ঘর-বারান্দা, বাড়ী, পাঁচিলের চৌহদ্দি। ছোটোখাটো বস্তি। সারিসারি জবরদখল হয়ে যাওয়া সরকারী খাসজমি। রেশন, তেলেভাজা-বইখাতা-বাসন আর মনিহারির দোকান, মুদিখানা, বস্ত্রালয়, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। দুবেলা সব্জী আর মাছের অস্থায়ী বাজার। খেলার মাঠ, পার্ক, বাঁধানো রক, ক্লাবঘর। পুরসভা বা পঞ্চায়েতের ব্লকের ভেতরে একখন্ড রাজনৈতিক সংজ্ঞাহীন অঞ্চল, স্বতন্ত্র সভ্যতা। তথাকথিত আত্মীয়তার ঊর্ধ্বে, নিছক পরিচয়ের সূত্রে গড়ে ওঠা স্বাজাত্যবোধ। পাড়া।
জটিল অলিগলির কোনটা ঘেয়ো এবং ক্ষ্যাপা কুকুর, বা 'প্রস্রাব করিবেন না' বিজ্ঞপ্তি দেখে মনে প্রতিবাদী সত্ত্বা জেগে ওঠা বীরপুঙ্গবদের রাজত্ব সেটা খেয়াল রাখতে হয়। যেমন মনে রাখতে হয় প্রবল বর্ষায় অপেক্ষাকৃত উঁচু এবং কম ভাঙাচোরা পথঘাটের মানচিত্র, আর 'ফাস্ট ফুডের' ছোটোখাটো দোকানগুলোয় রাঁধুনীর অভিজ্ঞতার তারতম্য। কোন সুবিধেবাদী রিকশাচালকের অন্যায্য ভাড়া চেয়ে বসার বদভ্যেস আছে, বা কোন গৃহপরিচারিকার অত্যধিক হাতটান আর কামাইয়ের বাতিক - তাও একরকম কণ্ঠস্থ হয়ে যায় বৈকি।
সর্ষে পেষাই আর কয়লা বা গম ভাঙানোর অনেককালের পুরনো দোকান, বা কাঠের গোলা পথনির্দেশিকা হিসেবে এখনও ব্যবহার হয়। বন্ধ হয়ে যাওয়া চশমা-রেডিও-ঝর্ণাকলম-রঙ-ছাতা-জলছবির কারখানার ব্যর্থ স্মারক হিসেবে রাস্তা, বাজার আর পাড়ার নামকরণ হয়। পরিত্যক্ত, বটের শিকড় আর আগাছায় ঘেরা ভাঙাচোরা বাগানবাড়ীর নামে ভুতুড়ে গল্প ফাঁদা হয়; আর যাবতীয় তথাকথিত নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ডের আখড়া হিসেবে তার উত্থান হতে থাকে। সব জেনেবুঝেও সাহস করে কেউ কিছু বলতে পারে না- বরং মুখে মুখে আজগুবি ঘটনার কথা ছড়িয়ে যায়। তারপর, সেখানেই যখন একদিন ঝকঝকে শপিং মল বা বড় হাউজিং কমপ্লেক্স মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে - লোকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে, আর সেই সঙ্গে আরো একবার ইতিহাস হয়ে যায় দুর্বল সংস্কারভিত্তিক আঞ্চলিক লোককথা।
বছরভর লেগে থাকে উৎসব। অজস্র ব্রত উপবাস মানত - অটল বিশ্বাসনির্ভর কৃচ্ছ্রসাধন। অবস্থাপন্ন নিঃসন্তান বাড়ীর চৌকাঠে হৈমন্তী কুয়াশার সুযোগ নিয়ে কার্তিক ফেলে যায় বিচ্ছু ছেলেপুলেরা। শীতের মিঠে রোদে বড়ি, আচার আর লেপকম্বল সেঁকতে দেওয়া হয়, ছাদে ছাদে ঘরোয়া খোশগল্প ভাসে। আর গলিতে গলিতে ক্রিকেট। সাধারণ জীবনের সাধারণ বিলাস। সাদামাঠা বড়দিনের কেক আর সংক্রান্তির পুলিপিঠে। পাড়ার ক্লাবে সাংস্কৃতিক আর ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন। অপেশাদারী, কিন্তু আন্তরিক। ক্লাবসংলগ্ন মাঠে চড়ুইভাতি, সার্কাস আর মেলা। নগণ্য চাঁদা, কমদামি টিকিট আর বিকিকিনির পরিবর্তে অমূল্য নির্ভার আমোদ-উচ্ছ্বাস। শ্রীপঞ্চমী আর দোলযাত্রার রোমাঞ্চকর বাসন্তী রঙ। নববর্ষে, অক্ষয় তৃতীয়ায় বাণিজ্যে ব্যর্থ জনজাতির চাঁদসদাগরী ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার সাধু প্রচেষ্টা। পাড়ার কচিদের নাচগানের দল জোগাড় করে ভ্যাপসা গরমের ছুটিতে তক্তার মঞ্চ বানিয়ে রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত সন্ধ্যা। আর প্রভাতফেরি। আন্তর্জাতিক স্তরের খেলাধুলোর অন্তিম দিনে পাড়ার ক্লাবে বড়পর্দায় দলবেঁধে অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ। বর্ষায় পাড়ার পুকুরে মাছধরার হিড়িক; সাঁতার শেখানোয় সাময়িক বিরতি। খাস্তা কচুরি আর গণসঙ্গীতে স্বাধীনতার অবুঝ উদযাপন। এমন করে বছর ঘুরে এসে পড়ে বিশ্বকর্মার আবাহন। আকাশে পেটকাটি-চাঁদিয়ালের তরজা, আর মধ্যরাতে মদ্যপ রিকশাচালকদের এলোপাথাড়ি ফুটপাথ বদল। তারপরেই, সম্বৎসরের মধ্যবিত্ততার ক্লেদ আর গ্লানি গুঁড়ো করে দিতে ঘরে ঘরে ব্রহ্মমূহুর্তে বেজে ওঠে রেডিও। অন্যরকম আলো, অনুনাদ আর ভৈরবী হাওয়ায় নতুন করে সবকিছুতে ভরসা জাগে। প্রায় শতাব্দীপ্রাচীন বারোয়ারী পুজোয় এখনও শতাধিক পদাতিকের কাঁধে করে একচালার প্রতিমা আসে। আবহে যোগ্য সঙ্গত দেয় ক্যাসেটের যুগের পুজোর গান। বিসর্জনের পদযাত্রা ধীরলয়ে ঘরে ফেরে সুপ্রাচীন পাঁচালীর মন কেমন করা সমবেত স্বরে। ভগ্ন বিবাহবাসরের মত বিষণ্ণ মণ্ডপে হার্দিক আলিঙ্গন আর চন্দ্রপুলি-জিবেগজার আদানপ্রদানের সাথে সাথে সেরে ফেলা হয় কোজাগরীর পারস্পরিক নিমন্ত্রণ। আরো একবার, মিলেমিশে থাকবার শপথ নেওয়া হয়ে যায়। একচালার প্রতিমার মত।
বৃহত্তর সমাজের উত্থানপতনের আড়ালেও এমন অনেককিছুই বেঁচে থাকে, ঘটে, বাঁচিয়ে রাখা হয়।
অঞ্চল অর্থে যেমন এলাকা হয়, আঁচলও হয়। পাড়ার ক্ষেত্রে উভয়ই প্রবলভাবে সত্য। বিক্ষুব্ধ উত্তাল সময়ে একটুকরো স্বস্তির উৎস হয়ে জেগে থাকা বৃহত্তর পরিবার। সেখানেই পাড়ার সার্বিক সার্থকতা।
সর্ষে পেষাই আর কয়লা বা গম ভাঙানোর অনেককালের পুরনো দোকান, বা কাঠের গোলা পথনির্দেশিকা হিসেবে এখনও ব্যবহার হয়। বন্ধ হয়ে যাওয়া চশমা-রেডিও-ঝর্ণাকলম-রঙ-ছাতা-জলছবির কারখানার ব্যর্থ স্মারক হিসেবে রাস্তা, বাজার আর পাড়ার নামকরণ হয়। পরিত্যক্ত, বটের শিকড় আর আগাছায় ঘেরা ভাঙাচোরা বাগানবাড়ীর নামে ভুতুড়ে গল্প ফাঁদা হয়; আর যাবতীয় তথাকথিত নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ডের আখড়া হিসেবে তার উত্থান হতে থাকে। সব জেনেবুঝেও সাহস করে কেউ কিছু বলতে পারে না- বরং মুখে মুখে আজগুবি ঘটনার কথা ছড়িয়ে যায়। তারপর, সেখানেই যখন একদিন ঝকঝকে শপিং মল বা বড় হাউজিং কমপ্লেক্স মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে - লোকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে, আর সেই সঙ্গে আরো একবার ইতিহাস হয়ে যায় দুর্বল সংস্কারভিত্তিক আঞ্চলিক লোককথা।
বছরভর লেগে থাকে উৎসব। অজস্র ব্রত উপবাস মানত - অটল বিশ্বাসনির্ভর কৃচ্ছ্রসাধন। অবস্থাপন্ন নিঃসন্তান বাড়ীর চৌকাঠে হৈমন্তী কুয়াশার সুযোগ নিয়ে কার্তিক ফেলে যায় বিচ্ছু ছেলেপুলেরা। শীতের মিঠে রোদে বড়ি, আচার আর লেপকম্বল সেঁকতে দেওয়া হয়, ছাদে ছাদে ঘরোয়া খোশগল্প ভাসে। আর গলিতে গলিতে ক্রিকেট। সাধারণ জীবনের সাধারণ বিলাস। সাদামাঠা বড়দিনের কেক আর সংক্রান্তির পুলিপিঠে। পাড়ার ক্লাবে সাংস্কৃতিক আর ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন। অপেশাদারী, কিন্তু আন্তরিক। ক্লাবসংলগ্ন মাঠে চড়ুইভাতি, সার্কাস আর মেলা। নগণ্য চাঁদা, কমদামি টিকিট আর বিকিকিনির পরিবর্তে অমূল্য নির্ভার আমোদ-উচ্ছ্বাস। শ্রীপঞ্চমী আর দোলযাত্রার রোমাঞ্চকর বাসন্তী রঙ। নববর্ষে, অক্ষয় তৃতীয়ায় বাণিজ্যে ব্যর্থ জনজাতির চাঁদসদাগরী ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার সাধু প্রচেষ্টা। পাড়ার কচিদের নাচগানের দল জোগাড় করে ভ্যাপসা গরমের ছুটিতে তক্তার মঞ্চ বানিয়ে রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত সন্ধ্যা। আর প্রভাতফেরি। আন্তর্জাতিক স্তরের খেলাধুলোর অন্তিম দিনে পাড়ার ক্লাবে বড়পর্দায় দলবেঁধে অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ। বর্ষায় পাড়ার পুকুরে মাছধরার হিড়িক; সাঁতার শেখানোয় সাময়িক বিরতি। খাস্তা কচুরি আর গণসঙ্গীতে স্বাধীনতার অবুঝ উদযাপন। এমন করে বছর ঘুরে এসে পড়ে বিশ্বকর্মার আবাহন। আকাশে পেটকাটি-চাঁদিয়ালের তরজা, আর মধ্যরাতে মদ্যপ রিকশাচালকদের এলোপাথাড়ি ফুটপাথ বদল। তারপরেই, সম্বৎসরের মধ্যবিত্ততার ক্লেদ আর গ্লানি গুঁড়ো করে দিতে ঘরে ঘরে ব্রহ্মমূহুর্তে বেজে ওঠে রেডিও। অন্যরকম আলো, অনুনাদ আর ভৈরবী হাওয়ায় নতুন করে সবকিছুতে ভরসা জাগে। প্রায় শতাব্দীপ্রাচীন বারোয়ারী পুজোয় এখনও শতাধিক পদাতিকের কাঁধে করে একচালার প্রতিমা আসে। আবহে যোগ্য সঙ্গত দেয় ক্যাসেটের যুগের পুজোর গান। বিসর্জনের পদযাত্রা ধীরলয়ে ঘরে ফেরে সুপ্রাচীন পাঁচালীর মন কেমন করা সমবেত স্বরে। ভগ্ন বিবাহবাসরের মত বিষণ্ণ মণ্ডপে হার্দিক আলিঙ্গন আর চন্দ্রপুলি-জিবেগজার আদানপ্রদানের সাথে সাথে সেরে ফেলা হয় কোজাগরীর পারস্পরিক নিমন্ত্রণ। আরো একবার, মিলেমিশে থাকবার শপথ নেওয়া হয়ে যায়। একচালার প্রতিমার মত।
বৃহত্তর সমাজের উত্থানপতনের আড়ালেও এমন অনেককিছুই বেঁচে থাকে, ঘটে, বাঁচিয়ে রাখা হয়।
অঞ্চল অর্থে যেমন এলাকা হয়, আঁচলও হয়। পাড়ার ক্ষেত্রে উভয়ই প্রবলভাবে সত্য। বিক্ষুব্ধ উত্তাল সময়ে একটুকরো স্বস্তির উৎস হয়ে জেগে থাকা বৃহত্তর পরিবার। সেখানেই পাড়ার সার্বিক সার্থকতা।
Comments
Post a Comment