Skip to main content

পাড়া


ঘর-বারান্দা, বাড়ী, পাঁচিলের চৌহদ্দি। ছোটোখাটো বস্তি। সারিসারি জবরদখল হয়ে যাওয়া সরকারী খাসজমি। রেশন, তেলেভাজা-বইখাতা-বাসন আর মনিহারির দোকান, মুদিখানা, বস্ত্রালয়, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। দুবেলা সব্জী আর মাছের অস্থায়ী বাজার। খেলার মাঠ, পার্ক, বাঁধানো রক, ক্লাবঘর। পুরসভা বা পঞ্চায়েতের ব্লকের ভেতরে একখন্ড রাজনৈতিক সংজ্ঞাহীন অঞ্চল, স্বতন্ত্র সভ্যতা। তথাকথিত আত্মীয়তার ঊর্ধ্বে, নিছক পরিচয়ের সূত্রে গড়ে ওঠা স্বাজাত্যবোধ। পাড়া।

সবাই সবার খোঁজ রাখে। পথেঘাটে দোকানবাজারে নিতান্ত সাধারণ বারোমাস্যার আদানপ্রদান। ডিগ্রী পাশ বা চাকরির খবরে স্বস্তি আসে, বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে রক্ষণশীল গুঞ্জন ওঠে, সুস্থসবল সন্তানের জন্মে খুশীর হাওয়া বয়। রাতবিরেতে শ্মশানবন্ধু জোগাড় করতে কখনো বেগ পেতে হয় না। সন্ততিত্যজ্য অশীতিপর বৃদ্ধা, কিঞ্চিৎ মানসিক ভারসাম্যহীন অবিবাহিতা প্রৌঢ়া বা বহুজনের সংসারে এককোণে খুদকুঁড়োর মত পড়ে থাকা স্নায়ুরোগাক্রান্ত যুবকের পারিবারিক ইতিহাস ছাপোষা জনজীবনে দুশ্চিন্তা, সহানুভূতি আর অনিশ্চয়তাবোধের সঞ্চার করে। কেউ বাড়ী বিক্রি করে চলে গেলেও তাদের নতুন বসতের সন্ধান করা হয়। সেখানে নতুন কেউ এলে তাদের দায়িত্ব নিয়ে পাড়ার হালহকিকত বুঝিয়ে দেওয়া হয়। একথা খাটে নতুন মাছ বা সব্জী বিক্রেতা, কিংবা দোকানীর ক্ষেত্রেও। নিঃসংশয়ে লোকে ধারবাকি রাখে মুখের কথায়। ভরসায়। তেমনই রগচটা খিটখিটে দোকানদারের খবর ছড়িয়ে পড়তেও সময় লাগে না। নিয়মিত ক্রেতার কাছে ওষুধের দোকানের কর্মচারী প্রেসক্রিপশন চায় না। মনে রাখে। ওষুধ কাজে দিচ্ছে কিনা খবর নেয়। অনুষ্ঠানাদিতে চেনা রান্নার ঠাকুরের ডাক পড়ে। বাড়ীর ছাদ আর উঠোনে স্থান সঙ্কুলান না হলে পাড়ার 'বিয়েবাড়ী' ভাড়া করা হয়। আর পাড়ার মন্দিরের বারোয়ারী পুরোহিত। মধ্যবিত্ত সাশ্রয়। যার অন্যতম অংশ রবিবাসরীয় সেলুন (যাকে উচ্চবিত্তরা বলেন সালোঁ), আর পাশের বিড়ি-জর্দা-খৈনির একচালা দোকান। চায়ের দোকান আজকাল তেমন চলে না, তবে ছুটির দিনে দিব্যি ছোটোখাটো আড্ডা জমে। বেকারীর ভ্যানচালক মাসকাবারী মালের যোগান দিতে এসে মিষ্টির দোকানে অমৃতি-ডালপুরীর অজুহাতে সুখদুঃখের গল্প করতে বসে। অবসরপ্রাপ্ত বয়স্করা এইজাতীয় বাক্যালাপের নিয়মিত শ্রোতা। মাছওয়ালা গ্রামের বাড়ী, গোয়াল আর ভেড়ীর গল্প বলে, মাছ চিনতে শেখায়। মাংসের দোকানে বাড়ীর শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ সদস্যসংখ্যা খেয়াল রাখে, সেইমত মাংস বাছাই হয়। সাপ্তাহিক পরিমাণের হেরফের হলে অতিথি আগমনের কারণ জানতে পেরে অভিনন্দন জানায়, অচেনা নতুন মানুষের কদর পেতে পরে মাংসের গুণাগুণ সম্পর্কে খোঁজ পর্যন্ত নেয়। বাজারনির্ধারিত দামের পরিবর্তে বিভিন্ন মুদির দোকানে আঞ্চলিক ক্রেতার চাহিদানির্ভর বিবিধ দ্রব্যমূল্য। এখানেও, কেবল মুখ চিনে দরকারী জিনিস ও তার পরিমাণ ইত্যাদি মনে রাখবার চল। বিক্রেতা অন্য পাড়ার হলেও তার বাড়ীর ভালোমন্দের খবরাখবর রাখে লোকজন। তাই উত্তরপ্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা দশকর্মা ভাণ্ডারের দোকানী অবলীলায় ইতুপুজোর সামগ্রী গুছিয়ে দেয়। অভ্যাস, আর পর্যবেক্ষণের ফল। বাড়ী বাড়ী ঘুরে পুরনো জামাকাপড়ের বদলে যারা সস্তার বাসন আর আসবাব বিক্রি করে, সেই 'হিন্দুস্তানী' বাসনওয়ালীদের বিশ্রামের জন্যে বাড়ীর সামনের চওড়া লালমেঝের রোয়াক ছেড়ে দেওয়া হয়। সুদূর কাঠমাণ্ডুর মাঝবয়সী গৃহবধূ স্বচ্ছন্দে বাঙালিনী পড়শিদের সঙ্গে কূটকচালি আর গার্হস্থ্য আলোচনায় মাতে। মারওয়াড়ি মুদি ক্লাবের কালীপুজোয় ভোগের খরচের দায়িত্ব নিয়ে চোঙায় বাজানো শ্যামাসঙ্গীত শুনতে শুনতে তার একান্ত দিওয়ালি উদযাপন করে। বিহারী ভুজিয়াওয়ালার তৃতীয় প্রজন্ম নির্দ্বিধায় বাংলা মাধ্যম ইস্কুলে ভর্তি হয়ে যায়।

জটিল অলিগলির কোনটা ঘেয়ো এবং ক্ষ্যাপা কুকুর, বা 'প্রস্রাব করিবেন না' বিজ্ঞপ্তি দেখে মনে প্রতিবাদী সত্ত্বা জেগে ওঠা বীরপুঙ্গবদের রাজত্ব সেটা খেয়াল রাখতে হয়। যেমন মনে রাখতে হয় প্রবল বর্ষায় অপেক্ষাকৃত উঁচু এবং কম ভাঙাচোরা পথঘাটের মানচিত্র, আর 'ফাস্ট ফুডের' ছোটোখাটো দোকানগুলোয় রাঁধুনীর অভিজ্ঞতার তারতম্য। কোন সুবিধেবাদী রিকশাচালকের অন্যায্য ভাড়া চেয়ে বসার বদভ্যেস আছে, বা কোন গৃহপরিচারিকার অত্যধিক হাতটান আর কামাইয়ের বাতিক - তাও একরকম কণ্ঠস্থ হয়ে যায় বৈকি।

সর্ষে পেষাই আর কয়লা বা গম ভাঙানোর অনেককালের পুরনো দোকান, বা কাঠের গোলা পথনির্দেশিকা হিসেবে এখনও ব্যবহার হয়। বন্ধ হয়ে যাওয়া চশমা-রেডিও-ঝর্ণাকলম-রঙ-ছাতা-জলছবির কারখানার ব্যর্থ স্মারক হিসেবে রাস্তা, বাজার আর পাড়ার নামকরণ হয়। পরিত্যক্ত, বটের শিকড় আর আগাছায় ঘেরা ভাঙাচোরা বাগানবাড়ীর নামে ভুতুড়ে গল্প ফাঁদা হয়; আর যাবতীয় তথাকথিত নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ডের আখড়া হিসেবে তার উত্থান হতে থাকে। সব জেনেবুঝেও সাহস করে কেউ কিছু বলতে পারে না- বরং মুখে মুখে আজগুবি ঘটনার কথা ছড়িয়ে যায়। তারপর, সেখানেই যখন একদিন ঝকঝকে শপিং মল বা বড় হাউজিং কমপ্লেক্স মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে - লোকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে, আর সেই সঙ্গে আরো একবার ইতিহাস হয়ে যায় দুর্বল সংস্কারভিত্তিক আঞ্চলিক লোককথা।

বছরভর লেগে থাকে উৎসব। অজস্র ব্রত উপবাস মানত - অটল বিশ্বাসনির্ভর কৃচ্ছ্রসাধন। অবস্থাপন্ন নিঃসন্তান বাড়ীর চৌকাঠে হৈমন্তী কুয়াশার সুযোগ নিয়ে কার্তিক ফেলে যায় বিচ্ছু ছেলেপুলেরা। শীতের মিঠে রোদে বড়ি, আচার আর লেপকম্বল সেঁকতে দেওয়া হয়, ছাদে ছাদে ঘরোয়া খোশগল্প ভাসে। আর গলিতে গলিতে ক্রিকেট। সাধারণ জীবনের সাধারণ বিলাস। সাদামাঠা বড়দিনের কেক আর সংক্রান্তির পুলিপিঠে। পাড়ার ক্লাবে সাংস্কৃতিক আর ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন। অপেশাদারী, কিন্তু আন্তরিক। ক্লাবসংলগ্ন মাঠে চড়ুইভাতি, সার্কাস আর মেলা। নগণ্য চাঁদা, কমদামি টিকিট আর বিকিকিনির পরিবর্তে অমূল্য নির্ভার আমোদ-উচ্ছ্বাস। শ্রীপঞ্চমী আর দোলযাত্রার রোমাঞ্চকর বাসন্তী রঙ। নববর্ষে, অক্ষয় তৃতীয়ায় বাণিজ্যে ব্যর্থ জনজাতির চাঁদসদাগরী ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার সাধু প্রচেষ্টা। পাড়ার কচিদের নাচগানের দল জোগাড় করে ভ্যাপসা গরমের ছুটিতে তক্তার মঞ্চ বানিয়ে রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত সন্ধ্যা। আর প্রভাতফেরি। আন্তর্জাতিক স্তরের খেলাধুলোর অন্তিম দিনে পাড়ার ক্লাবে বড়পর্দায় দলবেঁধে অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ। বর্ষায় পাড়ার পুকুরে মাছধরার হিড়িক; সাঁতার শেখানোয় সাময়িক বিরতি। খাস্তা কচুরি আর গণসঙ্গীতে স্বাধীনতার অবুঝ উদযাপন। এমন করে বছর ঘুরে এসে পড়ে বিশ্বকর্মার আবাহন। আকাশে পেটকাটি-চাঁদিয়ালের তরজা, আর মধ্যরাতে মদ্যপ রিকশাচালকদের এলোপাথাড়ি ফুটপাথ বদল। তারপরেই, সম্বৎসরের মধ্যবিত্ততার ক্লেদ আর গ্লানি গুঁড়ো করে দিতে ঘরে ঘরে ব্রহ্মমূহুর্তে বেজে ওঠে রেডিও। অন্যরকম আলো, অনুনাদ আর ভৈরবী হাওয়ায় নতুন করে সবকিছুতে ভরসা জাগে। প্রায় শতাব্দীপ্রাচীন বারোয়ারী পুজোয় এখনও শতাধিক পদাতিকের কাঁধে করে একচালার প্রতিমা আসে। আবহে যোগ্য সঙ্গত দেয় ক্যাসেটের যুগের পুজোর গান। বিসর্জনের পদযাত্রা ধীরলয়ে ঘরে ফেরে সুপ্রাচীন পাঁচালীর মন কেমন করা সমবেত স্বরে। ভগ্ন বিবাহবাসরের মত বিষণ্ণ মণ্ডপে হার্দিক আলিঙ্গন আর চন্দ্রপুলি-জিবেগজার আদানপ্রদানের সাথে সাথে সেরে ফেলা হয় কোজাগরীর পারস্পরিক নিমন্ত্রণ। আরো একবার, মিলেমিশে থাকবার শপথ নেওয়া হয়ে যায়। একচালার প্রতিমার মত।                

বৃহত্তর সমাজের উত্থানপতনের আড়ালেও এমন অনেককিছুই বেঁচে থাকে, ঘটে, বাঁচিয়ে রাখা হয়।   

অঞ্চল অর্থে যেমন এলাকা হয়, আঁচলও হয়। পাড়ার ক্ষেত্রে উভয়ই প্রবলভাবে সত্য। বিক্ষুব্ধ উত্তাল সময়ে একটুকরো স্বস্তির উৎস হয়ে জেগে থাকা বৃহত্তর পরিবার। সেখানেই পাড়ার সার্বিক সার্থকতা।

Comments

Popular posts from this blog

হে সই-সব,

আমিও যে কোনোকালে শিশু ছিলাম, আর প্রতিটি দিন বাঙ্ময় শিশুদিবস ছিল, তার প্রমাণ এই নিম্নোল্লিখিত 'কবিতা'গুচ্ছ।  জীবনবিমার কোম্পানি প্রতি বছর একটা করে ডাইরি দিত, কীজানি কার বারোমাস্যা লিখবার প্রেরণা। তার পাতায় পাতায় রীতিমত তারিখ দিয়ে, চার-পাঁচ লাইন জুড়ে জুড়ে ঈগলের ঠ্যাঙের মত হাতের লেখায় আমি হিজিবিজি জমিয়ে রাখতাম। আবার ভাবতুম পেন্সিলের কোম্পানির নাম কেন বেছে বেছে অপ্সরা বা নটরাজ হয়, আর খাতার কোম্পানি গুডবয়। তখন ধারণা ছিল, পৃথিবীর (একেবারে বিশ্বস্তরে না ভাবলে ঠিক সেই গুরুত্বটা অনুধাবন করা মুশকিল হয়ে যেত) স-ম-স্ত কবিতাই আট পংক্তির। ফলতঃ, সেই সাড়ে চার বছর বয়সে মৌলিক কিছু একটা লেখবার চেষ্টা করে দেখা গেল, "উঠল বাউল সকালেতে একতারাটি নিয়ে, একতারাটি পরের দিনই হায়রে, ভেঙে গিয়ে সে ভাঙা মনে কাঁদতে গেল বনের ধারে গিয়ে- " ছ'লাইনের বেশী এগোল না। এর পরে কী হওয়া উচিৎ কিছুতেই বুঝতে পারলাম না। আমার লেখা প্রথম 'কবিতা' একটি সার্থক ছোটগল্প হতে হতেও হল না।   এর পরেরটা সম্ভবত সদ্য উপেন্দ্রকিশোর পড়বার ফল। প্রথম শ্রেণীতে পড়তে বাংলা আর ইংরেজি ক্ল...

ল্যাদকথন: একটি শনিবাসরীয় চলভাষালাপ

[সময়কাল ও স্থান: অপ্রাসঙ্গিক। ল্যাদ স্থানকালাতীত।]  আমি: হ্যাঁ বলো। মা: কী করছিস? আমি এই একটু দুধচা করলাম, চিনিছাড়া। [স্লা......র্প]  (রোজ এইভাবেই কথোপকথন শুরু হয়)  আমি: এই একটু লেবুচা আর ল্যাদ খাচ্ছি। মা: অ্যাঁ! কী খাচ্ছিস? আমি: ল্যাদ, ল্যাদ।  মা: (কীরকম একটা দ্বিধান্বিত গলায়) বুঝতে পারছিনা। (ঘাড় ঘুরিয়ে বাবাকে) টিভিটা কমাও না! সারাদিন চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খবর দেখেই যাচ্ছে! তুমুন একটা নতুন খাবারের নাম বলল, ঠিক করে শুনতেই পেলাম না।  আমি: !!!!!!! মা: (এবার আমার দিকে ফিরে) হ্যাঁ বল।  আমি:  নতুন খাবার আবার কী? বললাম তো ল্যাদ।  মা: ও! আমেরিকান খাবার?  আমি: উফফ এতে আমেরিকান কোত্থেকে এল? আশ্চর্য্য! ল্যাদ জানো না? মা: (খচে গিয়ে) তোরা আজকাল কী খাস কী বলিস আমি বুঝতে পারি না। বিদেশী খাবারের নাম আমি কীকরে জানব?  আমি: বারবার বলছি এটা খাবার না। ল্যাদ। বুঝেছো? লয়ে যফলা আকার - ল্যাদ।  মা: (ভুরু কুঁচকে) মানে? আমি: ল্যাদ মানে ল্যাদ। এইটা না বোঝার কী আছে?  মা: (ভীষণ কাঁইমাই করে) ধুর আমি বুঝতে পারছি না। আমি কি অ...

খুকির প্রত্যাবর্তন, ও ধন্যবাদগাথা

সেই সময়ের কথা। যখন পাশের পাড়াকে মনে হত পৃথিবীর শেষ প্রান্ত, আর মাসিক পত্রিকার শিশুবিভাগে কাঁচাহাতের গল্প-কবিতা লিখে পাঠাবার সময় বাদামী খামের বাঁদিকে গোটা গোটা অক্ষরে লিখতাম "প্রযত্নে.. বাবার নাম"। যখন যাবতীয় সৃষ্টিশীল শিল্পচর্চার বিপরীতে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানকে মনে হত গম্ভীর প্রাণহীন ব্যাপারস্যাপার; অন্যদিকে কল্পবিজ্ঞান আর খবরের কাগজে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কথা পড়ে রুশদেশী উপকথার অজানি-দেশের-না-জানি-কী এর মত অদ্ভুত ঘোরলাগা রোমাঞ্চ হত। তালগোল পাকিয়ে যেত সব। যখন বিদেশ মানে আমার কাছে বাংলার বাইরের সমগ্র বিশ্ব - কোনোকালেই যার ধারেকাছে পৌঁছানো হবে না আমার। এইসব ছাইপাঁশ ভাবতে ভাবতে যখন শীতের নিস্তব্ধ দুপুর বা গরমের ভ্যাপসা বিকেলে স্কুলের বারান্দায়-পার্কের মাঠে এমনকি জনবহুল বাজারহাটেও কেমন করে যেন নিজের মধ্যে ভীষণভাবে একা হয়ে যেতাম। অন্তরীপের মত।  তারপর, জীবন গিয়েছে চলে একটি দশক পার। যেসব মানুষের সাথে প্রতিদিন কথাবার্তা হয়, যাদের ওপর আমার দৈনন্দিন যাপন অনেকখানি নির্ভর করে থাকে, সেইসব মুখ বদলেছে। নতুন মুখের ভিড়ে ছোট্ট...

আলোকমঞ্জীর

।১। বিনোদিনীর ঘুম ভাঙে ভোরবেলায়। ছোট্টবেলাকার অভ্যেস। গেরামে বেড়ে উঠলে যেমনটি হয়। সেই যে গো, গাঁয়ের নামটি অঞ্জনা আর নদীর নামটি খঞ্জনা। ভাদ্দরমাস পেরোল কি পেরোল না, সেখেনে ভোরের দিকে হিম পড়ে। আর সারারাত ধরে টুপটাপ ঝরে পড়ে শিউলি। তার বুকের কাছটা ভোরের সুয্যির মত টকটকে কমলা। এতো সন কেটে গেল, সেই শিরশিরে হাওয়াটুকু রয়ে গেছে অমলিন। আর আছে বালিকাবেলার কড়ি ও কোমল। বিনোদিনী, আর তার শিউলিফুল পাতানো সই, স্নেহলতা। তাদের কোঁচড় ভর্তি শিশিরভেজা ফুল। ঘাটের কাছে ছলাৎ ছল, গল্প বলে নদীর জল। এমনি সময় নাম না জানা কোনো পাখি ডেকে উঠলেই বিনোদিনীর অবুঝ  মন  উথালপাথাল করে ওঠে...  ।২। নতুন পাড়ায় আসার পর  থেকে ভাবনার একটাও বন্ধু হয়নি। উফ, এরা আবার কীনা পাড়াকে বলে সোসাইটি। ভাবনা ওদের চেয়ে ঢের বেশী ইংলিশ স্টোরিজ পড়ে, তাই বলে কি ওরকম থেমে থেমে বেঙ্গলি বলে? এমা, না না, বেঙ্গলি না, বাংলা। ওদের পাশের ফ্ল্যাটের দিদুন কেমন মিষ্টি মিষ্টি বাংলা বলে, ওর মা তো অমনি বলে না। দিদুন বলে কিনা, মা তোমার ...

আলু-থালু

মেয়েটিকে একলা দেখে প্রৌঢ়া সহযাত্রিণী শুধোলেন, তাঁদের পরিবারের সঙ্গে রাতের খাবার ভাগ করে খেতে তার কোনো আপত্তি আছে কীনা। বাড়ী থেকে বানিয়ে আনা গরম খাবার, একেবারেই সাদামাটা; তবে সঙ্গে বাচ্চা ও বয়স্ক মানুষ আছে- তারা প্যান্ট্রির হাবিজাবি খেতে পারেনা। আর স্টেশনে দাঁড়ালেই খুচরো ভাজাভুজি মুখরোচক যা বিক্রি করতে আসে তার গুণমান তো কহতব্য নয়। একা মানুষের অবশ্য রান্না করে আনা ভারী ঝক্কি।    এর আগে মেয়েটিকে নিয়ে একপ্রস্থ আলোচনা হয়েছে ট্রেনের কুপে। ঢলঢলে টিশার্ট আর অনেকগুলো পকেটওয়ালা প্যান্ট, উবুঝুঁটি, মশমশে কেডস, ঢাউস ব্যাগপত্তর, তার ওপর এই দেড়দিনের দীর্ঘ যাত্রায় সঙ্গীহীন - এমন অসৈরণ ব্যাপার তাঁদের ছেলেবেলায় দেখা যেত না। আধুনিক না ছাই! ভয়ডর নেই মনে - সংস্কারের ঘটশ্রাদ্ধ করে ছেড়েছে। আর খাবারেরও বলিহারি - কীসব বার্গার-চিপ্স-আলুভাজা হ্যানাত্যানা! এইজন্যই অমন ঘাড়েগর্দানে একাকার। মেয়েমানুষ নয় একটু ভারী চেহারা হওয়া ভালো, তা বলে এতটা! মেয়েটি হেডফোনের আড়াল থেকে গুঞ্জনের আভাস পেয়েছে, আর করুণায় হেসেছে। সনাতনী আর সেকেলের মধ্যেকার কয়েক যোজন দূরত্ব যারা দেখতে পায়নি, তাদের অভিধ...

অসংলগ্ন

জ্বরের ঘোরে সবকিছু অন্যরকম লাগে। কপাল জুড়ে কাঠকয়লার উনুন। ওমের বদলে ছ্যাঁকা। মর্গের মতো ভয়াল ঠান্ডা হাতপায়ের তালু। লক্ষণ সুবিধের নয়।  ইন্দ্রিয়ের আশেপাশে শেকল পড়ে গ্যাছে। অবসাদের চেয়েও ভারী। বা শান্তিনিকেতনী শাল। আরো ওজনদার। শাল বলতে আবার বনেদী কাঠের কথা মনে আসে। নিরক্ষীয় বর্ষাপ্রবণ অঞ্চলের আদিম মহারণ্য। ঘন, অন্ধকার। কারাগারের কুঠুরির মতো। চেনা আসবাব, দৈনন্দিন ব্যবহার্য সালভাদর দালির চিত্রকল্পের মতো, ধনুষ্টঙ্কারের যন্ত্রণার মতো গলে পড়তে থাকে এঁকেবেঁকে। সাততলার জানলার জাল দিয়ে রাতের নাগরিক আকাশ বা রাজপথ অলস আলকাতরার মতো কালো মনে হয়। ঘর গরম রাখার যন্ত্রে একঘেয়ে আওয়াজ। শ্রুতিনির্বন্ধ। ঝিঁঝির ডাকের মত আচ্ছন্ন লাগে। ঘর্মক্লান্ত গরমের দিনে পুরোনো পাখার আওয়াজে যেমন ঝিম ধরে আসতো। বেসিনে জল পড়ার শব্দ শুনে নোঙর মাস্তুল ডিঙি নৌকার কথা মনে পড়ে। ইন্দ্রনাথের কথা, হাকলবেরি ফিনের কথা, ফটিকচাঁদের কথা। অপক্ক হাতে দিনান্তের সৈকতে তাজা মাছ কেনাবেচার প্যাস্টেল ছবি আঁকার কথা।  খিদিরপুর  ডকে প্রথমবার বাণিজ্যিক জাহাজ...

বীণা ও বাণী

তথাকথিত আস্তিকতা বলতে যা বোঝায়, কোনোকালেই আমার তা ছিল না। আমাদের ঘরে সন্ধ্যেবেলার শাঁখবাতি নেই, নীলষষ্ঠীর উপোস নেই। ভাস্কর্য আর মৃৎশিল্পের নিদর্শন স্বরূপ বুদ্ধ-খৃষ্ট-নানকের মূর্তি সাজানো আছে। প্রাচীন সাহিত্যের অংশ হিসাবে ধর্মগ্রন্থ আছে। দেশবিদেশের সনাতন লোকাচারের ইতিহাস জানবার, এবং যুক্তিহীন বিশ্বাসজনিত আনুগত্যের অভ্যাসকে অতিক্রম করেও তাকে যথাসম্ভব নিরপেক্ষভাবে সম্মান করার শিক্ষাটুকু আছে। আছে হালখাতায় বাংলা বর্ষপঞ্জী সংগ্রহ। ঈদের বিরিয়ানি আর ফিরনির যুগলবন্দীতে জন্নতলাভ। চৌকাঠে আর ছাদে হেমন্তের শিরশিরে হাওয়া উপেক্ষা করে দীপাবলির মোমবাতি জ্বালানো আছে। আলো ভাগ করে নেবার আকুলতা আছে, আলোয় ফেরবার আর্তি আছে। আর আছে সরস্বতীপুজো, ঘরকুনো মুখচোরা কিশোরীর একমাত্র আপন উৎসব। সহপাঠিনীর ছোট্ট ফোকলা ভাইবোন, চাঁদা চাইতে এসে বানান বলতে গিয়ে ঘাবড়ে যাওয়া পাড়ার সমিতির ছেলেছোকরা, বা নির্বিবাদী গৃহপরিচারিকার অনভ্যস্ত উচ্চারণে শৈশবেই আমার পিতৃমাতৃদত্ত নামের দৈবী উত্তরণ ঘটেছিল। তারপর আর নিজের সারসত্য সন্ধানে বেরিয়ে পড়া ছাড়া উপায় ছিল না। সেই শুরু আজন্মের সারস্বত সাধনার। আমি চিরকাল কমপ্ল্যান আর আধগ্রাস ...

টাঙলা

বাংলা শব্দে গোলগাল একটা ব্যাপার আছে। যেমন অক্ষর, তেমনি ধ্বনি। মাত্রা টেনে বর্ণমালা গাঁথবার রীতি দেবনাগরীতেই ছিল। কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত তীক্ষ্ণতার বদলে বাংলা অক্ষরে যা আছে তা হল কোমলতা, স্নিগ্ধতা, শান্ত নিবিড় একটা ভাব। শাপলার ডাঁটা, ফলসার থোক, শালিধানের চিঁড়ে বা কুবোপাখির ডাক ভাবলে যেমনটা হয়। সংস্কৃত শব্দে যুক্তাক্ষরের ঝঙ্কারে আভিজাত্য আছে, দৃপ্ত গৌরব আছে, প্রচ্ছন্ন অহংও বুঝি আছে। বাংলায় সেই যুক্তবর্ণকে বেণীপুতুলের মত-মেটে কুঁজোর মত-কেঠো ঘোড়ার মত গড়েপিটে-ছেঁচে-ডেবে নেওয়া হয়েছে; যাতে ধার কম, স্বরের আধার বেশী। তাই ব-ম-য-ফলায় (যেমন- নিঃস্ব, পদ্ম, সখ্য ইত্যাদি) স্বতন্ত্র বর্ণের আঘাতের বদলে দ্বিত্বব্যঞ্জনে জিভকে আরাম দেবার একটা আলসে চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। আলসে অবশ্য কোঠাবাড়ির ছাদেরও হয়, যেখানে নুনহলুদ ছোপ ফুলছাপা শাড়ির পাশে আচারের বয়াম ঝিমোয়। যেমন অক্ষর, তেমনি ধ্বনি। এঁটেল মাটির মত ভিজে ভিজে, হেঁটে গেলে যাতে পদচিহ্ন পড়ে। তার ওপর দিয়ে ধুলো উড়িয়ে টগবগিয়ে ঘোড়সওয়ার যায় না, পদাতিক কাহারের কাঁধে পালকি যায় দুলকি চালে। তা বলে কি একেবারেই তেজ ন...

শেষবারের মতো

অ - নে - ক দিন পরে।    হাওড়া স্টেশনে ট্রেন ঢুকবে কিছুক্ষণের মধ্যে। সাঁতরাগাছি পেরোনোর পরেই সকলের একটু একটু করে মালপত্র নামাবার ব্যস্ততা। আমার দুটো মাত্র ছোটো ছোটো ব্যাগ , তাই মটকা মেরে পড়ে থাকব। নীচের বার্থ হলে পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাব , অন্ধকারের ঘনত্ব থেকে বুঝে নেব ট্রেন কত লেট ( ঠিকঠাক সময়ে চললে সে ট্রেন অন্তত ভারতীয় নয় ) । লোকজন সারি বেঁধে দরজার কাছে জড়ো হতে থাকবে। যাদের সঙ্গে জিনিস বেশী তাদের উৎকণ্ঠাও বেশী। দূরপাল্লার ট্রেন সাধারণত নির্দিষ্ট কিছু প্ল্যাটফর্মেই আসে , তাই প্ল্যাটফর্মের নম্বর আন্দাজ করতে পারার বাহাদুরি এখানে খাটবে না। ট্রেনের এক একটা কামরা প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে থাকবে , আ র দক্ষ অভিজ্ঞ মালবাহীরা লাফ দিয়ে উঠেই দরদাম করতে শুরু করে দেবে। দু - পাঁচ টাকা নিয়েও দর হবে   বোধহয়।  শিল্প যত সূক্ষ্ম হয় ততই তার কদর বেশী ।   আমিও এর মধ্যে চোখটোখ কচলে উঠে বসব। অত রাতে " মন্দ্রিত করিয়া তোলে জীবনের মহামন্ত্রধ্বনি"   এইসব ভেবেটেবে মন ভালো হয়ে যাবে।    সকলে যখন সমস্ত মালপত্রের সঙ্গে দলের বাদবাকিদের গুনে নিতে ব্যস্ত , ট্রেন থেকে নেমে আমি চলমা...