আমিও যে কোনোকালে শিশু ছিলাম, আর প্রতিটি দিন বাঙ্ময় শিশুদিবস ছিল, তার প্রমাণ এই নিম্নোল্লিখিত 'কবিতা'গুচ্ছ।
জীবনবিমার কোম্পানি প্রতি বছর একটা করে ডাইরি দিত, কীজানি কার বারোমাস্যা লিখবার প্রেরণা। তার পাতায় পাতায় রীতিমত তারিখ দিয়ে, চার-পাঁচ লাইন জুড়ে জুড়ে ঈগলের ঠ্যাঙের মত হাতের লেখায় আমি হিজিবিজি জমিয়ে রাখতাম। আবার ভাবতুম পেন্সিলের কোম্পানির নাম কেন বেছে বেছে অপ্সরা বা নটরাজ হয়, আর খাতার কোম্পানি গুডবয়। তখন ধারণা ছিল, পৃথিবীর (একেবারে বিশ্বস্তরে না ভাবলে ঠিক সেই গুরুত্বটা অনুধাবন করা মুশকিল হয়ে যেত) স-ম-স্ত কবিতাই আট পংক্তির। ফলতঃ, সেই সাড়ে চার বছর বয়সে মৌলিক কিছু একটা লেখবার চেষ্টা করে দেখা গেল,
"উঠল বাউল সকালেতে
একতারাটি নিয়ে,
একতারাটি পরের দিনই
হায়রে, ভেঙে গিয়ে
সে ভাঙা মনে কাঁদতে গেল
বনের ধারে গিয়ে- "
ছ'লাইনের বেশী এগোল না। এর পরে কী হওয়া উচিৎ কিছুতেই বুঝতে পারলাম না। আমার লেখা প্রথম 'কবিতা' একটি সার্থক ছোটগল্প হতে হতেও হল না।
এর পরেরটা সম্ভবত সদ্য উপেন্দ্রকিশোর পড়বার ফল। প্রথম শ্রেণীতে পড়তে বাংলা আর ইংরেজি ক্লাসের মধ্যেখানে দুম করে লিখে ফেলা। একেবারেই স্বয়মাগত 'কবিতা' যাকে বলে --
"বেগুন গাছে বেগুন ঝোলে
দাদা বোঁটার কান ম'লে
আরো গাছে বেগুন ঝোলে
বৃষ্টি পড়ে পাতার কোলে।
বেগুন গাছে টিকটিকি
সে হল খুব লিকলিকি।। "
এখানে বেগুন ও টিকটিকি কীসের রূপক, না নিতান্তই আক্ষরিক - সে আমি নিজেও জানি না। অবচেতনের গূঢ় ব্যাপার তো, সব হয়তো বোঝবার নয়। তবে ততদিনে আরো কিছু ছড়াটড়া পড়া হয়েছে, ফলে কায়দা করে চার আর দুই লাইন পৃথক স্তবকে লেখবার পাকামিও গজিয়ে গিয়েছে। যদিও অনুপ্রাসের বাইরে তখন কিছু ভাবতে পারতাম না।
তারপর, আরো এক সৌরবৎসর অতিক্রান্ত হল। আমি তখনো সাঁতার শিখিনি, তাই স্রোতের অনুকূলে থাকতে প্রাণপণে প্রকৃতিপ্রেমে জারিত হয়ে কাব্যরচনার সাধনা করে চলেছি। আর কে না জানে, ভরা বাদর হল গিয়ে উচ্চ ফলনশীল ঋতু। একদিন বিকেলবেলা, প্রগলভা হরিণশিশুর মত ছাদে চরে বেড়াচ্ছি, বর্ষার মরসুম বলে মা আদা-চা, মুড়িমাখা আর তেলেভাজা বানাচ্ছে, এমন সময় ঝেঁপে বৃষ্টি এল--
তারপর, আরো এক সৌরবৎসর অতিক্রান্ত হল। আমি তখনো সাঁতার শিখিনি, তাই স্রোতের অনুকূলে থাকতে প্রাণপণে প্রকৃতিপ্রেমে জারিত হয়ে কাব্যরচনার সাধনা করে চলেছি। আর কে না জানে, ভরা বাদর হল গিয়ে উচ্চ ফলনশীল ঋতু। একদিন বিকেলবেলা, প্রগলভা হরিণশিশুর মত ছাদে চরে বেড়াচ্ছি, বর্ষার মরসুম বলে মা আদা-চা, মুড়িমাখা আর তেলেভাজা বানাচ্ছে, এমন সময় ঝেঁপে বৃষ্টি এল--
"বিদ্যুৎ চমকায়
দিলো প্রাণে সাড়া,
বৃষ্টি পড়ে ঝমঝম
অবিরাম ধারা।
গুড়ুম গুড়ুম মেঘ ডাকে
আমায় দেয় চমক,
বৃষ্টি পড়তে বাইরে গেছি
মা-বাবা দেন ধমক।"
অন্তিম লগ্নের ছন্দপতনে চমকাবার কিছু নেই, ও তো প্রত্যাশিত ছিল। বর্ষণ যতখানি জলবায়ুসংক্রান্ত, তার চেয়েও বেশী উপমাবিষয়ক। তাই কাগজের নৌকার হাপিত্যেশ পয়ঃপ্রণালীর অব্যবস্থায় জমা হয়ে থাকে। সত্যিকারের নৌকার পালে যখন হাওয়া লাগে, তখন দূরাগত সওগাতে ছই ভরভরন্ত। দাঁড়ে টান পড়ে ঝপাঝপ, কত বাঁও জল - সে খবর নেই। সারল্যের সুবর্ণ স্বাদ দিগন্তরেখার প'রে বাফ রঙের মত মিলিয়ে যায়।
পুনশ্চঃ: শেষের দুটো ছড়া কোনো এক লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল, ছোটদের উৎসাহ দেবার জন্য যেমন হয়েটয়ে থাকে। যদিও কুলোকে বলে আমার স্মৃতিশক্তি গজেন্দ্রকুমারীর মত, আপাতত পত্রিকার নাম ভুলে গেছি।
Comments
Post a Comment