জ্বরের ঘোরে সবকিছু অন্যরকম লাগে। কপাল জুড়ে কাঠকয়লার উনুন। ওমের বদলে ছ্যাঁকা। মর্গের মতো ভয়াল ঠান্ডা হাতপায়ের তালু। লক্ষণ সুবিধের নয়।
ইন্দ্রিয়ের আশেপাশে শেকল পড়ে গ্যাছে। অবসাদের চেয়েও ভারী। বা শান্তিনিকেতনী শাল। আরো ওজনদার। শাল বলতে আবার বনেদী কাঠের কথা মনে আসে। নিরক্ষীয় বর্ষাপ্রবণ অঞ্চলের আদিম মহারণ্য। ঘন, অন্ধকার। কারাগারের কুঠুরির মতো। চেনা আসবাব, দৈনন্দিন ব্যবহার্য সালভাদর দালির চিত্রকল্পের মতো, ধনুষ্টঙ্কারের যন্ত্রণার মতো গলে পড়তে থাকে এঁকেবেঁকে। সাততলার জানলার জাল দিয়ে রাতের নাগরিক আকাশ বা রাজপথ অলস আলকাতরার মতো কালো মনে হয়। ঘর গরম রাখার যন্ত্রে একঘেয়ে আওয়াজ। শ্রুতিনির্বন্ধ। ঝিঁঝির ডাকের মত আচ্ছন্ন লাগে। ঘর্মক্লান্ত গরমের দিনে পুরোনো পাখার আওয়াজে যেমন ঝিম ধরে আসতো। বেসিনে জল পড়ার শব্দ শুনে নোঙর মাস্তুল ডিঙি নৌকার কথা মনে পড়ে। ইন্দ্রনাথের কথা, হাকলবেরি ফিনের কথা, ফটিকচাঁদের কথা। অপক্ক হাতে দিনান্তের সৈকতে তাজা মাছ কেনাবেচার প্যাস্টেল ছবি আঁকার কথা। খিদিরপুর ডকে প্রথমবার বাণিজ্যিক জাহাজ দেখার কথা। সুদৃশ্য বজরায় অমলের সাথে জমিদারবাবুর বোঝাপড়া আর প্রতিশ্রুতির কথা। ইস্কুলের হস্তশিল্পশিক্ষায় মেজমামার আঁকা ঝোড়ো আকাশের প্রেক্ষাপটে বিলাসবহুল ক্রুজের ক্যানভাস দিয়ে দূরদর্শনের পর্দা বানানোর কথা। ডায়মন্ড হারবারে ভোরবেলার স্নিগ্ধ জেটি জুড়ে রূপকথার মত নীলাভ সবুজ মাছ ধরার জাল বিছিয়ে পড়ে থাকার কথা। এই এত স্মৃতির আগলহীন শব্দে আমার কানে তালা ধরে যায়। যাদের রেডিও নেই, আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানবার উপায় নেই, সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে যারা আর বাড়ী ফেরে না তাদের কী হবে? আমারও তো গতকাল অবধি 'ওয়েদার অ্যাপ' ছিল না কোনো।
জল বিস্বাদ লাগে। মধুও। সাধ করে রাতজেগে বানানো চৈনিক রাজভোগ পানসে মনে হয়। আমার সমান উচ্চতার ফ্রিজে জমে থাকা বিপুল খাদ্যাখাদ্যের সম্ভার দেখে পৌরসভার আবর্জনার গাড়ীর মতো নিরাসক্ত লাগে। আপেলসেদ্ধ আর ট্যালট্যালে মাটন স্ট্যুয়ের জন্য হ্যাংলামি করতে ইচ্ছে করে। খামোখা বাঁশপচা স্যাঁতসেঁতে গন্ধ ধাক্কা মারে নাকে। শুকিয়ে ঝরে যাওয়া মরে যাওয়া দিগভ্রান্ত অগোছালো স্বপ্নের ভ্রূণের ইঙ্গিত। সাজানো বাগানে যেভাবে পরিমিত জল ছিটিয়ে ঘাস ছাঁটা হয় আর কী। ঘরছাড়া শরণার্থীর সংকুচিত ময়লা পুঁটলির মতো কুঁকড়ে থাকা নিজের কাঠামোটাই নিজের বলে বিশ্বাস করতে সন্দেহ হয়। স্নায়ুতন্ত্রে তখন বিপ্লব। বিপদঘন্টা বেজেছে।
দুগ্গার জন্যে আমার মায়া ছিল খুব। জ্বর হলেই তাই সংশয়। সারবে তো? এ পোড়ার দেশে ঠিকঠাক রেলগাড়ী পর্যন্ত নেই।
নিয়ম করে জলপট্টি দিলে এত ভুল বকতুম না। যাকগে। প্রলাপও একপ্রকার গদ্যছন্দের কবিতা।
আমার অ্যালার্মে বনমোরগের ডাক। সকালবেলার তরুণ রোদ্দুরে যদিও তার চেয়ে বেশী সম্ভাবনা থাকে, ভরসা থাকে। জ্বর আসলে একটা অপরিপূর্ণ অধ্যায়। দুই কামরার মাঝের অস্থির ভেস্টিবিউল। নবজন্ম যেভাবেই হোক, শূন্য থেকে শুরু করবার নেশা এত সহজে যাবার নয়।
Comments
Post a Comment