Skip to main content

আলোকমঞ্জীর

।১।
বিনোদিনীর ঘুম ভাঙে ভোরবেলায়। ছোট্টবেলাকার অভ্যেস। গেরামে বেড়ে উঠলে যেমনটি হয়। সেই যে গো, গাঁয়ের নামটি অঞ্জনা আর নদীর নামটি খঞ্জনা। ভাদ্দরমাস পেরোল কি পেরোল না, সেখেনে ভোরের দিকে হিম পড়ে। আর সারারাত ধরে টুপটাপ ঝরে পড়ে শিউলি। তার বুকের কাছটা ভোরের সুয্যির মত টকটকে কমলা। এতো সন কেটে গেল, সেই শিরশিরে হাওয়াটুকু রয়ে গেছে অমলিন। আর আছে বালিকাবেলার কড়ি ও কোমল। বিনোদিনী, আর তার শিউলিফুল পাতানো সই, স্নেহলতা। তাদের কোঁচড় ভর্তি শিশিরভেজা ফুল। ঘাটের কাছে ছলাৎ ছল, গল্প বলে নদীর জল। এমনি সময় নাম না জানা কোনো পাখি ডেকে উঠলেই বিনোদিনীর অবুঝ মন উথালপাথাল করে ওঠে... 
।২।
নতুন পাড়ায় আসার পর থেকে ভাবনার একটাও বন্ধু হয়নি। উফ, এরা আবার কীনা পাড়াকে বলে সোসাইটি। ভাবনা ওদের চেয়ে ঢের বেশী ইংলিশ স্টোরিজ পড়ে, তাই বলে কি ওরকম থেমে থেমে বেঙ্গলি বলে? এমা, না না, বেঙ্গলি না, বাংলা। ওদের পাশের ফ্ল্যাটের দিদুন কেমন মিষ্টি মিষ্টি বাংলা বলে, ওর মা তো অমনি বলে না। দিদুন বলে কিনা, মা তোমার রাতদুকুরে বাড়ী ফেরে, কাজের কত চাপ বলো দিকিনি। হিহি। দুকুর মানে নাকি দুপুর। কীসব। দিদুন ওর সঙ্গে কত গল্প করে, সেসব ঠিক গল্পের বইয়ের মতো নয়। দিদুনের ভাষায় 'গপ্পগাছা'। দিদুনের গ্রামে ঝুপ করে সন্ধে নামার গপ্প, এলোঝেলো শাকভাতের গপ্প, হাটবারের গপ্প, মেঠো মানুষের রোজকার বেঁচে থাকার গপ্প। দিদুন বলেছে, ইশকুলে কী আর সব শেখা যায় রে দিদিভাই! তা বটে। ভাবনা ঠিক করেছে, এবার শীতের ছুটি পড়লেই সকাল সকাল ভালো মেয়ের মত সব পড়াশোনা সেরে নিয়ে ও মায়ের সঙ্গে বসবে গপ্পগাছা করতে...
।৩।
হাতভর্তি বাজার নিয়ে দ্রুতপায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে ইরা। একহাতে এসপ্তাহের খাবারের জোগাড়, অন্যহাতে একতাড়া পূজাবার্ষিকী। আজকাল পত্রিকাগুলো বের হয় পুজোর প্রায় একমাস আগে। একদিকে সুবিধা, সময় নিয়ে শেষ করা যায়। উৎসব কি আর একদিনের! এই যে শারদীয়া আকাশের আলো আলো ভাব, এও তো একপ্রকার আনন্দযাপন। অবশ্য ইরার কাছে আপাতত এসবই বিলাসিতা। সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে ধাতস্থ হতে এখনো অনেক দেরী। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর পর এনজিওর কাজকর্ম সেরে উঠতে কখন বেলা গড়িয়ে যায়, ওর খেয়াল থাকে না। তবু ভালো। রাত করে বাড়ী ফেরার জন্য ইরার চরিত্র নিয়ে এখানে কেউ বাঁকা মন্তব্য করে না। অন্তত সরাসরি নয়। বনেদি শ্বশুরবাড়ীর মখমলি আরাম ও তো আর এমনিই ফেলে আসেনি। মাঠেঘাটে বেহায়ার মত সোশ্যাল অ্যাক্টিভিজম না কী ছাইপাঁশ করে বেড়ানোর অপরাধে ইরার সংরক্ষণশীল বাপমায়ের সঙ্গে যোগসূত্র ছিঁড়ে গেছিল অনেক আগেই। সে আর কী করা। অকারণ দুয়োয় দুয়োয় জর্জরিত হবার চেয়ে এই দুয়োরানীর জীবনই শ্রেয়...
।৪। 
কে যেন বলেছিল, বাংলার বাতাসে বৈরাগ্য আছে - হাওড়ের ধারে দুদণ্ড বসলে মনে হবে, কী লাভ জীবনে উন্নতির পেছনে ছুটে। এ কথা হাসিনার চেয়ে ভালো কেই বা জানে! আব্বুর আশা ছেল মাইয়াডা বড় হয়ে নামের মান রাখবে। সে গুড়ে বালি। অন্য মাইয়াগো দ্যাখো, এ বয়সে কীনা আম্মির হাতে হাতে গেরস্থালির কাজ শিখবে, তা নয় - সারা দিনমান জবুথবু হয়্যা বইস্যা থাকে। কেমনধারা চাউনি। মফস্সলের লোকে ফিসফিসায়, হাবাগোবা মাইয়া। আম্মি য্যানো কিছু একটা বোঝে, কিন্তু মুখ ফুটে কইতে সাহস করে না। হাসিনার অবশ্য এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। ঠিক করে তুলিকলম ধরতে পারে না, দুকথা বলতে সাতবার ঠোক্কর খায় - তাই পাঠশালার পাট চুকে গ্যাছে কবে। তাতে কী। ব্যাঙাচির ঝাঁক বলো বা কাঠপিঁপড়ের বরকন্দাজ - ওদের কাছে হাসিনা কম শেখে বুঝি! এই যে সেদিন বুড়ী বেনেবৌ ওকে ডেকে বলল, বেশ ডাগরটি হয়েছিস লো! শুনে কি ওর গালদুটো কামরাঙার পানা টুকটুকে হয়ে ওঠেনি? ইচ্ছে হয়নি চুনসুরকির বাড়ী ছেড়ে খড়কুটোর বাসা বাঁধতে? যার হৃৎকোঠরে প্রকৃতির বসত, তার আবার ঘর কোথায় রে পাগল! চারিদিকে এত প্রাণের উচ্ছ্বাস, উদ্দাম স্পন্দন - এই বিপুল আয়োজন ছেড়ে সে যায় কোথায়!
।৫। 
চিন্ময়ীর সঙ্গে ইরার আলাপ এনজিওর সূত্রে। ইরার বিবাহবিচ্ছেদ, ওর পাঁচবছুরে মেয়েকে নিয়ে নতুন ফ্ল্যাটে আসা, শূন্য থেকে তিল তিল করে সংসার গড়ে তোলা - এই সব কিছুর সাক্ষী ও সহমর্মী থেকেছে চিন্ময়ী। শরিকী সম্পত্তি ভাগাভাগির সময় চিন্ময়ী ও তার মুখচোরা স্বামীর ঘাড়ে চিন্ময়ীর সদ্যবিধবা শাশুড়িকে একরকম চাপিয়ে দেওয়া হয়। বিনোদিনী অবশ্য দাপুটে মানুষ, জমি থেকে তৈজষপত্র, কোনোকিছুর হিসেব বুঝে নিতে ছাড়েননি। সেকালের হলেও তিনি সেকেলে নন। কিশোরী বয়সে বাপপিতেমোর ঘর ছেড়েছেন, প্রৌঢ় বয়সে শ্বশুরের ভিটে ছাড়তেই বা আর ক্ষতিটা কী! লোকে যতই দেশকে মা বলে আদিখ্যেতা করুক, মেয়েদের যে কোনো দ্যাশ নাই, তা তিনি বিলক্ষণ জানেন। দোষ কী তাঁর ছিল না? বাঁজা বলে এককালে চিন্ময়ীকে গালমন্দ করেননি তিনি? সময়ের জলে কিছু পাপদাগ বুঝি ধুয়ে যায়। এই ফ্ল্যাটে আসার কয়েকবছরের মধ্যে পথদুর্ঘটনায় চিন্ময়ীর স্বামীর মৃত্যুর পর বিনোদিনী বা চিন্ময়ী, কেউই অবশ্য বৈরিতার দাগ মোছবার চেষ্টা করেনি। চিন্ময়ীর এনজিওতে ব্যস্ততা বেড়েছে, বিনোদিনী একাকীত্ব কাটাতে পাশের ফ্ল্যাটের খুকির সঙ্গে ভাব জমিয়েছেন। এই মিঠেকড়া জীবনে দুই সমান্তরাল পরিবার কেমন করে মিলেমিশে গ্যালো তা ভাবনা আর তার দিদুনের কাছে এক আশ্চর্য বিস্ময়... 
।৬। 
হাসিনাকে দেখে বিনোদিনীর মনে পড়ে স্নেহলতার কথা। ওকে ইরা উদ্ধার করে য়ুনিভার্সিটি থেকে ফেরার পথে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মেয়েটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। নামধাম কিছুই ঠিক করে বলতে পারেনি। ভাঙাচোরা বুলি থেকে ইরা যা বুঝেছিলো, ও বেনেবৌর পরামর্শে বাসা খুঁজতে বেরিয়েছে। এমন মানুষদের নিয়ে নিয়মিত কাজ করার দরুণ ইরা ও চিন্ময়ী কারোরই ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধে হয়নি। ওদের এনজিওতে এদের বিশেষ প্রশিক্ষণের পাশাপাশি বাপমায়েরও কাউন্সেলিং করা হয়। ওরা মেয়েটির অভিভাবককে খুঁজে না পাওয়া অবধি ওকে চিন্ময়ীর কাছে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।            
...
ভাবনার সঙ্গে হাসিনার এমন ভাব হয়েছে, দেখে মনে হয় যেন আজন্মের সখী। ওর নামখানি ভাবনাই আবিষ্কার করেছে। মেয়েটা এমনিতে চুপচাপ, কিন্তু মুখশ্রীটি বাঙ্ময়। বিনোদিনী যখন ভাবনার সঙ্গে গপ্পগাছা করেন, হাসিনার মুখে স্নেহলতার ঝাপসা ছবি খেলে যায়। মনে পড়ে, স্নেহলতা সাঁতার জানত না। গাঁ-গঞ্জে লোকে নিজের বিপদ সামলে পারে না, তারা তো আপদ গেলে বাঁচে। মনে পড়ে, জলে ভাসতে ভাসতে পচে যাওয়া স্নেহলতার কাপড়ের টুকরো, কোঁচড় আলগা হয়ে ইতিউতি ছড়িয়ে পড়া বাসি শিউলিফুল। তাদের বুকের কাছে অস্তগামী রবির মত টকটকে কমলা!







































Comments

Popular posts from this blog

হে সই-সব,

আমিও যে কোনোকালে শিশু ছিলাম, আর প্রতিটি দিন বাঙ্ময় শিশুদিবস ছিল, তার প্রমাণ এই নিম্নোল্লিখিত 'কবিতা'গুচ্ছ।  জীবনবিমার কোম্পানি প্রতি বছর একটা করে ডাইরি দিত, কীজানি কার বারোমাস্যা লিখবার প্রেরণা। তার পাতায় পাতায় রীতিমত তারিখ দিয়ে, চার-পাঁচ লাইন জুড়ে জুড়ে ঈগলের ঠ্যাঙের মত হাতের লেখায় আমি হিজিবিজি জমিয়ে রাখতাম। আবার ভাবতুম পেন্সিলের কোম্পানির নাম কেন বেছে বেছে অপ্সরা বা নটরাজ হয়, আর খাতার কোম্পানি গুডবয়। তখন ধারণা ছিল, পৃথিবীর (একেবারে বিশ্বস্তরে না ভাবলে ঠিক সেই গুরুত্বটা অনুধাবন করা মুশকিল হয়ে যেত) স-ম-স্ত কবিতাই আট পংক্তির। ফলতঃ, সেই সাড়ে চার বছর বয়সে মৌলিক কিছু একটা লেখবার চেষ্টা করে দেখা গেল, "উঠল বাউল সকালেতে একতারাটি নিয়ে, একতারাটি পরের দিনই হায়রে, ভেঙে গিয়ে সে ভাঙা মনে কাঁদতে গেল বনের ধারে গিয়ে- " ছ'লাইনের বেশী এগোল না। এর পরে কী হওয়া উচিৎ কিছুতেই বুঝতে পারলাম না। আমার লেখা প্রথম 'কবিতা' একটি সার্থক ছোটগল্প হতে হতেও হল না।   এর পরেরটা সম্ভবত সদ্য উপেন্দ্রকিশোর পড়বার ফল। প্রথম শ্রেণীতে পড়তে বাংলা আর ইংরেজি ক্ল...

ল্যাদকথন: একটি শনিবাসরীয় চলভাষালাপ

[সময়কাল ও স্থান: অপ্রাসঙ্গিক। ল্যাদ স্থানকালাতীত।]  আমি: হ্যাঁ বলো। মা: কী করছিস? আমি এই একটু দুধচা করলাম, চিনিছাড়া। [স্লা......র্প]  (রোজ এইভাবেই কথোপকথন শুরু হয়)  আমি: এই একটু লেবুচা আর ল্যাদ খাচ্ছি। মা: অ্যাঁ! কী খাচ্ছিস? আমি: ল্যাদ, ল্যাদ।  মা: (কীরকম একটা দ্বিধান্বিত গলায়) বুঝতে পারছিনা। (ঘাড় ঘুরিয়ে বাবাকে) টিভিটা কমাও না! সারাদিন চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খবর দেখেই যাচ্ছে! তুমুন একটা নতুন খাবারের নাম বলল, ঠিক করে শুনতেই পেলাম না।  আমি: !!!!!!! মা: (এবার আমার দিকে ফিরে) হ্যাঁ বল।  আমি:  নতুন খাবার আবার কী? বললাম তো ল্যাদ।  মা: ও! আমেরিকান খাবার?  আমি: উফফ এতে আমেরিকান কোত্থেকে এল? আশ্চর্য্য! ল্যাদ জানো না? মা: (খচে গিয়ে) তোরা আজকাল কী খাস কী বলিস আমি বুঝতে পারি না। বিদেশী খাবারের নাম আমি কীকরে জানব?  আমি: বারবার বলছি এটা খাবার না। ল্যাদ। বুঝেছো? লয়ে যফলা আকার - ল্যাদ।  মা: (ভুরু কুঁচকে) মানে? আমি: ল্যাদ মানে ল্যাদ। এইটা না বোঝার কী আছে?  মা: (ভীষণ কাঁইমাই করে) ধুর আমি বুঝতে পারছি না। আমি কি অ...

খুকির প্রত্যাবর্তন, ও ধন্যবাদগাথা

সেই সময়ের কথা। যখন পাশের পাড়াকে মনে হত পৃথিবীর শেষ প্রান্ত, আর মাসিক পত্রিকার শিশুবিভাগে কাঁচাহাতের গল্প-কবিতা লিখে পাঠাবার সময় বাদামী খামের বাঁদিকে গোটা গোটা অক্ষরে লিখতাম "প্রযত্নে.. বাবার নাম"। যখন যাবতীয় সৃষ্টিশীল শিল্পচর্চার বিপরীতে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানকে মনে হত গম্ভীর প্রাণহীন ব্যাপারস্যাপার; অন্যদিকে কল্পবিজ্ঞান আর খবরের কাগজে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কথা পড়ে রুশদেশী উপকথার অজানি-দেশের-না-জানি-কী এর মত অদ্ভুত ঘোরলাগা রোমাঞ্চ হত। তালগোল পাকিয়ে যেত সব। যখন বিদেশ মানে আমার কাছে বাংলার বাইরের সমগ্র বিশ্ব - কোনোকালেই যার ধারেকাছে পৌঁছানো হবে না আমার। এইসব ছাইপাঁশ ভাবতে ভাবতে যখন শীতের নিস্তব্ধ দুপুর বা গরমের ভ্যাপসা বিকেলে স্কুলের বারান্দায়-পার্কের মাঠে এমনকি জনবহুল বাজারহাটেও কেমন করে যেন নিজের মধ্যে ভীষণভাবে একা হয়ে যেতাম। অন্তরীপের মত।  তারপর, জীবন গিয়েছে চলে একটি দশক পার। যেসব মানুষের সাথে প্রতিদিন কথাবার্তা হয়, যাদের ওপর আমার দৈনন্দিন যাপন অনেকখানি নির্ভর করে থাকে, সেইসব মুখ বদলেছে। নতুন মুখের ভিড়ে ছোট্ট...

আলু-থালু

মেয়েটিকে একলা দেখে প্রৌঢ়া সহযাত্রিণী শুধোলেন, তাঁদের পরিবারের সঙ্গে রাতের খাবার ভাগ করে খেতে তার কোনো আপত্তি আছে কীনা। বাড়ী থেকে বানিয়ে আনা গরম খাবার, একেবারেই সাদামাটা; তবে সঙ্গে বাচ্চা ও বয়স্ক মানুষ আছে- তারা প্যান্ট্রির হাবিজাবি খেতে পারেনা। আর স্টেশনে দাঁড়ালেই খুচরো ভাজাভুজি মুখরোচক যা বিক্রি করতে আসে তার গুণমান তো কহতব্য নয়। একা মানুষের অবশ্য রান্না করে আনা ভারী ঝক্কি।    এর আগে মেয়েটিকে নিয়ে একপ্রস্থ আলোচনা হয়েছে ট্রেনের কুপে। ঢলঢলে টিশার্ট আর অনেকগুলো পকেটওয়ালা প্যান্ট, উবুঝুঁটি, মশমশে কেডস, ঢাউস ব্যাগপত্তর, তার ওপর এই দেড়দিনের দীর্ঘ যাত্রায় সঙ্গীহীন - এমন অসৈরণ ব্যাপার তাঁদের ছেলেবেলায় দেখা যেত না। আধুনিক না ছাই! ভয়ডর নেই মনে - সংস্কারের ঘটশ্রাদ্ধ করে ছেড়েছে। আর খাবারেরও বলিহারি - কীসব বার্গার-চিপ্স-আলুভাজা হ্যানাত্যানা! এইজন্যই অমন ঘাড়েগর্দানে একাকার। মেয়েমানুষ নয় একটু ভারী চেহারা হওয়া ভালো, তা বলে এতটা! মেয়েটি হেডফোনের আড়াল থেকে গুঞ্জনের আভাস পেয়েছে, আর করুণায় হেসেছে। সনাতনী আর সেকেলের মধ্যেকার কয়েক যোজন দূরত্ব যারা দেখতে পায়নি, তাদের অভিধ...

অসংলগ্ন

জ্বরের ঘোরে সবকিছু অন্যরকম লাগে। কপাল জুড়ে কাঠকয়লার উনুন। ওমের বদলে ছ্যাঁকা। মর্গের মতো ভয়াল ঠান্ডা হাতপায়ের তালু। লক্ষণ সুবিধের নয়।  ইন্দ্রিয়ের আশেপাশে শেকল পড়ে গ্যাছে। অবসাদের চেয়েও ভারী। বা শান্তিনিকেতনী শাল। আরো ওজনদার। শাল বলতে আবার বনেদী কাঠের কথা মনে আসে। নিরক্ষীয় বর্ষাপ্রবণ অঞ্চলের আদিম মহারণ্য। ঘন, অন্ধকার। কারাগারের কুঠুরির মতো। চেনা আসবাব, দৈনন্দিন ব্যবহার্য সালভাদর দালির চিত্রকল্পের মতো, ধনুষ্টঙ্কারের যন্ত্রণার মতো গলে পড়তে থাকে এঁকেবেঁকে। সাততলার জানলার জাল দিয়ে রাতের নাগরিক আকাশ বা রাজপথ অলস আলকাতরার মতো কালো মনে হয়। ঘর গরম রাখার যন্ত্রে একঘেয়ে আওয়াজ। শ্রুতিনির্বন্ধ। ঝিঁঝির ডাকের মত আচ্ছন্ন লাগে। ঘর্মক্লান্ত গরমের দিনে পুরোনো পাখার আওয়াজে যেমন ঝিম ধরে আসতো। বেসিনে জল পড়ার শব্দ শুনে নোঙর মাস্তুল ডিঙি নৌকার কথা মনে পড়ে। ইন্দ্রনাথের কথা, হাকলবেরি ফিনের কথা, ফটিকচাঁদের কথা। অপক্ক হাতে দিনান্তের সৈকতে তাজা মাছ কেনাবেচার প্যাস্টেল ছবি আঁকার কথা।  খিদিরপুর  ডকে প্রথমবার বাণিজ্যিক জাহাজ...

বীণা ও বাণী

তথাকথিত আস্তিকতা বলতে যা বোঝায়, কোনোকালেই আমার তা ছিল না। আমাদের ঘরে সন্ধ্যেবেলার শাঁখবাতি নেই, নীলষষ্ঠীর উপোস নেই। ভাস্কর্য আর মৃৎশিল্পের নিদর্শন স্বরূপ বুদ্ধ-খৃষ্ট-নানকের মূর্তি সাজানো আছে। প্রাচীন সাহিত্যের অংশ হিসাবে ধর্মগ্রন্থ আছে। দেশবিদেশের সনাতন লোকাচারের ইতিহাস জানবার, এবং যুক্তিহীন বিশ্বাসজনিত আনুগত্যের অভ্যাসকে অতিক্রম করেও তাকে যথাসম্ভব নিরপেক্ষভাবে সম্মান করার শিক্ষাটুকু আছে। আছে হালখাতায় বাংলা বর্ষপঞ্জী সংগ্রহ। ঈদের বিরিয়ানি আর ফিরনির যুগলবন্দীতে জন্নতলাভ। চৌকাঠে আর ছাদে হেমন্তের শিরশিরে হাওয়া উপেক্ষা করে দীপাবলির মোমবাতি জ্বালানো আছে। আলো ভাগ করে নেবার আকুলতা আছে, আলোয় ফেরবার আর্তি আছে। আর আছে সরস্বতীপুজো, ঘরকুনো মুখচোরা কিশোরীর একমাত্র আপন উৎসব। সহপাঠিনীর ছোট্ট ফোকলা ভাইবোন, চাঁদা চাইতে এসে বানান বলতে গিয়ে ঘাবড়ে যাওয়া পাড়ার সমিতির ছেলেছোকরা, বা নির্বিবাদী গৃহপরিচারিকার অনভ্যস্ত উচ্চারণে শৈশবেই আমার পিতৃমাতৃদত্ত নামের দৈবী উত্তরণ ঘটেছিল। তারপর আর নিজের সারসত্য সন্ধানে বেরিয়ে পড়া ছাড়া উপায় ছিল না। সেই শুরু আজন্মের সারস্বত সাধনার। আমি চিরকাল কমপ্ল্যান আর আধগ্রাস ...

টাঙলা

বাংলা শব্দে গোলগাল একটা ব্যাপার আছে। যেমন অক্ষর, তেমনি ধ্বনি। মাত্রা টেনে বর্ণমালা গাঁথবার রীতি দেবনাগরীতেই ছিল। কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত তীক্ষ্ণতার বদলে বাংলা অক্ষরে যা আছে তা হল কোমলতা, স্নিগ্ধতা, শান্ত নিবিড় একটা ভাব। শাপলার ডাঁটা, ফলসার থোক, শালিধানের চিঁড়ে বা কুবোপাখির ডাক ভাবলে যেমনটা হয়। সংস্কৃত শব্দে যুক্তাক্ষরের ঝঙ্কারে আভিজাত্য আছে, দৃপ্ত গৌরব আছে, প্রচ্ছন্ন অহংও বুঝি আছে। বাংলায় সেই যুক্তবর্ণকে বেণীপুতুলের মত-মেটে কুঁজোর মত-কেঠো ঘোড়ার মত গড়েপিটে-ছেঁচে-ডেবে নেওয়া হয়েছে; যাতে ধার কম, স্বরের আধার বেশী। তাই ব-ম-য-ফলায় (যেমন- নিঃস্ব, পদ্ম, সখ্য ইত্যাদি) স্বতন্ত্র বর্ণের আঘাতের বদলে দ্বিত্বব্যঞ্জনে জিভকে আরাম দেবার একটা আলসে চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। আলসে অবশ্য কোঠাবাড়ির ছাদেরও হয়, যেখানে নুনহলুদ ছোপ ফুলছাপা শাড়ির পাশে আচারের বয়াম ঝিমোয়। যেমন অক্ষর, তেমনি ধ্বনি। এঁটেল মাটির মত ভিজে ভিজে, হেঁটে গেলে যাতে পদচিহ্ন পড়ে। তার ওপর দিয়ে ধুলো উড়িয়ে টগবগিয়ে ঘোড়সওয়ার যায় না, পদাতিক কাহারের কাঁধে পালকি যায় দুলকি চালে। তা বলে কি একেবারেই তেজ ন...

শেষবারের মতো

অ - নে - ক দিন পরে।    হাওড়া স্টেশনে ট্রেন ঢুকবে কিছুক্ষণের মধ্যে। সাঁতরাগাছি পেরোনোর পরেই সকলের একটু একটু করে মালপত্র নামাবার ব্যস্ততা। আমার দুটো মাত্র ছোটো ছোটো ব্যাগ , তাই মটকা মেরে পড়ে থাকব। নীচের বার্থ হলে পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাব , অন্ধকারের ঘনত্ব থেকে বুঝে নেব ট্রেন কত লেট ( ঠিকঠাক সময়ে চললে সে ট্রেন অন্তত ভারতীয় নয় ) । লোকজন সারি বেঁধে দরজার কাছে জড়ো হতে থাকবে। যাদের সঙ্গে জিনিস বেশী তাদের উৎকণ্ঠাও বেশী। দূরপাল্লার ট্রেন সাধারণত নির্দিষ্ট কিছু প্ল্যাটফর্মেই আসে , তাই প্ল্যাটফর্মের নম্বর আন্দাজ করতে পারার বাহাদুরি এখানে খাটবে না। ট্রেনের এক একটা কামরা প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে থাকবে , আ র দক্ষ অভিজ্ঞ মালবাহীরা লাফ দিয়ে উঠেই দরদাম করতে শুরু করে দেবে। দু - পাঁচ টাকা নিয়েও দর হবে   বোধহয়।  শিল্প যত সূক্ষ্ম হয় ততই তার কদর বেশী ।   আমিও এর মধ্যে চোখটোখ কচলে উঠে বসব। অত রাতে " মন্দ্রিত করিয়া তোলে জীবনের মহামন্ত্রধ্বনি"   এইসব ভেবেটেবে মন ভালো হয়ে যাবে।    সকলে যখন সমস্ত মালপত্রের সঙ্গে দলের বাদবাকিদের গুনে নিতে ব্যস্ত , ট্রেন থেকে নেমে আমি চলমা...

পাড়া

ঘর-বারান্দা, বাড়ী, পাঁচিলের চৌহদ্দি। ছোটোখাটো বস্তি। সারিসারি জবরদখল হয়ে যাওয়া সরকারী খাসজমি। রেশন, তেলেভাজা-বইখাতা-বাসন আর মনিহারির দোকান, মুদিখানা, বস্ত্রালয়, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। দুবেলা সব্জী আর মাছের অস্থায়ী বাজার। খেলার মাঠ, পার্ক, বাঁধানো রক, ক্লাবঘর। পুরসভা বা পঞ্চায়েতের ব্লকের ভেতরে একখন্ড রাজনৈতিক সংজ্ঞাহীন অঞ্চল, স্বতন্ত্র সভ্যতা। তথাকথিত আত্মীয়তার ঊর্ধ্বে, নিছক পরিচয়ের সূত্রে গড়ে ওঠা স্বাজাত্যবোধ। পাড়া। সবাই সবার খোঁজ রাখে। পথেঘাটে দোকানবাজারে নিতান্ত সাধারণ বারোমাস্যার আদানপ্রদান। ডিগ্রী পাশ বা চাকরির খবরে স্বস্তি আসে, বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে রক্ষণশীল গুঞ্জন ওঠে, সুস্থসবল সন্তানের জন্মে খুশীর হাওয়া বয়। রাতবিরেতে শ্মশানবন্ধু জোগাড় করতে কখনো বেগ পেতে হয় না। সন্ততিত্যজ্য অশীতিপর বৃদ্ধা, কিঞ্চিৎ মানসিক ভারসাম্যহীন অবিবাহিতা প্রৌঢ়া বা বহুজনের সংসারে এককোণে খুদকুঁড়োর মত পড়ে থাকা স্নায়ুরোগাক্রান্ত যুবকের পারিবারিক ইতিহাস ছাপোষা জনজীবনে দুশ্চিন্তা, সহানুভূতি আর অনিশ্চয়তাবোধের সঞ্চার করে। কেউ বাড়ী বিক্রি কর...