্যির মত টকটকে কমলা। এতো সন কেটে গেল, সেই শিরশিরে হাওয়াটুকু রয়ে গেছে অমলিন। আর আছে বালিকাবেলার কড়ি ও কোমল। বিনোদিনী, আর তার শিউলিফুল পাতানো সই, স্নেহলতা। তাদের কোঁচড় ভর্তি শিশিরভেজা ফুল। ঘাটের কাছে ছলাৎ ছল, গল্প বলে নদীর জল। এমনি সময় নাম না জানা কোনো পাখি ডেকে উঠলেই বিনোদিনীর অবুঝ  মন  উথালপাথাল করে ওঠে...  ।২। নতুন পাড়ায় আসার পর  থেকে ভাবনার একটাও বন্ধু হয়নি। উফ, এরা আবার কীনা পাড়াকে বলে সোসাইটি। ভাবনা ওদের চেয়ে ঢের বেশী ইংলিশ স্টোরিজ পড়ে, তাই বলে কি ওরকম থেমে থেমে বেঙ্গলি বলে? এমা, না না, বেঙ্গলি না, বাংলা। ওদের পাশের ফ্ল্যাটের দিদুন কেমন মিষ্টি মিষ্টি বাংলা বলে, ওর মা তো অমনি বলে না। দিদুন বলে কিনা, মা তোমার ...

আলু-থালু

মেয়েটিকে একলা দেখে প্রৌঢ়া সহযাত্রিণী শুধোলেন, তাঁদের পরিবারের সঙ্গে রাতের খাবার ভাগ করে খেতে তার কোনো আপত্তি আছে কীনা। বাড়ী থেকে বানিয়ে আনা গরম খাবার, একেবারেই সাদামাটা; তবে সঙ্গে বাচ্চা ও বয়স্ক মানুষ আছে- তারা প্যান্ট্রির হাবিজাবি খেতে পারেনা। আর স্টেশনে দাঁড়ালেই খুচরো ভাজাভুজি মুখরোচক যা বিক্রি করতে আসে তার গুণমান তো কহতব্য নয়। একা মানুষের অবশ্য রান্না করে আনা ভারী ঝক্কি।    এর আগে মেয়েটিকে নিয়ে একপ্রস্থ আলোচনা হয়েছে ট্রেনের কুপে। ঢলঢলে টিশার্ট আর অনেকগুলো পকেটওয়ালা প্যান্ট, উবুঝুঁটি, মশমশে কেডস, ঢাউস ব্যাগপত্তর, তার ওপর এই দেড়দিনের দীর্ঘ যাত্রায় সঙ্গীহীন - এমন অসৈরণ ব্যাপার তাঁদের ছেলেবেলায় দেখা যেত না। আধুনিক না ছাই! ভয়ডর নেই মনে - সংস্কারের ঘটশ্রাদ্ধ করে ছেড়েছে। আর খাবারেরও বলিহারি - কীসব বার্গার-চিপ্স-আলুভাজা হ্যানাত্যানা! এইজন্যই অমন ঘাড়েগর্দানে একাকার। মেয়েমানুষ নয় একটু ভারী চেহারা হওয়া ভালো, তা বলে এতটা! মেয়েটি হেডফোনের আড়াল থেকে গুঞ্জনের আভাস পেয়েছে, আর করুণায় হেসেছে। সনাতনী আর সেকেলের মধ্যেকার কয়েক যোজন দূরত্ব যারা দেখতে পায়নি, তাদের অভিধ...

অসংলগ্ন

জ্বরের ঘোরে সবকিছু অন্যরকম লাগে। কপাল জুড়ে কাঠকয়লার উনুন। ওমের বদলে ছ্যাঁকা। মর্গের মতো ভয়াল ঠান্ডা হাতপায়ের তালু। লক্ষণ সুবিধের নয়।  ইন্দ্রিয়ের আশেপাশে শেকল পড়ে গ্যাছে। অবসাদের চেয়েও ভারী। বা শান্তিনিকেতনী শাল। আরো ওজনদার। শাল বলতে আবার বনেদী কাঠের কথা মনে আসে। নিরক্ষীয় বর্ষাপ্রবণ অঞ্চলের আদিম মহারণ্য। ঘন, অন্ধকার। কারাগারের কুঠুরির মতো। চেনা আসবাব, দৈনন্দিন ব্যবহার্য সালভাদর দালির চিত্রকল্পের মতো, ধনুষ্টঙ্কারের যন্ত্রণার মতো গলে পড়তে থাকে এঁকেবেঁকে। সাততলার জানলার জাল দিয়ে রাতের নাগরিক আকাশ বা রাজপথ অলস আলকাতরার মতো কালো মনে হয়। ঘর গরম রাখার যন্ত্রে একঘেয়ে আওয়াজ। শ্রুতিনির্বন্ধ। ঝিঁঝির ডাকের মত আচ্ছন্ন লাগে। ঘর্মক্লান্ত গরমের দিনে পুরোনো পাখার আওয়াজে যেমন ঝিম ধরে আসতো। বেসিনে জল পড়ার শব্দ শুনে নোঙর মাস্তুল ডিঙি নৌকার কথা মনে পড়ে। ইন্দ্রনাথের কথা, হাকলবেরি ফিনের কথা, ফটিকচাঁদের কথা। অপক্ক হাতে দিনান্তের সৈকতে তাজা মাছ কেনাবেচার প্যাস্টেল ছবি আঁকার কথা।  খিদিরপুর  ডকে প্রথমবার বাণিজ্যিক জাহাজ...

টাঙলা

বাংলা শব্দে গোলগাল একটা ব্যাপার আছে। যেমন অক্ষর, তেমনি ধ্বনি। মাত্রা টেনে বর্ণমালা গাঁথবার রীতি দেবনাগরীতেই ছিল। কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত তীক্ষ্ণতার বদলে বাংলা অক্ষরে যা আছে তা হল কোমলতা, স্নিগ্ধতা, শান্ত নিবিড় একটা ভাব। শাপলার ডাঁটা, ফলসার থোক, শালিধানের চিঁড়ে বা কুবোপাখির ডাক ভাবলে যেমনটা হয়। সংস্কৃত শব্দে যুক্তাক্ষরের ঝঙ্কারে আভিজাত্য আছে, দৃপ্ত গৌরব আছে, প্রচ্ছন্ন অহংও বুঝি আছে। বাংলায় সেই যুক্তবর্ণকে বেণীপুতুলের মত-মেটে কুঁজোর মত-কেঠো ঘোড়ার মত গড়েপিটে-ছেঁচে-ডেবে নেওয়া হয়েছে; যাতে ধার কম, স্বরের আধার বেশী। তাই ব-ম-য-ফলায় (যেমন- নিঃস্ব, পদ্ম, সখ্য ইত্যাদি) স্বতন্ত্র বর্ণের আঘাতের বদলে দ্বিত্বব্যঞ্জনে জিভকে আরাম দেবার একটা আলসে চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। আলসে অবশ্য কোঠাবাড়ির ছাদেরও হয়, যেখানে নুনহলুদ ছোপ ফুলছাপা শাড়ির পাশে আচারের বয়াম ঝিমোয়। যেমন অক্ষর, তেমনি ধ্বনি। এঁটেল মাটির মত ভিজে ভিজে, হেঁটে গেলে যাতে পদচিহ্ন পড়ে। তার ওপর দিয়ে ধুলো উড়িয়ে টগবগিয়ে ঘোড়সওয়ার যায় না, পদাতিক কাহারের কাঁধে পালকি যায় দুলকি চালে। তা বলে কি একেবারেই তেজ ন...

পাড়া

ঘর-বারান্দা, বাড়ী, পাঁচিলের চৌহদ্দি। ছোটোখাটো বস্তি। সারিসারি জবরদখল হয়ে যাওয়া সরকারী খাসজমি। রেশন, তেলেভাজা-বইখাতা-বাসন আর মনিহারির দোকান, মুদিখানা, বস্ত্রালয়, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। দুবেলা সব্জী আর মাছের অস্থায়ী বাজার। খেলার মাঠ, পার্ক, বাঁধানো রক, ক্লাবঘর। পুরসভা বা পঞ্চায়েতের ব্লকের ভেতরে একখন্ড রাজনৈতিক সংজ্ঞাহীন অঞ্চল, স্বতন্ত্র সভ্যতা। তথাকথিত আত্মীয়তার ঊর্ধ্বে, নিছক পরিচয়ের সূত্রে গড়ে ওঠা স্বাজাত্যবোধ। পাড়া। সবাই সবার খোঁজ রাখে। পথেঘাটে দোকানবাজারে নিতান্ত সাধারণ বারোমাস্যার আদানপ্রদান। ডিগ্রী পাশ বা চাকরির খবরে স্বস্তি আসে, বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে রক্ষণশীল গুঞ্জন ওঠে, সুস্থসবল সন্তানের জন্মে খুশীর হাওয়া বয়। রাতবিরেতে শ্মশানবন্ধু জোগাড় করতে কখনো বেগ পেতে হয় না। সন্ততিত্যজ্য অশীতিপর বৃদ্ধা, কিঞ্চিৎ মানসিক ভারসাম্যহীন অবিবাহিতা প্রৌঢ়া বা বহুজনের সংসারে এককোণে খুদকুঁড়োর মত পড়ে থাকা স্নায়ুরোগাক্রান্ত যুবকের পারিবারিক ইতিহাস ছাপোষা জনজীবনে দুশ্চিন্তা, সহানুভূতি আর অনিশ্চয়তাবোধের সঞ্চার করে। কেউ বাড়ী বিক্রি কর...

শেষবারের মতো

অ - নে - ক দিন পরে।    হাওড়া স্টেশনে ট্রেন ঢুকবে কিছুক্ষণের মধ্যে। সাঁতরাগাছি পেরোনোর পরেই সকলের একটু একটু করে মালপত্র নামাবার ব্যস্ততা। আমার দুটো মাত্র ছোটো ছোটো ব্যাগ , তাই মটকা মেরে পড়ে থাকব। নীচের বার্থ হলে পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাব , অন্ধকারের ঘনত্ব থেকে বুঝে নেব ট্রেন কত লেট ( ঠিকঠাক সময়ে চললে সে ট্রেন অন্তত ভারতীয় নয় ) । লোকজন সারি বেঁধে দরজার কাছে জড়ো হতে থাকবে। যাদের সঙ্গে জিনিস বেশী তাদের উৎকণ্ঠাও বেশী। দূরপাল্লার ট্রেন সাধারণত নির্দিষ্ট কিছু প্ল্যাটফর্মেই আসে , তাই প্ল্যাটফর্মের নম্বর আন্দাজ করতে পারার বাহাদুরি এখানে খাটবে না। ট্রেনের এক একটা কামরা প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে থাকবে , আ র দক্ষ অভিজ্ঞ মালবাহীরা লাফ দিয়ে উঠেই দরদাম করতে শুরু করে দেবে। দু - পাঁচ টাকা নিয়েও দর হবে   বোধহয়।  শিল্প যত সূক্ষ্ম হয় ততই তার কদর বেশী ।   আমিও এর মধ্যে চোখটোখ কচলে উঠে বসব। অত রাতে " মন্দ্রিত করিয়া তোলে জীবনের মহামন্ত্রধ্বনি"   এইসব ভেবেটেবে মন ভালো হয়ে যাবে।    সকলে যখন সমস্ত মালপত্রের সঙ্গে দলের বাদবাকিদের গুনে নিতে ব্যস্ত , ট্রেন থেকে নেমে আমি চলমা...