।১।
বিনোদিনীর ঘুম ভাঙে ভোরবেলায়। ছোট্টবেলাকার অভ্যেস। গেরামে বেড়ে উঠলে যেমনটি হয়। সেই যে গো, গাঁয়ের নামটি অঞ্জনা আর নদীর নামটি খঞ্জনা। ভাদ্দরমাস পেরোল কি পেরোল না, সেখেনে ভোরের দিকে হিম পড়ে। আর সারারাত ধরে টুপটাপ ঝরে পড়ে শিউলি। তার বুকের কাছটা ভোরের সুয্যির মত টকটকে কমলা। এতো সন কেটে গেল, সেই শিরশিরে হাওয়াটুকু রয়ে গেছে অমলিন। আর আছে বালিকাবেলার কড়ি ও কোমল। বিনোদিনী, আর তার শিউলিফুল পাতানো সই, স্নেহলতা। তাদের কোঁচড় ভর্তি শিশিরভেজা ফুল। ঘাটের কাছে ছলাৎ ছল, গল্প বলে নদীর জল। এমনি সময় নাম না জানা কোনো পাখি ডেকে উঠলেই বিনোদিনীর অবুঝ মন উথালপাথাল করে ওঠে...
।২।
নতুন পাড়ায় আসার পর থেকে ভাবনার একটাও বন্ধু হয়নি। উফ, এরা আবার কীনা পাড়াকে বলে সোসাইটি। ভাবনা ওদের চেয়ে ঢের বেশী ইংলিশ স্টোরিজ পড়ে, তাই বলে কি ওরকম থেমে থেমে বেঙ্গলি বলে? এমা, না না, বেঙ্গলি না, বাংলা। ওদের পাশের ফ্ল্যাটের দিদুন কেমন মিষ্টি মিষ্টি বাংলা বলে, ওর মা তো অমনি বলে না। দিদুন বলে কিনা, মা তোমার রাতদুকুরে বাড়ী ফেরে, কাজের কত চাপ বলো দিকিনি। হিহি। দুকুর মানে নাকি দুপুর। কীসব। দিদুন ওর সঙ্গে কত গল্প করে, সেসব ঠিক গল্পের বইয়ের মতো নয়। দিদুনের ভাষায় 'গপ্পগাছা'। দিদুনের গ্রামে ঝুপ করে সন্ধে নামার গপ্প, এলোঝেলো শাকভাতের গপ্প, হাটবারের গপ্প, মেঠো মানুষের রোজকার বেঁচে থাকার গপ্প। দিদুন বলেছে, ইশকুলে কী আর সব শেখা যায় রে দিদিভাই! তা বটে। ভাবনা ঠিক করেছে, এবার শীতের ছুটি পড়লেই সকাল সকাল ভালো মেয়ের মত সব পড়াশোনা সেরে নিয়ে ও মায়ের সঙ্গে বসবে গপ্পগাছা করতে...
।৩।
হাতভর্তি বাজার নিয়ে দ্রুতপায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে ইরা। একহাতে এসপ্তাহের খাবারের জোগাড়, অন্যহাতে একতাড়া পূজাবার্ষিকী। আজকাল পত্রিকাগুলো বের হয় পুজোর প্রায় একমাস আগে। একদিকে সুবিধা, সময় নিয়ে শেষ করা যায়। উৎসব কি আর একদিনের! এই যে শারদীয়া আকাশের আলো আলো ভাব, এও তো একপ্রকার আনন্দযাপন। অবশ্য ইরার কাছে আপাতত এসবই বিলাসিতা। সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে ধাতস্থ হতে এখনো অনেক দেরী। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর পর এনজিওর কাজকর্ম সেরে উঠতে কখন বেলা গড়িয়ে যায়, ওর খেয়াল থাকে না। তবু ভালো। রাত করে বাড়ী ফেরার জন্য ইরার চরিত্র নিয়ে এখানে কেউ বাঁকা মন্তব্য করে না। অন্তত সরাসরি নয়। বনেদি শ্বশুরবাড়ীর মখমলি আরাম ও তো আর এমনিই ফেলে আসেনি। মাঠেঘাটে বেহায়ার মত সোশ্যাল অ্যাক্টিভিজম না কী ছাইপাঁশ করে বেড়ানোর অপরাধে ইরার সংরক্ষণশীল বাপমায়ের সঙ্গে যোগসূত্র ছিঁড়ে গেছিল অনেক আগেই। সে আর কী করা। অকারণ দুয়োয় দুয়োয় জর্জরিত হবার চেয়ে এই দুয়োরানীর জীবনই শ্রেয়...
।৪।
কে যেন বলেছিল, বাংলার বাতাসে বৈরাগ্য আছে - হাওড়ের ধারে দুদণ্ড বসলে মনে হবে, কী লাভ জীবনে উন্নতির পেছনে ছুটে। এ কথা হাসিনার চেয়ে ভালো কেই বা জানে! আব্বুর আশা ছেল মাইয়াডা বড় হয়ে নামের মান রাখবে। সে গুড়ে বালি। অন্য মাইয়াগো দ্যাখো, এ বয়সে কীনা আম্মির হাতে হাতে গেরস্থালির কাজ শিখবে, তা নয় - সারা দিনমান জবুথবু হয়্যা বইস্যা থাকে। কেমনধারা চাউনি। মফস্সলের লোকে ফিসফিসায়, হাবাগোবা মাইয়া। আম্মি য্যানো কিছু একটা বোঝে, কিন্তু মুখ ফুটে কইতে সাহস করে না। হাসিনার অবশ্য এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। ঠিক করে তুলিকলম ধরতে পারে না, দুকথা বলতে সাতবার ঠোক্কর খায় - তাই পাঠশালার পাট চুকে গ্যাছে কবে। তাতে কী। ব্যাঙাচির ঝাঁক বলো বা কাঠপিঁপড়ের বরকন্দাজ - ওদের কাছে হাসিনা কম শেখে বুঝি! এই যে সেদিন বুড়ী বেনেবৌ ওকে ডেকে বলল, বেশ ডাগরটি হয়েছিস লো! শুনে কি ওর গালদুটো কামরাঙার পানা টুকটুকে হয়ে ওঠেনি? ইচ্ছে হয়নি চুনসুরকির বাড়ী ছেড়ে খড়কুটোর বাসা বাঁধতে? যার হৃৎকোঠরে প্রকৃতির বসত, তার আবার ঘর কোথায় রে পাগল! চারিদিকে এত প্রাণের উচ্ছ্বাস, উদ্দাম স্পন্দন - এই বিপুল আয়োজন ছেড়ে সে যায় কোথায়!
।৫।
চিন্ময়ীর সঙ্গে ইরার আলাপ এনজিওর সূত্রে। ইরার বিবাহবিচ্ছেদ, ওর পাঁচবছুরে মেয়েকে নিয়ে নতুন ফ্ল্যাটে আসা, শূন্য থেকে তিল তিল করে সংসার গড়ে তোলা - এই সব কিছুর সাক্ষী ও সহমর্মী থেকেছে চিন্ময়ী। শরিকী সম্পত্তি ভাগাভাগির সময় চিন্ময়ী ও তার মুখচোরা স্বামীর ঘাড়ে চিন্ময়ীর সদ্যবিধবা শাশুড়িকে একরকম চাপিয়ে দেওয়া হয়। বিনোদিনী অবশ্য দাপুটে মানুষ, জমি থেকে তৈজষপত্র, কোনোকিছুর হিসেব বুঝে নিতে ছাড়েননি। সেকালের হলেও তিনি সেকেলে নন। কিশোরী বয়সে বাপপিতেমোর ঘর ছেড়েছেন, প্রৌঢ় বয়সে শ্বশুরের ভিটে ছাড়তেই বা আর ক্ষতিটা কী! লোকে যতই দেশকে মা বলে আদিখ্যেতা করুক, মেয়েদের যে কোনো দ্যাশ নাই, তা তিনি বিলক্ষণ জানেন। দোষ কী তাঁর ছিল না? বাঁজা বলে এককালে চিন্ময়ীকে গালমন্দ করেননি তিনি? সময়ের জলে কিছু পাপদাগ বুঝি ধুয়ে যায়। এই ফ্ল্যাটে আসার কয়েকবছরের মধ্যে পথদুর্ঘটনায় চিন্ময়ীর স্বামীর মৃত্যুর পর বিনোদিনী বা চিন্ময়ী, কেউই অবশ্য বৈরিতার দাগ মোছবার চেষ্টা করেনি। চিন্ময়ীর এনজিওতে ব্যস্ততা বেড়েছে, বিনোদিনী একাকীত্ব কাটাতে পাশের ফ্ল্যাটের খুকির সঙ্গে ভাব জমিয়েছেন। এই মিঠেকড়া জীবনে দুই সমান্তরাল পরিবার কেমন করে মিলেমিশে গ্যালো তা ভাবনা আর তার দিদুনের কাছে এক আশ্চর্য বিস্ময়...
।৬।
হাসিনাকে দেখে বিনোদিনীর মনে পড়ে স্নেহলতার কথা। ওকে ইরা উদ্ধার করে য়ুনিভার্সিটি থেকে ফেরার পথে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মেয়েটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। নামধাম কিছুই ঠিক করে বলতে পারেনি। ভাঙাচোরা বুলি থেকে ইরা যা বুঝেছিলো, ও বেনেবৌর পরামর্শে বাসা খুঁজতে বেরিয়েছে। এমন মানুষদের নিয়ে নিয়মিত কাজ করার দরুণ ইরা ও চিন্ময়ী কারোরই ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধে হয়নি। ওদের এনজিওতে এদের বিশেষ প্রশিক্ষণের পাশাপাশি বাপমায়েরও কাউন্সেলিং করা হয়। ওরা মেয়েটির অভিভাবককে খুঁজে না পাওয়া অবধি ওকে চিন্ময়ীর কাছে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।
...
ভাবনার সঙ্গে হাসিনার এমন ভাব হয়েছে, দেখে মনে হয় যেন আজন্মের সখী। ওর নামখানি ভাবনাই আবিষ্কার করেছে। মেয়েটা এমনিতে চুপচাপ, কিন্তু মুখশ্রীটি বাঙ্ময়। বিনোদিনী যখন ভাবনার সঙ্গে গপ্পগাছা করেন, হাসিনার মুখে স্নেহলতার ঝাপসা ছবি খেলে যায়। মনে পড়ে, স্নেহলতা সাঁতার জানত না। গাঁ-গঞ্জে লোকে নিজের বিপদ সামলে পারে না, তারা তো আপদ গেলে বাঁচে। মনে পড়ে, জলে ভাসতে ভাসতে পচে যাওয়া স্নেহলতার কাপড়ের টুকরো, কোঁচড় আলগা হয়ে ইতিউতি ছড়িয়ে পড়া বাসি শিউলিফুল। তাদের বুকের কাছে অস্তগামী রবির মত টকটকে কমলা!
Comments
Post a Comment