![]() |
[সময়কাল ও স্থান: অপ্রাসঙ্গিক। ল্যাদ স্থানকালাতীত।] |
আমি: হ্যাঁ বলো।
মা: কী করছিস? আমি এই একটু দুধচা করলাম, চিনিছাড়া। [স্লা......র্প] (রোজ এইভাবেই কথোপকথন শুরু হয়)
আমি: এই একটু লেবুচা আর ল্যাদ খাচ্ছি।
মা: অ্যাঁ! কী খাচ্ছিস?
আমি: ল্যাদ, ল্যাদ।
মা: (কীরকম একটা দ্বিধান্বিত গলায়) বুঝতে পারছিনা। (ঘাড় ঘুরিয়ে বাবাকে) টিভিটা কমাও না! সারাদিন চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খবর দেখেই যাচ্ছে! তুমুন একটা নতুন খাবারের নাম বলল, ঠিক করে শুনতেই পেলাম না।
আমি: !!!!!!!
মা: (এবার আমার দিকে ফিরে) হ্যাঁ বল।
আমি: নতুন খাবার আবার কী? বললাম তো ল্যাদ।
মা: ও! আমেরিকান খাবার?
আমি: উফফ এতে আমেরিকান কোত্থেকে এল? আশ্চর্য্য! ল্যাদ জানো না?
মা: (খচে গিয়ে) তোরা আজকাল কী খাস কী বলিস আমি বুঝতে পারি না। বিদেশী খাবারের নাম আমি কীকরে জানব?
আমি: বারবার বলছি এটা খাবার না। ল্যাদ। বুঝেছো? লয়ে যফলা আকার - ল্যাদ।
মা: (ভুরু কুঁচকে) মানে?
আমি: ল্যাদ মানে ল্যাদ। এইটা না বোঝার কী আছে?
মা: (ভীষণ কাঁইমাই করে) ধুর আমি বুঝতে পারছি না। আমি কি অত ইংরাজি জানি? আমি বলেছি না পড়াশোনায় অত ভালো ছিলাম না? দাঁড়া বাবাকে জিজ্ঞেস করি।শুনছো...
[প্রেক্ষাপটে বাবার টিভির দিক থেকে চোখ না সরিয়ে হাত নাড়ানোর ভঙ্গির বঙ্গানুবাদ - আমি এর মধ্যে নেই। তোমাদের ব্যাপার তোমরা বুঝে নাও]
আমি: (পুরো বাংলা পক্ষ কায়দায়) কথায় কথায় পড়াশুনো টেনে আনো কেন? আর ইংরাজির সঙ্গে পড়াশুনোর কী সম্পর্ক? ভাষা এক জিনিস আর জ্ঞান আরেক জিনিস। এই ইংরাজি নিয়ে ভারতীয়রা যা করে, ইংরেজরা নিজেরাও ওর'ম করে কিনা সন্দেহ। নাও আরো যা যা পারো টেনে আনো। বিরক্তিকর!
মা: (গাড়ী পুরো লাইনচ্যুত বুঝতে পেরে) আচ্ছা আচ্ছা মানেটা বলে দিলেই তো হয়। একটা নতুন শব্দ শেখা হবে।
আমি: প্রথমত, ল্যাদ বাংলা শব্দ। না জানলেই সেটা ইংরাজি হতে হবে এটার মানে কী?
মা: (বিস্মিত) বাংলা শব্দ?! আগে শুনিনি তো?
আমি: শোনোনি কারণ এটা আমাদের প্রজন্মের ভাষা।
মা: (অন্যদিকে তাকিয়ে) কীজানি আমি তো কোনোদিন বলিনি।
আমি: বললাম তো এটা আমাদের প্রজন্মের ভাষা। মানে দিদাদের সময়কার, বা ধরো তারও আগে, বঙ্কিমচন্দ্রের সময় আর তোমাদের সময়কার ভাষা কী একরকম ছিল? ছিল না। ভাষা তো এরকমই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টাবে। নতুন কিছু যোগ হবে, পুরোনো কিছুর ব্যবহার বদলাবে। আর বাংলা তো ভাষা হিসাবে তো খুবই পরিবর্তনশীল (অ্যাডাপ্টিভ বলতে গিয়েও সামলে নিই, কয়েকদিন আগে বাবা বলেছে আমেরিকায় এসে আমার বাংলাটা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াদের মত 'কেমনকেমন' হয়ে যাচ্ছে)।
[অবাক হবেন না। ভাষাসংক্রান্ত বক্তৃতা আমি "না ভাই না ভাই আজ আমায় গাইতে বোলো না"র আদলে যাকেতাকে যেখানেসেখানে শুনিয়ে থাকি। লোকে যে আমায় এড়িয়ে চলে এটা তার অন্যতম কারণ]
মা: আ------চ্ছা!
আমি: হ্যাঁ, এবার মানেটা।
[এস্থলে বলে রাখা ভালো, ভদ্রমহিলা সংস্কৃত ও ভাষাতত্ত্বের ছাত্রী, ফলতঃ যেকোনো শব্দের ময়নাতদন্ত করে তার ব্যুৎপত্তি খুঁজে না বার করলে তাঁর পিত্তবিকার হয়। আমিও তাই বেশ একটা শ্রীযুক্ত ব্যাকরণতীর্থ বা ঐরকম ভারী কিছু একটা উপাধ্যধিকারীর মত নিষ্ঠায়, পিঠ সোজা করে বসে, বালিশটালিস সরিয়ে, ল্যাদের অর্থ ও তার প্রয়োগ বোঝানো আরম্ভ করলাম। বস্তুতঃ, বালিশ আর পিঠের ব্যাপারটা বোধগম্য না হলে হে পাঠক, আপনি কখনো শাস্ত্রসম্মতভাবে ল্যাদ খাননি]
মা: হ্যাঁ হ্যাঁ বল। (চোখেমুখে কী জ্ঞানপিপাসা!)
আমি: তো ল্যাদ হল খানিকটা আলস্য, খানিকটা বিশ্রাম সব মিলিয়ে একটা ব্যাপার। মানে এককথায় এটা বোঝানো মুশকিল। ধরো তোমাকে কিছু একটা কাজ করতে হবে, কিন্তু তোমার সেই মুহূর্তে ইচ্ছে করছে না। সেটা যেকোনো কাজই হতে পারে। সেটা বাজার যাওয়া হতে পারে, চুল আঁচড়ানো হতে পারে, কী ইমেলের উত্তর দেওয়াও হতে পারে।
মা: বাজার বললি বলে মনে পড়ল, বাবা সকাল সকাল নতুন বাজার থেকে ভালো পার্শে এনেছে। মাস্ক গ্লাভস সব পরেই গেছিল, আমি পইপই করে বলে দিয়েছি রোগ বাধালে আমি কিন্তু দেখতে পারব না... কালকের কচুশাক আর ঢেঁড়শের তরকারি ছিল, ঐ দিয়েই আজকে হয়ে যাবে। বাবাকে একটু ডালটা বসিয়ে দিতে বলব... এই তুই রোজ চুল আঁচড়াস তো? বাইরে না বেরোলেও রোজ চেপে চেপে চুল আঁচড়াবি, মস্তিষ্কে রক্তসঞ্চালন ভালো হয়। রাতে চুল বেঁধে শুবি, নইলে সাধুসন্ন্যাসীদের মত জট পড়ে যাবে।
আমি: উফ কোথায় চলে গেল! তুমি আমাকে বলতে দেবে? এটা একটা উদাহরণ, যেকোনো কাজ বোঝানোর জন্য।
মা: ভালোর জন্যই তো বললাম। সেই, এখন মার কথা তো ফেলনা হবেই...আচ্ছা আর বলবো না।
[জ্ঞান বিতরণের সময় শ্লেষ গায়ে মাখলে চলে না। আমি অটল থাকি]
আমি: হ্যাঁ যা বলছিলাম। তো তোমার যে কাজটা করতে ইচ্ছে করছে না, সেটা বোঝাতে তুমি বলবে "ল্যাদ লাগছে"।
মা: এই যে বললি ল্যাদ খায়?
আমি: আরে একটা শব্দের একাধিক প্রয়োগ হয় না?
মা: ও হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝেছি। বিশেষ্যটা এক রেখে ক্রিয়াপদটা পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে।
আমি: হ্যাঁ তাই। তো এই হল ল্যাদ লাগা। আর ল্যাদ খাওয়া একটা, মানে যাকে বলে, পুরো শিল্প। তূরীয় অবস্থা। কোনো কাজ করছো না, মানে গল্পের বই টৈও পড়ছো না, বেশ একটা হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে আছো, চোখ খুলে থাকলেও কিছু দেখছোনা, কিছু চিন্তাটিন্তাও করছো না- একটা খু---ব আরামদায়ক (রিল্যাক্সিং বলতে গিয়ে - ঐ আগে যা বলেছি) ব্যাপার। এটা ঘুমানো বা ঝিমানো বা জিরিয়ে নেওয়া নয় কিন্তু। ল্যাদ আলাদা।
মা: (ধীর ধ্যানস্থ গলায়) ওওও...
আমি: মানে ধ্যান বা শবাসনও নয়। ল্যাদ একটা আলাদা ব্যাপার। অনেকক্ষণ ধরে খাওয়া যায়। বুঝেছো?
মা: এই তুই এখন আর যোগাসন করিস? সকালে উঠে করতে পারিস তো একটু। শরীরটা ঝরঝরে লাগবে। আমার করব করব করে আর করা হয় না। তুই যে জিমন্যাস্টিকটা কেন ছেড়ে দিলি...ব্যায়ামের স্যারের সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয় না...
আমি: তুমি আসল কথাটায় মন না দিয়ে যা পারছ বলে যাচ্ছ। তাহলে জিজ্ঞেস করলে কেন? এতক্ষণ কী বললাম বলো তো?
মা: ঐ তো..
আমি: হ্যাঁ বলো, আদৌ পুরোটা শুনেছ কীনা কে জানে
মা: (তেড়ে উঠে) তোর মতো বসে থাকলে তো আমার চলবে না, এই যে কথা বলছি, এখনও মাথায় ঘুরছে এরপর কী কী করব। কাপড় ভেজাতে হবে...
আমি: আরে তাহলে জিজ্ঞেস করার কী দরকার ছিল। নাও আর কিছু বলার থাকলে বলো, নইলে রাখছি।
মা: (একটি ইঙ্গিতমূলক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে) হ্যাঁ.... রাখ।
আমি: কাটো। দেখি মনে আছে কীনা ভিডিওকল কীভাবে কাটে।
মা: তুই কাট। ল্যাদ খা। আমার কাটতে ল্যাদ লাগছে।
[একটি আকর্ণবিস্তৃত হাসি, ঠক করে ফোন রাখার আওয়াজ, ও প্রস্থান। স্ক্রিনে তখন নোনা ধরা ঘরের সাদাগোলাপী ছাদ]
Comments
Post a Comment