বাংলা শব্দে গোলগাল একটা ব্যাপার আছে। যেমন অক্ষর, তেমনি ধ্বনি। মাত্রা টেনে বর্ণমালা গাঁথবার রীতি দেবনাগরীতেই ছিল। কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত তীক্ষ্ণতার বদলে বাংলা অক্ষরে যা আছে তা হল কোমলতা, স্নিগ্ধতা, শান্ত নিবিড় একটা ভাব। শাপলার ডাঁটা, ফলসার থোক, শালিধানের চিঁড়ে বা কুবোপাখির ডাক ভাবলে যেমনটা হয়। সংস্কৃত শব্দে যুক্তাক্ষরের ঝঙ্কারে আভিজাত্য আছে, দৃপ্ত গৌরব আছে, প্রচ্ছন্ন অহংও বুঝি আছে। বাংলায় সেই যুক্তবর্ণকে বেণীপুতুলের মত-মেটে কুঁজোর মত-কেঠো ঘোড়ার মত গড়েপিটে-ছেঁচে-ডেবে নেওয়া হয়েছে; যাতে ধার কম, স্বরের আধার বেশী। তাই ব-ম-য-ফলায় (যেমন- নিঃস্ব, পদ্ম, সখ্য ইত্যাদি) স্বতন্ত্র বর্ণের আঘাতের বদলে দ্বিত্বব্যঞ্জনে জিভকে আরাম দেবার একটা আলসে চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। আলসে অবশ্য কোঠাবাড়ির ছাদেরও হয়, যেখানে নুনহলুদ ছোপ ফুলছাপা শাড়ির পাশে আচারের বয়াম ঝিমোয়। যেমন অক্ষর, তেমনি ধ্বনি। এঁটেল মাটির মত ভিজে ভিজে, হেঁটে গেলে যাতে পদচিহ্ন পড়ে। তার ওপর দিয়ে ধুলো উড়িয়ে টগবগিয়ে ঘোড়সওয়ার যায় না, পদাতিক কাহারের কাঁধে পালকি যায় দুলকি চালে। তা বলে কি একেবারেই তেজ নেই? ঠ্যাঙাড়ের পাব্ড়া, ডাকাতের রণপা, লেঠেলের সড়কিতে হুঙ্কার নেই? শেয়ালকাঁটার খোঁচা আর জলবিছুটির ছ্যাঁকা নেই? আছে। অসির চেয়ে মসী বড়। খাগের কলম আর খ্যাংরা ঝাঁটা উভয়েরই জোর আছে। নিজের নিজের জায়গায়। সর্ষপের ঝাঁঝ আছে, বেতসের বাজ আছে। বারুদখানি যাতে মেরুদণ্ডহীনতায় স্যাঁতস্যাঁতে না হয়ে যায়, তাই বাইরে থেকে মিঠে রাংতার একটি মোড়ক বাঁধা। লাল শালুতে মুড়ে যেমনি করে সওগাত আসে, বা শালপাতার চাঙারিতে মিষ্টান্ন। রেলগাড়ীর কামরায় একবার এক ধর্মপ্রাণা তামিল প্রৌঢ়া, দীর্ঘ চল্লিশ বছর কর্মসূত্রে চিত্তরঞ্জনে থাকবার সময় তালিম নিয়ে নিয়ে নজরুলগীতি যার আত্মস্থ, ঝরঝরে বাংলায় বলেছিলেন, তোমরা তো লক্সমিকে তো বলো লোক্খি। কী নরমপাকের ভাষা তোমাদের! একদম গুড়ের নাড়ুর মতন।
অমন যত্নের ধন, আগলে রাখবারই জিনিস। লক্ষী অর্থে যে ধান, তার ডগায় এখন বুলবুলি আর ছাতারের ভিড়। খাজনার চেয়ে গাজনের বাজনা বেশী। অধিকন্তু দোষায়, অধিকন্তু দোষায়...
Comments
Post a Comment