তারপর, জীবন গিয়েছে চলে একটি দশক পার। যেসব মানুষের সাথে প্রতিদিন কথাবার্তা হয়, যাদের ওপর আমার দৈনন্দিন যাপন অনেকখানি নির্ভর করে থাকে, সেইসব মুখ বদলেছে। নতুন মুখের ভিড়ে ছোট্টবেলার কাল্পনিক অপ্রাপ্তির ঝুলি অনাদরে সরিয়ে রেখেছি। আমার চারপাশ যতখানি বদলেছে, আমি তার চেয়ে নিজেকে পাল্টেছি ঢের বেশী। এতোখানিই- যে আমারই ঠাহর করতে গিয়ে নির্বাসিত লাগে।
এখন আমার নিজের নামেই চিঠি আসে। কিন্তু, এই এত স্বাধীনতা আর স্বাচ্ছন্দ্যের মেকি ঔজ্জ্বল্যে খুঁটি ছিঁড়ে হাত ফস্কে পালিয়ে গেছে কত কিছু। যা কিছু সরল নিরাভরণ অনাড়ম্বর...
তারপর, এই দেশে এসে, নতুন করে অনেক কিছুর শুরু। তিনমাস আগেও যা কল্পনাতীত ছিল। এ শহরের বঙ্গভাষী বাসিন্দাদের সাথে পরিচয়। ঘরোয়া বৈঠক, আর পুজোর মণ্ডপে খোশগল্পের আসর। দুই বাংলার প্রবাসী মানুষকে একত্র করে এই প্রথমবার বিজয়া সম্মিলনী। পাঁচ ঘন্টাব্যাপী বিচিত্রানুষ্ঠান। এক মাস ধরে কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে নাটকের মহড়া। সেই নাটক, যে কিনা খেলাচ্ছলে মনে করিয়ে দেয় উৎসের কথা, মাটির কথা। নতুন আলাপ, নতুন সম্পর্ক গড়ে ওঠে-- ফিরে আসে ভুলে যাওয়া অভ্যাস।। তারপর একদিন, সেই দিন এল। সকাল থেকে ব্যস্ততা। নাটকের সাজপোশাক গোছানোর সঙ্গে সঙ্গে অল্পকথায় গৌরচন্দ্রিকা লিখে ফেলবার তাড়া। আর ওদিকে আমার ঘরতুতো বোন যখন বহুবিশ্রুত গানের কলি ভাঁজতে ভাঁজতে জল ছিটিয়ে শাড়ী পাট করতে বসেছে - শেষবারের মত ঝালিয়ে নিচ্ছে তার শ্রুতিনাটকের সংলাপ - হঠাৎই, পড়াশোনার ভান করে বিগত পাঁচবছর প্রায় সমস্ত সামাজিক অনুষ্ঠান থেকে বঞ্চিত আমার মনে পড়ে গেল ভাইফোঁটার সকালের কথা- একবাড়ী লোকের জন্য লালচন্দন বাটার স্মৃতি; কিংবা নিকটাত্মীয়ের বিয়েতে দুপুরবেলার পাকশালা থেকে ভেসে আসা শিলনোড়া-হামানদিস্তার একটানা আওয়াজ...
কোনোকালেই আমি তেমন একটা মিশুকে নই, গুছিয়ে কথা বলতেও পারিনা তেমন। তো(মা)দের/আপনাদের আছে এ নেহাতই আরো একটা আনন্দানুষ্ঠান হতে পারে, আমার কাছে যে কী, তা বলে বোঝাবার মত মুনশিয়ানা আমার নেই। আপাতত এই লেখাটুকু থাক। কৃতজ্ঞতা থাক। ভালোবাসা থাক। একসাথে মিলেমিশে থাকার অঙ্গীকারটুকু থাক।
কোথায় ঘর আর কোথায় পরবাস। "আমার আর কোথাও যাবার নেই, কিচ্ছু করার নেই।"
[নাটকের ভূমিকা: " দুনিয়া ছুটছে। আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে আমরা। তাই আপন দেশ, ঘরের একান্ত নিভৃত কোণ আর প্রিয়জন ছেড়ে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে এই বিভুঁইয়ে পড়ে থাকা। ফেলে আসা যাপন-- মেঠো সুর, ঘরোয়া আড্ডা, পূজাবার্ষিকী আর ছোট্টবেলার গল্পকথা। ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী, বুদ্ধু-ভুতুম কিংবা ভূতপ্রেতের গল্প। অবাস্তবকে বিশ্বাস করার, স্বপ্ন দেখার গল্প। অলৌকিক জগৎকে ঘরসংসারের সাথে একাত্ম করে নেওয়া আমাদের গ্রামবাংলা- আমাদের অতীত - আমাদের শিকড়। মানুষের মুখে মুখে তৈরী হয়ে ছড়িয়ে যাওয়া কিংবদন্তী- সে তো সব দেশেই হয়ে এসেছে চিরকাল। এই Halloweenএর সপ্তাহে, যখন আমাদের ভিনদেশি পড়শিদের বাগান সাজছে তাদের নিজস্ব সংস্কারে; আর আমরা, বিশ্বের অপর প্রান্তের দুই ভূখন্ড ভাষা আর ঐতিহ্যের টানে আবার একত্র হয়েছি - একবার নয় ঘুরেই আসা যাক ঠাকুরমার ঝুলির খোঁজে- জলপিঁড়েয়... " ]
![]() |
| নাটকের কলাকুশলীবৃন্দ ও পরিচালিকা |

Comments
Post a Comment