বাল্যকালে
আমি ভারী চঞ্চল ও বদবুদ্ধির
অধিকারিণী ছিলেম। শান্ত
নিস্তরঙ্গ জীবন ও পানাপুষ্করিণীতে আমি
তেমন পার্থক্য দেখিনে। অত্যধিক
প্রশ্রয়ে মালতীলতা কিংবা বনসাইতুল্য
হইবার পরিবর্তে অনাদরের
আগাছা ও পরিমিত যত্নের উদ্ভিজ্জ
হইতেই আমার আগ্রহ বেশী। তদুপরি
জন্মসূত্রে মেয়েমানুষ মাত্রেই যে
গৃহলক্ষ্মীর ন্যায় অচলা অবলা
মৃৎপুত্তলিকা হইবার
নিমিত্ত বলিপ্রদত্ত - এইরূপ
কুশিক্ষা কদাপি পাই নাই বলিয়া
দিনে দিনে আমি এক সার্থক
হনুমতীরূপে শ্রীবৃদ্ধি লাভ
করিতেছিলাম। এতদকাল লৌকিক
ও সামাজিক উপাচার বলিয়া
যাহাসকল পালিত হইয়াছে, তাহার
কোনোরূপ যৌক্তিক ব্যাখ্যা
পাইবার পূর্বাবধি আমি নিয়মের
অনুগামিনী হইতে অপারগ ছিলাম।
যাহাই
হউক, শাখামৃগের
পক্ষে সাধুভাষা অবলম্বন
স্বাস্থ্যহানিকর। এতে মাথা
ভার হয়ে যায়, কিলবিল
করতে থাকা দুশ্চিন্তনীয়
পরিকল্পনাসমূহ কেমন গৃহপালিত
লক্ষ্মীপেঁচার মত গুটিশুটি
মেরে বসে। যে গল্প (পড়ুন: নির্জলা
সত্য ঘটনাবলী) বলবার
জন্য এই ভণিতা, সেটাই
বরং বলে ফেলা যাক।
![]() |
বড়দাদার (হনুসংঘের প্রতিষ্ঠাতা) দেওয়া আল্পনা |
আমার
মায়ের বাড়ীতে (বুঝতে
অসুবিধে হলে মামাবাড়ী বা
দাদুদিদার বাড়ী বলে ধরে নেওয়া
যেতে পারে) লক্ষ্মীপুজো
হয় মাটির সরায়। তখন পুজো বা
পটচিত্রের তাৎপর্য্য নিয়ে
আমার মাথাব্যথা ছিল না, তাই
খিচুড়ী-লাবড়া-নাড়ু-মোয়া
এইসব ভালো ভালো খাবারের তত্ত্বাবধানে
আমি স্বেচ্ছায় নিজেকে নিয়োজিত
করেছিলাম। সেকালের অট্টালিকায়
যেমন হত, পাকশালা
আর উপাসনাগৃহের মধ্যে এক উঠোন
দূরত্ব, তার
ওপর লালমেঝের ঠাকুরদালানে
চালের গুঁড়ি দিয়ে মনমোহিনী
সব আল্পনা, সেইসব
পেরিয়ে পেরিয়ে বারবার নৈবেদ্য
চেখে দেখা ও বিদগ্ধ মতামত
দেওয়া, সে
কী কম হ্যাপা! তার
মধ্যে একবার কুলুঙ্গি থেকে
নামাতে গিয়ে সেই সরা গেল ভেঙে।
অনেক সন ধরে ব্যবহৃত সরা, তাই
আশ্চর্য্য হবার কথা নয়। তবু
অমঙ্গলের পূর্বাভাস ভেবে
তড়িঘড়ি নতুন সরা কিনে আনা হল।
সংসারে ভাঙাচোরা জিনিসের কদর
নেই, তাই
আগের সরা হস্তান্তরিত হল
ছোটদের দরবারে। আমাদের কাছে
সবই খেলবার বস্তু। তাই আহ্লাদিত
হয়ে মামাতো ভাইয়ের ইশকুলের
হস্তশিল্পশিক্ষার জন্য কিনে
রাখা ফেভিকল দিয়ে সরা মেরামত
করবার চেষ্টা চলল। ছিন্নবৃন্তের
কোণায় লেগে থাকা কষের মত সরার
ফাটল বরাবর আমাদের অদক্ষ
জোড়াতালির চিহ্নস্বরূপ আঠার
সাদা সাদা দাগ লেগে থাকল।
মোটকথা ব্যাপারটা একেবারেই
দৃষ্টিনন্দন হল না। নিজেদের
ব্যর্থ প্রচেষ্টা লুকোবার
জন্য তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হল
যে এটা বিসর্জন দিতে হবে। আমরা
কেউই কোমলপ্রাণ সরলহৃদয় ছিলাম
না, সামান্য
মাটির সরার মত পার্থিব বিষয়ে
আমাদের আসক্তি থাকবেই বা
কীকরে? কিন্তু
কথা হচ্ছে, প্রচলিত
সংস্কারে লক্ষ্মী ততক্ষণই
জাগ্রত, যতক্ষণ
সরা অখন্ড। টুকরো হয়ে যাওয়া
সরায় সমৃদ্ধির দেবী নেহাতই
রঙতুলির আঁচড়। এখন আমাদের মত
অতিবিচ্ছু বালকবালিকার হাতে
একাধারে সরা ও শ্রীদেবীর (সক্ষত) পুনর্জাগরণ
ঘটে যাওয়ায় সবাই যারপরনাই
বিস্মিত ও আনন্দিত হল। দুর্বল
ধর্মবিশ্বাস আঠার মত
রেচনপদার্থে খোঁজে ঈশ্বরচেতনা।
তাই অবোধ আমাদের জানিয়ে
দেওয়া হল যে এই সরা খুব সাবধানে
যত্ন করে গুছিয়ে রাখতে
হবে, অন্যথায়
দুর্দিনের দুর্দম দুর্বিপাক
ও দুর্গতির ঘুটঘুটে অন্ধকার
নেমে আসবে প্রভৃতি।
আ
মোলো যা! ছিল
খেলনা, হয়ে
গেল কোষাধ্যক্ষা - এ
কি ভোজবাজি নাকি! আমার
মধ্যে ততক্ষণে যুগযুগান্তরের
অলক্ষ্মীদের অপশক্তি কেন্দ্রীভূত
হয়েছে, তাই
কোমর বেঁধে নিঃশব্দ ভাসানযাত্রার
প্রস্তুতি নিয়ে ফেললাম।
কনিষ্ঠটি আমারই মন্ত্রশিষ্য, তাকে
বাগে আনতে বেগ পেতে হল না।
বাড়ীতে অনেক মানুষের ভিড়, সকলেই
উৎসবে কর্মব্যস্ত,
তাই আমাদের
সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখাও
সম্ভব ছিল না। পা টিপে টিপে (অর্থাৎ
কর্দমাক্ত ধূলিধূসরিত হাওয়াই
চটির বিলাসিতা ত্যাগ করে) খিড়কির
দরজা দিয়ে বেরিয়ে একছুট্টে
সোজা পুকুরপাড়ে। ... তারপর
আর কী, সেই
অলক্ষিত মাহেন্দ্রক্ষণ থেকেই
বাঙালের ঘটি ডুবেছে।
ফিরে
এসে দেখি পাড়া-বেপাড়ার
কত লোক জুটেছে ভোগপ্রসাদের
আশায়, যার
কিয়দংশ আমাদের ভোগে পূর্বাহ্নেই
চলে গিয়েছে। আমরা তখন আত্মপ্রসাদে
মগ্ন, বেশ
একটা খুদে বিপ্লব করে ফেলা
গ্যাছে যাহোক। দিব্যি ভিড়ের
পাশ কাটিয়ে চুপচাপ ভেতরের
ঘরে পালিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ
পড়লাম সেজমামীর শ্যেণদৃষ্টিতে।
কোথায় গেছিলাম, হাত
কেন খালি, আগের সরাটি
কোনখানে ইত্যাদি ইত্যাদি...।
মনের যাবতীয় বারুদ সঞ্চয়
করে ভাই বলল (আমি
নেত্রী কীনা, তাই
পিছনে ছিলাম)
"পুরনো
সরা, তায়
আবার ভাঙা - ও
আর কী কাজে লাগবে? তাই
ফেলে দিলাম। মানে পুকুরে ভাসান
দিয়ে দিলাম।" বকেঝকে
আর ফল হবার নয় বুঝতে পেরে
প্রশ্নকর্ত্রী একেবারে
আবেগে গদগদ হয়ে পড়লেন,
"তা'বলে
কি লক্ষ্মীকে ফেলে দিতে আছে?
লক্ষ্মীর
কৃপাতেই আমাদের সব, লক্ষ্মী তো
আমাদের মা!
পুরনো
হয়ে গেলে তুই মাকেও এমনি করে
ফেলে দিবি বাবা?"
অতঃপর,
মায়ের
গলা জড়িয়ে ধরে আর্দ্রস্বরে বীরকুমার
উত্তর দিলেন,
"ধ্যাৎ,
তুমি
কীকরে পুরনো হবে, তুমি
কি মাটির পুতুল?
তুমি
আমায় খাইয়ে দাও,
দুষ্টুমি
করলে পিঠে দুমদুম করে দাও,
আবার ঘুম
পাড়িয়েও দাও। তুমিই তো
লক্ষ্মী
মা আমার! "
পুনশ্চ: আমাদের নগণ্য সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে তার পরের বছর হনুসংঘের অন্যান্য সদস্য যোগদান করে ও অলক্ষ্মীপনার দ্বিতীয় অধ্যায় রচিত হয়। সে আবার অন্য গল্প।
Comments
Post a Comment