মেয়েটিকে একলা দেখে প্রৌঢ়া সহযাত্রিণী শুধোলেন, তাঁদের পরিবারের সঙ্গে রাতের খাবার ভাগ করে খেতে তার কোনো আপত্তি আছে কীনা। বাড়ী থেকে বানিয়ে আনা গরম খাবার, একেবারেই সাদামাটা; তবে সঙ্গে বাচ্চা ও বয়স্ক মানুষ আছে- তারা প্যান্ট্রির হাবিজাবি খেতে পারেনা। আর স্টেশনে দাঁড়ালেই খুচরো ভাজাভুজি মুখরোচক যা বিক্রি করতে আসে তার গুণমান তো কহতব্য নয়। একা মানুষের অবশ্য রান্না করে আনা ভারী ঝক্কি।
এর আগে মেয়েটিকে নিয়ে একপ্রস্থ আলোচনা হয়েছে ট্রেনের কুপে। ঢলঢলে টিশার্ট আর অনেকগুলো পকেটওয়ালা প্যান্ট, উবুঝুঁটি, মশমশে কেডস, ঢাউস ব্যাগপত্তর, তার ওপর এই দেড়দিনের দীর্ঘ যাত্রায় সঙ্গীহীন - এমন অসৈরণ ব্যাপার তাঁদের ছেলেবেলায় দেখা যেত না। আধুনিক না ছাই! ভয়ডর নেই মনে - সংস্কারের ঘটশ্রাদ্ধ করে ছেড়েছে। আর খাবারেরও বলিহারি - কীসব বার্গার-চিপ্স-আলুভাজা হ্যানাত্যানা! এইজন্যই অমন ঘাড়েগর্দানে একাকার। মেয়েমানুষ নয় একটু ভারী চেহারা হওয়া ভালো, তা বলে এতটা!
মেয়েটি হেডফোনের আড়াল থেকে গুঞ্জনের আভাস পেয়েছে, আর করুণায় হেসেছে। সনাতনী আর সেকেলের মধ্যেকার কয়েক যোজন দূরত্ব যারা দেখতে পায়নি, তাদের অভিধানে সংস্কারের প্রতিশব্দ অচলায়তন।।
প্রৌঢ়া ভেবেছিলেন মেয়েটি প্রত্যাখ্যান করবে। এইসব মেয়েরা একটু নাকউঁচু হয়, ঘরোয়া খাবারদাবার এদের পোষায় না। কিন্তু সকলকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটি নির্দ্বিধায় রাজী হয়ে গেল। শুধু তাই নয়, বড় মিশুকে মেয়ে, অল্পক্ষণের মধ্যেই সবার সঙ্গে দিব্যি ভাব জমিয়ে ফেলল। ছোটদুটি তো রীতিমত দিদি পাতিয়ে ফেলেছে- যা নয় তাই বায়না করছে, সঙ্গে অদ্ভুত সব প্রশ্ন। মেয়েটিও ধৈর্য্যসহকারে উত্তর দিচ্ছে বেশ। গল্পে গল্পে হঠাৎ বাচ্চারা জিজ্ঞেস করে বসল- "দিদি, দিদি, তুমি যে এত্ত এত্ত আলুভাজা খেলে, তোমার পেটব্যাথা করবে না? আমি দাদুভাইয়ের প্লেট থেকে আলুভাজা তুলে খেলে মা কীঈ বকে! তোমার কী মজা, তোমায় কেউ বকছে না!" মেয়েটি হো হো করে হেসে উঠল -"ধ্যাৎ, ওটাকে বলে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। গরম হাওয়ায় সেঁকা আলুর টুকরো। আলুভাজা ওচ্চেয়ে ঢের ভালো খেতে।" এইবার সুযোগ পেয়ে বৃদ্ধ দাদুভাই আসরে যোগ দিলেন, "ওই হল আর কী! যাহা বাহান্ন তাহা তিপ্পান্ন। মোটামুটি ভাজা আলু হলেই হল। হাতের কাছে যা পেয়েছো, ওই নিয়েই খুশী থাকো মা!" মেয়েটিও এদিকে নাছোড়বান্দা, "না না, বললেই হল? মাছ ভাজা আর ফিশফ্রাই কি এক? যেমনতেমন করে আলু ভাজলেই কি আর তাকে কুলীন আলুভাজার মর্যাদা দেওয়া যায়? দেখুন, আমার মতে ঠিকঠাক আলুভাজা মূলত তিন প্রকার।" রান্নাবাটির আলোচনায় প্রৌঢ়া সিদ্ধজিহ্বা, তাই তিনিও এবারে প্রবল উৎসুক হয়ে পড়লেন, "বাবা! তি-ন র-ক-ম! শুনি, সে আবার কেমন?"
মেয়েটি জানলার দিকে পিঠ ফিরিয়ে রেলকোম্পানির দেওয়া বালিশ কোলে নিয়ে বাবু হয়ে গুছিয়ে বসল-
"দেখুন প্রথমেই আসে রাজকীয় আলুভাজার কথা। ঝিরিঝিরি করে কেটে কারিপাতা-শুকনোলঙ্কা-চীনেবাদাম দিয়ে কড়া করে ভাজা। মুচমুচে হবে, অথচ পোড়া বাদামী রং ধরবে না, এই সূক্ষ্ম পরিমিতিবোধই বনেদিয়ানার মাপকাঠি। মাছের মাথা দিয়ে ঘন মুগের ডাল আর বাসকাঠি চালের ভাতের সঙ্গে একবার খেয়ে দেখবেন, কোথায় লাগে তারকাখচিত রেস্তোরাঁর খানদানি মেনু। আর হ্যাঁ, কাঁসাপেতলের থালাবাটিতে পরিবেশন করতে হবে কেমন - নইলে আহার্য্যের অসম্মান হয়, আর মেজাজটাও খোলতাই হয় না।"
এর আগে মেয়েটিকে নিয়ে একপ্রস্থ আলোচনা হয়েছে ট্রেনের কুপে। ঢলঢলে টিশার্ট আর অনেকগুলো পকেটওয়ালা প্যান্ট, উবুঝুঁটি, মশমশে কেডস, ঢাউস ব্যাগপত্তর, তার ওপর এই দেড়দিনের দীর্ঘ যাত্রায় সঙ্গীহীন - এমন অসৈরণ ব্যাপার তাঁদের ছেলেবেলায় দেখা যেত না। আধুনিক না ছাই! ভয়ডর নেই মনে - সংস্কারের ঘটশ্রাদ্ধ করে ছেড়েছে। আর খাবারেরও বলিহারি - কীসব বার্গার-চিপ্স-আলুভাজা হ্যানাত্যানা! এইজন্যই অমন ঘাড়েগর্দানে একাকার। মেয়েমানুষ নয় একটু ভারী চেহারা হওয়া ভালো, তা বলে এতটা!
মেয়েটি হেডফোনের আড়াল থেকে গুঞ্জনের আভাস পেয়েছে, আর করুণায় হেসেছে। সনাতনী আর সেকেলের মধ্যেকার কয়েক যোজন দূরত্ব যারা দেখতে পায়নি, তাদের অভিধানে সংস্কারের প্রতিশব্দ অচলায়তন।।
প্রৌঢ়া ভেবেছিলেন মেয়েটি প্রত্যাখ্যান করবে। এইসব মেয়েরা একটু নাকউঁচু হয়, ঘরোয়া খাবারদাবার এদের পোষায় না। কিন্তু সকলকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটি নির্দ্বিধায় রাজী হয়ে গেল। শুধু তাই নয়, বড় মিশুকে মেয়ে, অল্পক্ষণের মধ্যেই সবার সঙ্গে দিব্যি ভাব জমিয়ে ফেলল। ছোটদুটি তো রীতিমত দিদি পাতিয়ে ফেলেছে- যা নয় তাই বায়না করছে, সঙ্গে অদ্ভুত সব প্রশ্ন। মেয়েটিও ধৈর্য্যসহকারে উত্তর দিচ্ছে বেশ। গল্পে গল্পে হঠাৎ বাচ্চারা জিজ্ঞেস করে বসল- "দিদি, দিদি, তুমি যে এত্ত এত্ত আলুভাজা খেলে, তোমার পেটব্যাথা করবে না? আমি দাদুভাইয়ের প্লেট থেকে আলুভাজা তুলে খেলে মা কীঈ বকে! তোমার কী মজা, তোমায় কেউ বকছে না!" মেয়েটি হো হো করে হেসে উঠল -"ধ্যাৎ, ওটাকে বলে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। গরম হাওয়ায় সেঁকা আলুর টুকরো। আলুভাজা ওচ্চেয়ে ঢের ভালো খেতে।" এইবার সুযোগ পেয়ে বৃদ্ধ দাদুভাই আসরে যোগ দিলেন, "ওই হল আর কী! যাহা বাহান্ন তাহা তিপ্পান্ন। মোটামুটি ভাজা আলু হলেই হল। হাতের কাছে যা পেয়েছো, ওই নিয়েই খুশী থাকো মা!" মেয়েটিও এদিকে নাছোড়বান্দা, "না না, বললেই হল? মাছ ভাজা আর ফিশফ্রাই কি এক? যেমনতেমন করে আলু ভাজলেই কি আর তাকে কুলীন আলুভাজার মর্যাদা দেওয়া যায়? দেখুন, আমার মতে ঠিকঠাক আলুভাজা মূলত তিন প্রকার।" রান্নাবাটির আলোচনায় প্রৌঢ়া সিদ্ধজিহ্বা, তাই তিনিও এবারে প্রবল উৎসুক হয়ে পড়লেন, "বাবা! তি-ন র-ক-ম! শুনি, সে আবার কেমন?"
![]() |
আলুভাজা 😋 |
"দেখুন প্রথমেই আসে রাজকীয় আলুভাজার কথা। ঝিরিঝিরি করে কেটে কারিপাতা-শুকনোলঙ্কা-চীনেবাদাম দিয়ে কড়া করে ভাজা। মুচমুচে হবে, অথচ পোড়া বাদামী রং ধরবে না, এই সূক্ষ্ম পরিমিতিবোধই বনেদিয়ানার মাপকাঠি। মাছের মাথা দিয়ে ঘন মুগের ডাল আর বাসকাঠি চালের ভাতের সঙ্গে একবার খেয়ে দেখবেন, কোথায় লাগে তারকাখচিত রেস্তোরাঁর খানদানি মেনু। আর হ্যাঁ, কাঁসাপেতলের থালাবাটিতে পরিবেশন করতে হবে কেমন - নইলে আহার্য্যের অসম্মান হয়, আর মেজাজটাও খোলতাই হয় না।"
প্রৌঢ়ার মনের বরফ এতক্ষণে গলতে শুরু করেছে। সোৎসাহে বলে উঠলেন, "বাহ্ বাহ্! পুরোনো খাবারের কদর করতে জানো দেখছি। তারপর তারপর?"
মেয়েটি নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বলে চলল - "তারপর ধরুন এই আমাদের মত ব্যস্তবাগীশ কেরানিগোত্রীয় আলুভাজা। মাঝারি দৈর্ঘ্যপ্রস্থের আলুর ফালি সামান্য পেঁয়াজ-কাঁচালঙ্কাকুচি দিয়ে তেল জবজবে করে ভাজা। আপনি আপিস যাবার আগে আতপ চালের ভাত আর সেদ্ধ ডালের সঙ্গে খেতে পারেন, সন্ধ্যেবেলা লাল মুড়ি দিয়ে মেখে নিতে পারেন, বা রাত্তিরে হাতরুটির পাশেও দিব্যি মানিয়ে যায় (পারলে আমার তো দুপুরেও তা-ই চলে, কেনা খাবারের যা দাম!)। মধ্যবিত্তের সব খাদ্যসমস্যার অদ্বিতীয় সমাধান। জামবাটি হোক বা টিপিনকৌটো, আমি কিন্তু স্টিলের বাসন ব্যবহার করি শুধু - রোজকার জীবনে এর চেয়ে বেশী বড়লোকি কারই বা পোষায় বাপু!"
দাদুভাইয়ের ঝট করে মনে পড়ে গেল তাঁর চাকরিজীবনের প্রথমদিকের কথা, "আহা! তুমি তো দেখি খাসা মেয়ে। কবেকার কথা মনে করিয়ে দিলে। সে আমরাও কত কাটিয়েছি ওর'ম সব দিন। তখন গিন্নি আসেননি, আমরা বন্ধুরা থাকি ঘর ভাড়া করে, রন্ধনে লবডঙ্কা সব। তিনবেলা রান্নার মাসির আশীর্বাদে বেঁচে থাকা কোনোরকম। সময় তাহলে কিছুই পাল্টায়নি, কী বল?"
সময় তো আসলে অনেক বদলেছে। আরো কত কী পরিবর্তন হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। দাদুভাইয়ের বয়সে যা নস্ট্যালজিয়া হতে পারত, তা এখনই এই মধ্যতিরিশে মেয়েটির কাছে অস্বচ্ছ স্মৃতি মাত্র। ট্রেনের জানলার শিকে নাক ঠেকালেই হাওয়ার ঝাপটায় কত কী ভেসে আসে - যেন গতজন্মের কথকতা, নাগালের বাইরের কোনো এক বিমূর্ত যুগ। যখন ভেতর আর বাইরের পৃথিবীর মধ্যে কেবল জানলার গরাদের ব্যবধানটুকুই ছিল - সেই সময়কাল। এলোমেলো অতীতকাল।
"আর যখন প্রচণ্ড গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত, পিঠভর্তি ঘামাচির চোটে মাদুরে চিৎ হয়ে শোওয়া যায় না অবধি - অমৃতের ভাণ্ড নেমে আসতো সানকিতে ঝরানো পান্তাভাত, গোটা ছাঁচিপেঁয়াজ আর পাতলা গোলগোল চাকতির মত খোসাশুদ্ধু আলুভাজায়। কলাপাতায় বেড়ে দেওয়া। এক একটা গ্রাসে অখণ্ড আরাম আর প্রশান্তি। শেষবারের জন্য একটু বেশী অনুপাতে পেঁয়াজ আর আলুভাজা রেখে দেওয়া - আঙরাখার পরিতৃপ্তি যেমন।"
স্তম্ভিত সহযাত্রীদের কাছে 'ঢলঢলে টিশার্ট, কার্গো প্যান্ট, পনিটেল, মশমশে কেডস' বেমানান ও অচেনা ঠেকতে লাগে। ... "অবশ্য আমি আজকাল মূলত ফ্রেঞ্চ ফ্রাইই পাই। তাই খাই। যত ইচ্ছে। আর আমায় কেউ বকেও না!" - একটি বিষাদজড়িত হাসি বাতিল কাপড়ের মত ফেলে রেখে মেয়েটি উঠে যায়। জানলায় যে ভান ছিল, আড়াল ছিল - কামরার প্রধান দরজায় সেটুকু পার হয়ে যাওয়া যাবে।
Comments
Post a Comment