Skip to main content

অ-লক্ষ্মীমন্ত(র)



বাল্যকালে আমি ভারী চঞ্চল ও বদবুদ্ধির অধিকারিণী ছিলেম। শান্ত নিস্তরঙ্গ জীবন ও পানাপুষ্করিণীতে আমি তেমন পার্থক্য দেখিনে। অত্যধিক প্রশ্রয়ে মালতীলতা কিংবা বনসাইতুল্য হইবার পরিবর্তে অনাদরের আগাছা ও পরিমিত যত্নের উদ্ভিজ্জ হইতেই আমার আগ্রহ বেশী। তদুপরি জন্মসূত্রে মেয়েমানুষ মাত্রেই যে গৃহলক্ষ্মীর ন্যায় অচলা অবলা মৃৎপুত্তলিকা হইবার নিমিত্ত বলিপ্রদত্ত এইরূপ কুশিক্ষা কদাপি পাই নাই বলিয়া দিনে দিনে আমি এক সার্থক হনুমতীরূপে শ্রীবৃদ্ধি লাভ করিতেছিলাম। এতদকাল লৌকিক ও সামাজিক উপাচার বলিয়া যাহাসকল পালিত হইয়াছেতাহার কোনোরূপ যৌক্তিক ব্যাখ্যা পাইবার পূর্বাবধি আমি নিয়মের অনুগামিনী হইতে অপারগ ছিলাম।

যাহাই হউকশাখামৃগের পক্ষে সাধুভাষা অবলম্বন স্বাস্থ্যহানিকর। এতে মাথা ভার হয়ে যায়কিলবিল করতে থাকা দুশ্চিন্তনীয় পরিকল্পনাসমূহ কেমন গৃহপালিত লক্ষ্মীপেঁচার মত গুটিশুটি মেরে বসে। যে গল্প (পড়ুননির্জলা সত্য ঘটনাবলীবলবার জন্য এই ভণিতাসেটাই বরং বলে ফেলা যাক।

বড়দাদার (হনুসংঘের প্রতিষ্ঠাতা) দেওয়া আল্পনা

আমার মায়ের বাড়ীতে (বুঝতে অসুবিধে হলে মামাবাড়ী বা দাদুদিদার বাড়ী বলে ধরে নেওয়া যেতে পারেলক্ষ্মীপুজো হয় মাটির সরায়। তখন পুজো বা পটচিত্রের তাৎপর্য্য নিয়ে আমার মাথাব্যথা ছিল নাতাই খিচুড়ী-লাবড়া-নাড়ু-মোয়া এইসব ভালো ভালো খাবারের তত্ত্বাবধানে আমি স্বেচ্ছায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলাম। সেকালের অট্টালিকায় যেমন হতপাকশালা আর উপাসনাগৃহের মধ্যে এক উঠোন দূরত্বতার ওপর লালমেঝের ঠাকুরদালানে চালের গুঁড়ি দিয়ে মনমোহিনী সব আল্পনাসেইসব পেরিয়ে পেরিয়ে বারবার নৈবেদ্য চেখে দেখা ও বিদগ্ধ মতামত দেওয়াসে কী কম হ্যাপাতার মধ্যে একবার কুলুঙ্গি থেকে নামাতে গিয়ে সেই সরা গেল ভেঙে। অনেক সন ধরে ব্যবহৃত সরাতাই আশ্চর্য্য হবার কথা নয়। তবু অমঙ্গলের পূর্বাভাস ভেবে তড়িঘড়ি নতুন সরা কিনে আনা হল। সংসারে ভাঙাচোরা জিনিসের কদর নেইতাই আগের সরা হস্তান্তরিত হল ছোটদের দরবারে। আমাদের কাছে সবই খেলবার বস্তু। তাই আহ্লাদিত হয়ে মামাতো ভাইয়ের ইশকুলের হস্তশিল্পশিক্ষার জন্য কিনে রাখা ফেভিকল দিয়ে সরা মেরামত করবার চেষ্টা চলল। ছিন্নবৃন্তের কোণায় লেগে থাকা কষের মত সরার ফাটল বরাবর আমাদের অদক্ষ জোড়াতালির চিহ্নস্বরূপ আঠার সাদা সাদা দাগ লেগে থাকল। মোটকথা ব্যাপারটা একেবারেই দৃষ্টিনন্দন হল না। নিজেদের ব্যর্থ প্রচেষ্টা লুকোবার জন্য তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে এটা বিসর্জন দিতে হবে। আমরা কেউই কোমলপ্রাণ সরলহৃদয় ছিলাম নাসামান্য মাটির সরার মত পার্থিব বিষয়ে আমাদের আসক্তি থাকবেই বা কীকরেকিন্তু কথা হচ্ছেপ্রচলিত সংস্কারে লক্ষ্মী ততক্ষণই জাগ্রতযতক্ষণ সরা অখন্ড। টুকরো হয়ে যাওয়া সরায় সমৃদ্ধির দেবী নেহাতই রঙতুলির আঁচড়। এখন আমাদের মত অতিবিচ্ছু বালকবালিকার হাতে একাধারে সরা ও শ্রীদেবীর (সক্ষতপুনর্জাগরণ ঘটে যাওয়ায় সবাই যারপরনাই বিস্মিত ও আনন্দিত হল। দুর্বল ধর্মবিশ্বাস আঠার মত রেচনপদার্থে খোঁজে ঈশ্বরচেতনা। তাই অবোধ আমাদের জানিয়ে দেওয়া হল যে এই সরা খুব সাবধানে যত্ন করে গুছিয়ে রাখতে হবেঅন্যথায় দুর্দিনের দুর্দম দুর্বিপাক ও দুর্গতির ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসবে প্রভৃতি। 

আ মোলো যাছিল খেলনাহয়ে গেল কোষাধ্যক্ষা এ কি ভোজবাজি নাকিআমার মধ্যে ততক্ষণে যুগযুগান্তরের অলক্ষ্মীদের অপশক্তি কেন্দ্রীভূত হয়েছেতাই কোমর বেঁধে নিঃশব্দ ভাসানযাত্রার প্রস্তুতি নিয়ে ফেললাম। কনিষ্ঠটি আমারই মন্ত্রশিষ্যতাকে বাগে আনতে বেগ পেতে হল না। বাড়ীতে অনেক মানুষের ভিড়সকলেই উৎসবে কর্মব্যস্ত, তাই আমাদের সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখাও সম্ভব ছিল না। পা টিপে টিপে (অর্থাৎ কর্দমাক্ত ধূলিধূসরিত হাওয়াই চটির বিলাসিতা ত্যাগ করেখিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে একছুট্টে সোজা পুকুরপাড়ে। ... তারপর আর কীসেই অলক্ষিত মাহেন্দ্রক্ষণ থেকেই বাঙালের ঘটি ডুবেছে। 

ফিরে এসে দেখি পাড়া-বেপাড়ার কত লোক জুটেছে ভোগপ্রসাদের আশায়যার কিয়দংশ আমাদের ভোগে পূর্বাহ্নেই চলে গিয়েছে। আমরা তখন আত্মপ্রসাদে মগ্নবেশ একটা খুদে বিপ্লব করে ফেলা গ্যাছে যাহোক। দিব্যি ভিড়ের পাশ কাটিয়ে চুপচাপ ভেতরের ঘরে পালিয়ে যাচ্ছিলামহঠাৎ পড়লাম সেজমামীর শ্যেণদৃষ্টিতে। কোথায় গেছিলামহাত কেন খালিআগের সরাটি কোনখানে ইত্যাদি ইত্যাদি...। মনের যাবতীয় বারুদ সঞ্চয় করে ভাই বলল (আমি নেত্রী কীনাতাই পিছনে ছিলাম) "পুরনো সরাতায় আবার ভাঙা ও আর কী কাজে লাগবেতাই ফেলে দিলাম। মানে পুকুরে ভাসান দিয়ে দিলাম।বকেঝকে আর ফল হবার নয় বুঝতে পেরে প্রশ্নকর্ত্রী একেবারে আবেগে গদগদ হয়ে পড়লেন, "তা'বলে কি লক্ষ্মীকে ফেলে দিতে আছে? লক্ষ্মীর কৃপাতেই আমাদের সব, লক্ষ্মী তো আমাদের মা! পুরনো হয়ে গেলে তুই মাকেও এমনি করে ফেলে দিবি বাবা?"

অতঃপর, মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে আর্দ্রস্বরে বীরকুমার উত্তর দিলেন, "ধ্যাৎ, তুমি কীকরে পুরনো হবেতুমি কি মাটির পুতুল? তুমি আমায় খাইয়ে দাও, দুষ্টুমি করলে পিঠে দুমদুম করে দাও, আবার ঘুম পাড়িয়েও  দাও। তুমিই তো লক্ষ্মী মা আমার! "        

পুনশ্চ: আমাদের নগণ্য সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে তার পরের বছর হনুসংঘের অন্যান্য সদস্য যোগদান করে ও অলক্ষ্মীপনার দ্বিতীয় অধ্যায় রচিত হয়। সে আবার অন্য গল্প। 

Comments

Popular posts from this blog

হে সই-সব,

আমিও যে কোনোকালে শিশু ছিলাম, আর প্রতিটি দিন বাঙ্ময় শিশুদিবস ছিল, তার প্রমাণ এই নিম্নোল্লিখিত 'কবিতা'গুচ্ছ।  জীবনবিমার কোম্পানি প্রতি বছর একটা করে ডাইরি দিত, কীজানি কার বারোমাস্যা লিখবার প্রেরণা। তার পাতায় পাতায় রীতিমত তারিখ দিয়ে, চার-পাঁচ লাইন জুড়ে জুড়ে ঈগলের ঠ্যাঙের মত হাতের লেখায় আমি হিজিবিজি জমিয়ে রাখতাম। আবার ভাবতুম পেন্সিলের কোম্পানির নাম কেন বেছে বেছে অপ্সরা বা নটরাজ হয়, আর খাতার কোম্পানি গুডবয়। তখন ধারণা ছিল, পৃথিবীর (একেবারে বিশ্বস্তরে না ভাবলে ঠিক সেই গুরুত্বটা অনুধাবন করা মুশকিল হয়ে যেত) স-ম-স্ত কবিতাই আট পংক্তির। ফলতঃ, সেই সাড়ে চার বছর বয়সে মৌলিক কিছু একটা লেখবার চেষ্টা করে দেখা গেল, "উঠল বাউল সকালেতে একতারাটি নিয়ে, একতারাটি পরের দিনই হায়রে, ভেঙে গিয়ে সে ভাঙা মনে কাঁদতে গেল বনের ধারে গিয়ে- " ছ'লাইনের বেশী এগোল না। এর পরে কী হওয়া উচিৎ কিছুতেই বুঝতে পারলাম না। আমার লেখা প্রথম 'কবিতা' একটি সার্থক ছোটগল্প হতে হতেও হল না।   এর পরেরটা সম্ভবত সদ্য উপেন্দ্রকিশোর পড়বার ফল। প্রথম শ্রেণীতে পড়তে বাংলা আর ইংরেজি ক্ল...

ল্যাদকথন: একটি শনিবাসরীয় চলভাষালাপ

[সময়কাল ও স্থান: অপ্রাসঙ্গিক। ল্যাদ স্থানকালাতীত।]  আমি: হ্যাঁ বলো। মা: কী করছিস? আমি এই একটু দুধচা করলাম, চিনিছাড়া। [স্লা......র্প]  (রোজ এইভাবেই কথোপকথন শুরু হয়)  আমি: এই একটু লেবুচা আর ল্যাদ খাচ্ছি। মা: অ্যাঁ! কী খাচ্ছিস? আমি: ল্যাদ, ল্যাদ।  মা: (কীরকম একটা দ্বিধান্বিত গলায়) বুঝতে পারছিনা। (ঘাড় ঘুরিয়ে বাবাকে) টিভিটা কমাও না! সারাদিন চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খবর দেখেই যাচ্ছে! তুমুন একটা নতুন খাবারের নাম বলল, ঠিক করে শুনতেই পেলাম না।  আমি: !!!!!!! মা: (এবার আমার দিকে ফিরে) হ্যাঁ বল।  আমি:  নতুন খাবার আবার কী? বললাম তো ল্যাদ।  মা: ও! আমেরিকান খাবার?  আমি: উফফ এতে আমেরিকান কোত্থেকে এল? আশ্চর্য্য! ল্যাদ জানো না? মা: (খচে গিয়ে) তোরা আজকাল কী খাস কী বলিস আমি বুঝতে পারি না। বিদেশী খাবারের নাম আমি কীকরে জানব?  আমি: বারবার বলছি এটা খাবার না। ল্যাদ। বুঝেছো? লয়ে যফলা আকার - ল্যাদ।  মা: (ভুরু কুঁচকে) মানে? আমি: ল্যাদ মানে ল্যাদ। এইটা না বোঝার কী আছে?  মা: (ভীষণ কাঁইমাই করে) ধুর আমি বুঝতে পারছি না। আমি কি অ...

খুকির প্রত্যাবর্তন, ও ধন্যবাদগাথা

সেই সময়ের কথা। যখন পাশের পাড়াকে মনে হত পৃথিবীর শেষ প্রান্ত, আর মাসিক পত্রিকার শিশুবিভাগে কাঁচাহাতের গল্প-কবিতা লিখে পাঠাবার সময় বাদামী খামের বাঁদিকে গোটা গোটা অক্ষরে লিখতাম "প্রযত্নে.. বাবার নাম"। যখন যাবতীয় সৃষ্টিশীল শিল্পচর্চার বিপরীতে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানকে মনে হত গম্ভীর প্রাণহীন ব্যাপারস্যাপার; অন্যদিকে কল্পবিজ্ঞান আর খবরের কাগজে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কথা পড়ে রুশদেশী উপকথার অজানি-দেশের-না-জানি-কী এর মত অদ্ভুত ঘোরলাগা রোমাঞ্চ হত। তালগোল পাকিয়ে যেত সব। যখন বিদেশ মানে আমার কাছে বাংলার বাইরের সমগ্র বিশ্ব - কোনোকালেই যার ধারেকাছে পৌঁছানো হবে না আমার। এইসব ছাইপাঁশ ভাবতে ভাবতে যখন শীতের নিস্তব্ধ দুপুর বা গরমের ভ্যাপসা বিকেলে স্কুলের বারান্দায়-পার্কের মাঠে এমনকি জনবহুল বাজারহাটেও কেমন করে যেন নিজের মধ্যে ভীষণভাবে একা হয়ে যেতাম। অন্তরীপের মত।  তারপর, জীবন গিয়েছে চলে একটি দশক পার। যেসব মানুষের সাথে প্রতিদিন কথাবার্তা হয়, যাদের ওপর আমার দৈনন্দিন যাপন অনেকখানি নির্ভর করে থাকে, সেইসব মুখ বদলেছে। নতুন মুখের ভিড়ে ছোট্ট...

আলোকমঞ্জীর

।১। বিনোদিনীর ঘুম ভাঙে ভোরবেলায়। ছোট্টবেলাকার অভ্যেস। গেরামে বেড়ে উঠলে যেমনটি হয়। সেই যে গো, গাঁয়ের নামটি অঞ্জনা আর নদীর নামটি খঞ্জনা। ভাদ্দরমাস পেরোল কি পেরোল না, সেখেনে ভোরের দিকে হিম পড়ে। আর সারারাত ধরে টুপটাপ ঝরে পড়ে শিউলি। তার বুকের কাছটা ভোরের সুয্যির মত টকটকে কমলা। এতো সন কেটে গেল, সেই শিরশিরে হাওয়াটুকু রয়ে গেছে অমলিন। আর আছে বালিকাবেলার কড়ি ও কোমল। বিনোদিনী, আর তার শিউলিফুল পাতানো সই, স্নেহলতা। তাদের কোঁচড় ভর্তি শিশিরভেজা ফুল। ঘাটের কাছে ছলাৎ ছল, গল্প বলে নদীর জল। এমনি সময় নাম না জানা কোনো পাখি ডেকে উঠলেই বিনোদিনীর অবুঝ  মন  উথালপাথাল করে ওঠে...  ।২। নতুন পাড়ায় আসার পর  থেকে ভাবনার একটাও বন্ধু হয়নি। উফ, এরা আবার কীনা পাড়াকে বলে সোসাইটি। ভাবনা ওদের চেয়ে ঢের বেশী ইংলিশ স্টোরিজ পড়ে, তাই বলে কি ওরকম থেমে থেমে বেঙ্গলি বলে? এমা, না না, বেঙ্গলি না, বাংলা। ওদের পাশের ফ্ল্যাটের দিদুন কেমন মিষ্টি মিষ্টি বাংলা বলে, ওর মা তো অমনি বলে না। দিদুন বলে কিনা, মা তোমার ...

আলু-থালু

মেয়েটিকে একলা দেখে প্রৌঢ়া সহযাত্রিণী শুধোলেন, তাঁদের পরিবারের সঙ্গে রাতের খাবার ভাগ করে খেতে তার কোনো আপত্তি আছে কীনা। বাড়ী থেকে বানিয়ে আনা গরম খাবার, একেবারেই সাদামাটা; তবে সঙ্গে বাচ্চা ও বয়স্ক মানুষ আছে- তারা প্যান্ট্রির হাবিজাবি খেতে পারেনা। আর স্টেশনে দাঁড়ালেই খুচরো ভাজাভুজি মুখরোচক যা বিক্রি করতে আসে তার গুণমান তো কহতব্য নয়। একা মানুষের অবশ্য রান্না করে আনা ভারী ঝক্কি।    এর আগে মেয়েটিকে নিয়ে একপ্রস্থ আলোচনা হয়েছে ট্রেনের কুপে। ঢলঢলে টিশার্ট আর অনেকগুলো পকেটওয়ালা প্যান্ট, উবুঝুঁটি, মশমশে কেডস, ঢাউস ব্যাগপত্তর, তার ওপর এই দেড়দিনের দীর্ঘ যাত্রায় সঙ্গীহীন - এমন অসৈরণ ব্যাপার তাঁদের ছেলেবেলায় দেখা যেত না। আধুনিক না ছাই! ভয়ডর নেই মনে - সংস্কারের ঘটশ্রাদ্ধ করে ছেড়েছে। আর খাবারেরও বলিহারি - কীসব বার্গার-চিপ্স-আলুভাজা হ্যানাত্যানা! এইজন্যই অমন ঘাড়েগর্দানে একাকার। মেয়েমানুষ নয় একটু ভারী চেহারা হওয়া ভালো, তা বলে এতটা! মেয়েটি হেডফোনের আড়াল থেকে গুঞ্জনের আভাস পেয়েছে, আর করুণায় হেসেছে। সনাতনী আর সেকেলের মধ্যেকার কয়েক যোজন দূরত্ব যারা দেখতে পায়নি, তাদের অভিধ...

অসংলগ্ন

জ্বরের ঘোরে সবকিছু অন্যরকম লাগে। কপাল জুড়ে কাঠকয়লার উনুন। ওমের বদলে ছ্যাঁকা। মর্গের মতো ভয়াল ঠান্ডা হাতপায়ের তালু। লক্ষণ সুবিধের নয়।  ইন্দ্রিয়ের আশেপাশে শেকল পড়ে গ্যাছে। অবসাদের চেয়েও ভারী। বা শান্তিনিকেতনী শাল। আরো ওজনদার। শাল বলতে আবার বনেদী কাঠের কথা মনে আসে। নিরক্ষীয় বর্ষাপ্রবণ অঞ্চলের আদিম মহারণ্য। ঘন, অন্ধকার। কারাগারের কুঠুরির মতো। চেনা আসবাব, দৈনন্দিন ব্যবহার্য সালভাদর দালির চিত্রকল্পের মতো, ধনুষ্টঙ্কারের যন্ত্রণার মতো গলে পড়তে থাকে এঁকেবেঁকে। সাততলার জানলার জাল দিয়ে রাতের নাগরিক আকাশ বা রাজপথ অলস আলকাতরার মতো কালো মনে হয়। ঘর গরম রাখার যন্ত্রে একঘেয়ে আওয়াজ। শ্রুতিনির্বন্ধ। ঝিঁঝির ডাকের মত আচ্ছন্ন লাগে। ঘর্মক্লান্ত গরমের দিনে পুরোনো পাখার আওয়াজে যেমন ঝিম ধরে আসতো। বেসিনে জল পড়ার শব্দ শুনে নোঙর মাস্তুল ডিঙি নৌকার কথা মনে পড়ে। ইন্দ্রনাথের কথা, হাকলবেরি ফিনের কথা, ফটিকচাঁদের কথা। অপক্ক হাতে দিনান্তের সৈকতে তাজা মাছ কেনাবেচার প্যাস্টেল ছবি আঁকার কথা।  খিদিরপুর  ডকে প্রথমবার বাণিজ্যিক জাহাজ...

বীণা ও বাণী

তথাকথিত আস্তিকতা বলতে যা বোঝায়, কোনোকালেই আমার তা ছিল না। আমাদের ঘরে সন্ধ্যেবেলার শাঁখবাতি নেই, নীলষষ্ঠীর উপোস নেই। ভাস্কর্য আর মৃৎশিল্পের নিদর্শন স্বরূপ বুদ্ধ-খৃষ্ট-নানকের মূর্তি সাজানো আছে। প্রাচীন সাহিত্যের অংশ হিসাবে ধর্মগ্রন্থ আছে। দেশবিদেশের সনাতন লোকাচারের ইতিহাস জানবার, এবং যুক্তিহীন বিশ্বাসজনিত আনুগত্যের অভ্যাসকে অতিক্রম করেও তাকে যথাসম্ভব নিরপেক্ষভাবে সম্মান করার শিক্ষাটুকু আছে। আছে হালখাতায় বাংলা বর্ষপঞ্জী সংগ্রহ। ঈদের বিরিয়ানি আর ফিরনির যুগলবন্দীতে জন্নতলাভ। চৌকাঠে আর ছাদে হেমন্তের শিরশিরে হাওয়া উপেক্ষা করে দীপাবলির মোমবাতি জ্বালানো আছে। আলো ভাগ করে নেবার আকুলতা আছে, আলোয় ফেরবার আর্তি আছে। আর আছে সরস্বতীপুজো, ঘরকুনো মুখচোরা কিশোরীর একমাত্র আপন উৎসব। সহপাঠিনীর ছোট্ট ফোকলা ভাইবোন, চাঁদা চাইতে এসে বানান বলতে গিয়ে ঘাবড়ে যাওয়া পাড়ার সমিতির ছেলেছোকরা, বা নির্বিবাদী গৃহপরিচারিকার অনভ্যস্ত উচ্চারণে শৈশবেই আমার পিতৃমাতৃদত্ত নামের দৈবী উত্তরণ ঘটেছিল। তারপর আর নিজের সারসত্য সন্ধানে বেরিয়ে পড়া ছাড়া উপায় ছিল না। সেই শুরু আজন্মের সারস্বত সাধনার। আমি চিরকাল কমপ্ল্যান আর আধগ্রাস ...

টাঙলা

বাংলা শব্দে গোলগাল একটা ব্যাপার আছে। যেমন অক্ষর, তেমনি ধ্বনি। মাত্রা টেনে বর্ণমালা গাঁথবার রীতি দেবনাগরীতেই ছিল। কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত তীক্ষ্ণতার বদলে বাংলা অক্ষরে যা আছে তা হল কোমলতা, স্নিগ্ধতা, শান্ত নিবিড় একটা ভাব। শাপলার ডাঁটা, ফলসার থোক, শালিধানের চিঁড়ে বা কুবোপাখির ডাক ভাবলে যেমনটা হয়। সংস্কৃত শব্দে যুক্তাক্ষরের ঝঙ্কারে আভিজাত্য আছে, দৃপ্ত গৌরব আছে, প্রচ্ছন্ন অহংও বুঝি আছে। বাংলায় সেই যুক্তবর্ণকে বেণীপুতুলের মত-মেটে কুঁজোর মত-কেঠো ঘোড়ার মত গড়েপিটে-ছেঁচে-ডেবে নেওয়া হয়েছে; যাতে ধার কম, স্বরের আধার বেশী। তাই ব-ম-য-ফলায় (যেমন- নিঃস্ব, পদ্ম, সখ্য ইত্যাদি) স্বতন্ত্র বর্ণের আঘাতের বদলে দ্বিত্বব্যঞ্জনে জিভকে আরাম দেবার একটা আলসে চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। আলসে অবশ্য কোঠাবাড়ির ছাদেরও হয়, যেখানে নুনহলুদ ছোপ ফুলছাপা শাড়ির পাশে আচারের বয়াম ঝিমোয়। যেমন অক্ষর, তেমনি ধ্বনি। এঁটেল মাটির মত ভিজে ভিজে, হেঁটে গেলে যাতে পদচিহ্ন পড়ে। তার ওপর দিয়ে ধুলো উড়িয়ে টগবগিয়ে ঘোড়সওয়ার যায় না, পদাতিক কাহারের কাঁধে পালকি যায় দুলকি চালে। তা বলে কি একেবারেই তেজ ন...

শেষবারের মতো

অ - নে - ক দিন পরে।    হাওড়া স্টেশনে ট্রেন ঢুকবে কিছুক্ষণের মধ্যে। সাঁতরাগাছি পেরোনোর পরেই সকলের একটু একটু করে মালপত্র নামাবার ব্যস্ততা। আমার দুটো মাত্র ছোটো ছোটো ব্যাগ , তাই মটকা মেরে পড়ে থাকব। নীচের বার্থ হলে পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাব , অন্ধকারের ঘনত্ব থেকে বুঝে নেব ট্রেন কত লেট ( ঠিকঠাক সময়ে চললে সে ট্রেন অন্তত ভারতীয় নয় ) । লোকজন সারি বেঁধে দরজার কাছে জড়ো হতে থাকবে। যাদের সঙ্গে জিনিস বেশী তাদের উৎকণ্ঠাও বেশী। দূরপাল্লার ট্রেন সাধারণত নির্দিষ্ট কিছু প্ল্যাটফর্মেই আসে , তাই প্ল্যাটফর্মের নম্বর আন্দাজ করতে পারার বাহাদুরি এখানে খাটবে না। ট্রেনের এক একটা কামরা প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে থাকবে , আ র দক্ষ অভিজ্ঞ মালবাহীরা লাফ দিয়ে উঠেই দরদাম করতে শুরু করে দেবে। দু - পাঁচ টাকা নিয়েও দর হবে   বোধহয়।  শিল্প যত সূক্ষ্ম হয় ততই তার কদর বেশী ।   আমিও এর মধ্যে চোখটোখ কচলে উঠে বসব। অত রাতে " মন্দ্রিত করিয়া তোলে জীবনের মহামন্ত্রধ্বনি"   এইসব ভেবেটেবে মন ভালো হয়ে যাবে।    সকলে যখন সমস্ত মালপত্রের সঙ্গে দলের বাদবাকিদের গুনে নিতে ব্যস্ত , ট্রেন থেকে নেমে আমি চলমা...

পাড়া

ঘর-বারান্দা, বাড়ী, পাঁচিলের চৌহদ্দি। ছোটোখাটো বস্তি। সারিসারি জবরদখল হয়ে যাওয়া সরকারী খাসজমি। রেশন, তেলেভাজা-বইখাতা-বাসন আর মনিহারির দোকান, মুদিখানা, বস্ত্রালয়, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। দুবেলা সব্জী আর মাছের অস্থায়ী বাজার। খেলার মাঠ, পার্ক, বাঁধানো রক, ক্লাবঘর। পুরসভা বা পঞ্চায়েতের ব্লকের ভেতরে একখন্ড রাজনৈতিক সংজ্ঞাহীন অঞ্চল, স্বতন্ত্র সভ্যতা। তথাকথিত আত্মীয়তার ঊর্ধ্বে, নিছক পরিচয়ের সূত্রে গড়ে ওঠা স্বাজাত্যবোধ। পাড়া। সবাই সবার খোঁজ রাখে। পথেঘাটে দোকানবাজারে নিতান্ত সাধারণ বারোমাস্যার আদানপ্রদান। ডিগ্রী পাশ বা চাকরির খবরে স্বস্তি আসে, বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে রক্ষণশীল গুঞ্জন ওঠে, সুস্থসবল সন্তানের জন্মে খুশীর হাওয়া বয়। রাতবিরেতে শ্মশানবন্ধু জোগাড় করতে কখনো বেগ পেতে হয় না। সন্ততিত্যজ্য অশীতিপর বৃদ্ধা, কিঞ্চিৎ মানসিক ভারসাম্যহীন অবিবাহিতা প্রৌঢ়া বা বহুজনের সংসারে এককোণে খুদকুঁড়োর মত পড়ে থাকা স্নায়ুরোগাক্রান্ত যুবকের পারিবারিক ইতিহাস ছাপোষা জনজীবনে দুশ্চিন্তা, সহানুভূতি আর অনিশ্চয়তাবোধের সঞ্চার করে। কেউ বাড়ী বিক্রি কর...