সাতদিনের
মেয়াদ শেষ।
যে
পথটুকু দিব্যি হেঁটে যাওয়া
যায়,
গত
কয়েকদিন ব্যাঙ্ক ইত্যাদিতে
অনায়াসে হেঁটে হেঁটেই যাতায়াত
করেছি,
আর
অর্ধদশক আগেও নিজের ওজনের
সমান বইপত্র পিঠে নিয়ে ইস্কুলে
গিয়েছি-
সেইটুকু
রাস্তার জন্যেও রিকশা ভাড়া
করা হয়। সঙ্গে সেই ছোটো দুটো
ব্যাগ।
আমি
সারারাস্তা অনর্গল কথা
বলে যাই। মা আর রিকশাচালক
চুপচাপ শোনার ভান করে। ওই
বিহারী ফুচকাওলার মাখার হাত
ভালো অথচ কম দেয়-
এই
গলি দিয়ে কেমিস্ট্রি স্যারের
বাড়ী পড়তে যেতাম-
সেই
জলাজমি, যেখানে বাবাদের
ছাত্রাবস্থায় (নকশাল আমলে)
জনসাধারণের
মধ্যে ত্রাসসঞ্চার করতে
মানুষের কাটা মাথা নিয়ে ফুটবল
খেলা হত বলে শুনে এসেছি-
ওইদিকে
পৌলমীদিদিদের বাড়ী, যাদের
রমরমা পৈতৃক ব্যবসার কারখানা
অন্যায়ভাবে জবরদখল হয়ে গিয়েছিল এই রাস্তা চওড়া করবার সময়-
ও--ই
গলিতে সেই সাইবার কাফে, যেখানে আমি কলেজে ভর্তির সময় থেকে
স্কলারশিপের আবেদন করা
পর্যন্ত নির্লজ্জের মত অসময়ে
এসে এসে জ্বালাতন করেছি -
এইসব।
এর মধ্যেই রিকশা গন্তব্যস্থলে
পৌঁছয়।
পরিস্থিতির
সুযোগ বুঝে রিকশাওলা খুচরো
ফেরত দিতে অস্বীকার করে। বাবা
প্রায় রিকশার গতিতেই হাঁটে,
ফলে
দু-এক
মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যায়।
তাড়াহুড়োয় সততা এবং ন্যায্য
ভাড়ায় রিকশা চালানোর গুণাগুণ
নিয়ে মা'র
তর্ক করা হয় না। .. আমি
ততক্ষণে বড়োরাস্তা পার হয়ে
গেছি। বাস চলে গেলে মুশকিল। ট্যাক্সি-ক্যাব
এই জাতীয় নিঃসঙ্গ যানবাহনে আমার প্রবল অনীহা।
যখন
যে বাস দরকার কিছুতেই তা আসবে
না,
বা
বিস্ফোরণের ঠিক আগের অবস্থায়
ভর্তি হয়ে আসবে -
এটাই
রীতি। চাহিদা আর যোগানের
অনুপাতের ওপর বাজারের স্থায়িত্ব
প্রভৃতি নিয়ে ভেবেটেবে নিজেকে
নিরুদ্বেগ রাখার ব্যর্থ চেষ্টা
করি। পাশের তেলেভাজার দোকানে
কত সস্তায় জলখাবার পাওয়া যায়
-
পেছনের
সরকারী আবাসনে অবসরপ্রাপ্ত
কর্মীরা কী অকল্পনীয় কম ভাড়ায়
থাকেন -
এমনকি
বাসভাড়াও কয়েকবছরে তেমন একটা
বাড়েনি -
এসব
নিষ্প্রয়োজন গ্রাম্ভারী
চিন্তাভাবনা করতে করতে বাস
এসে যায়। পিঠেহাতে ব্যাগ বওয়া আমার ট্র্যাপিজ খেলোয়াড়ের
দক্ষতায় বাসে ওঠা দেখে কন্ডাক্টর
হকচকিয়ে গিয়ে "আস্তে"-র
পর "লেডীজ"
বলতে
ভুলে যায়। আমি একেবারে সামনে,
বাসচালক আর ইঞ্জিনের বাঁদিকে গিয়ে
বসি। শেষ অবধি যাব,
এখানে
কেউ গোলমাল করবার নেই।
বাসের
গতিপথ আমার পরিচিত। সত্তরোর্ধ্ব
প্রৌঢ়ার মত স্মৃতিচারণ করতে
করতে যাই। স্মৃতি হবার মত
যথেষ্ট অতীত হয়নি সেইসব ঘটনা।
বিএসএনএলের দপ্তর,
যেখানে
কোনো জরুরী দরকারে এসে কর্মচারীরা
নির্ধারিত সময়ের চেয়ে প্রায়
এক ঘন্টা বেশীক্ষণ ধরে মধ্যাহ্নভোজ
করার দরুণ আমাকে সমস্ত তলায়
বিভ্রান্তভাবে ঘুরে ঘুরে
লোকজনকে তাগাদা দিতে হয়েছিল
--
টালা
ব্রীজে ওঠার একটু আগে বিটি
রোড থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া
রাস্তা,
যেখান
দিয়ে যানজটের ঝক্কি এড়িয়ে আমরা দীঘা যাবার জন্য কাকভোরে
শালিমারে পৌঁছেছিলাম (আর
ফেরার দিন নন্দীগ্রামে অবরোধ
হয়েছিল)
-- বাটার
জুতোর দোকান, যেখান থেকে পুজোয়
স্টিলেটো পরে বেড়াতে বেরনো
সহপাঠিনীরা মনমত হাওয়াই চটি
কিনতে গিয়ে ঠাকুর দেখার সময়
করে উঠতে পারেনি --
গোলবাড়ির
শাখাপ্রশাখাহীন দোকানের
কিংবদন্তী পরোটা কষামাংস ..
এইরকম
নগণ্য বিচ্ছিন্ন ঘটনাপ্রবাহ।
শ্যামবাজার-হাতিবাগান
এসে পড়লেই এত কিছু ভাবার ফুরসত
থাকে না। গৃহস্থালির উপকরণ
থেকে নিছক শৌখিন জিনিসপত্র
ইত্যাদির বিকিকিনিতে কোলাহলমুখর
ব্যস্ত জনজোয়ারের ফাঁক দিয়ে
একবারের জন্য পাঁচ নম্বর ট্রাম
ডিপো,
স্টার
থিয়েটার আর মোহনবাগান ক্লাবের
গলি দেখে নিই। এ অঞ্চল পদাতিকের
সাম্রাজ্য,
তাই
সমস্ত গাড়ী ও তার চালক বিশ্রাম
নিতে নিতে যায়। কন্ডাক্টর
নিশ্চিন্তে কালিঝুলিমাখা
বোতল নিয়ে রাস্তার কলে জল ভরতে
যায়, আর
ফিরে এসে জানলা দিয়ে আমার
বাঁদিকের ছোট্ট তক্তায় সেগুলো
রেখে দিতে বলে। আড়মোড়া ভাঙতে
ভাঙতে বাস বেথুন স্কুলচত্বর আর বিবেকানন্দ ভবন পেরিয়ে
যায়।
ব্রাহ্মসমাজের
সদর দপ্তর আসার আগেই বিবেকানন্দ
রোড হয়ে বাস রামমোহন সরণিতে
বাঁক নেয়। একবছরেরও বেশী সময়
ধরে নাকি বিদ্যাসাগর কলেজের
সামনের রাস্তায় উন্নয়নশীল
কাজকর্ম চলছে। যা হোক,
বাংলার
নবজাগরণে প্রাতঃস্মরণীয়
মহাপুরুষদের অবদান ও তাঁদের
নামাঙ্কিত প্রতিষ্ঠানসমূহের
বর্তমান অবস্থার কথা ভাবতে
ভাবতে ভারাক্রান্ত হয়ে যাই।
ওষুধের প্যাকেটটা যে এবারেও
ফেলে এসেছি -
মা
সেকথা মনে করিয়ে দেওয়ায় আবার
লৌকিক জগতে ফিরে আসি। ইতিমধ্যে
বাস মহাত্মা গান্ধী রোডে
(শহরের
একমাত্র রাস্তা যার পরিবর্তিত
নাম আমি মনে রাখতে পারি)
এসে
গিয়েছে।
আমি আবার স্মৃতিচারণায় ফিরে
যাই। তিনবছরের,
জীবনের
অন্যতম সেরা সময়ের স্মৃতি।
দুটাকা বাঁচিয়ে অর্ধেক বাসস্টপ আগে নামার,
বাইশ
টাকায় ভরপেট সবজি-ভাত
খাবার,
একপ্লেট
চাউমিন দুজনে ভাগ করে খেতে
চাওয়ায় কেবিন থেকে বের করে
দেবার অমূল্য স্মৃতি। আরেকটু
বাঁদিকে গেলেই স্বর্গ। বইপাড়া। সামনে
যানজটে ফেঁসে গেলে ট্রেন ধরতে
পারব কিনা-
এইসব
সংসারী চিন্তায় নিজেকে উৎসর্গ
করে সংযত থাকার চেষ্টা করি।
তবু,
সেন্ট্রাল
এভিনিউয়ের মোড় পেরনোর আগে
অবধি একটা অলস আচ্ছন্নতা
ঘিরে থাকে। সময় সাশ্রয়ী মেট্রো,
না
বাস-ট্রেন-ট্রামের
অভিজ্ঞতাসম্ভার -
এর
যুতসই হিসাব করে উঠতে পেরেছিলাম
কিনা সেটা অমীমাংসিত থেকে
যায়।
তারপর আর কী,
বড়বাজারের
বিখ্যাত যানজট – আবারও সেই
পথচারী আর রাস্তার পাশের
ছোটো অস্থায়ী দোকানপাটের
প্রতাপ। হাতঘড়ির দিকে ঘনঘন
চোখ চলে যায়। বাসচালক নির্বিকার
বিড়ি ধরায়, আর
সাদাকালো ছায়াছবির
ফুল-পাখি-চাঁদ-বসন্তের
গান শোনে।
হাওড়া
ব্রীজের আলো ঝলমলে শৃঙ্গ
চোখে পড়তেই বুকের ভেতর কেমন করে ওঠে। আজন্ম সালকিয়ায় বড়মাসির
বাড়ী আসবার সময় হাওড়া ব্রীজ
দেখে প্রায় পৌঁছে যাবার যে
ছটফটে আনন্দ হত,
তেমনটা
নয়। শৈল্পিক প্রযুক্তিতে
শৈশবের সে স্তব্ধবাক বিস্ময়ও
এখন আর নেই। কিন্তু কিছু একটা
ঘটে যায়,
ফলে
বাকি রাস্তাটুকুতে মস্তিষ্কে
তথ্যপ্রেরণ স্থগিত থাকে।
বাস
থামার পর,
শেষ
স্টপ জেনেও লোকজন ধাক্কাধাক্কি
করে নেমে গেলে;
পাতিলেবু-ছিটের
জামা-সান্ধ্য
পত্রিকা-মাটির
খেলনায় সাজানো আর ইতস্তত
বিক্ষিপ্ত আবর্জনায় পূতিগন্ধময়
সাবওয়ে দিয়ে প্রতিকূল জনস্রোত
ঠেলে স্টেশনে ঢুকি। বাবা
প্ল্যাটফর্ম টিকিট কাটতে
যায়। সঙ্গে দেওয়া আগামী
দেড়দিনের বিচিত্র আহার্য্যের থলে সামলে রাখে মা।
পরিচিত
ট্রেনের নাম আর আগমনবাণী
শুনে স্বস্তি আসে। মস্তিষ্কে
চলাচল শুরু হয়। ব্যাগপত্র
সামলে নিত্যযাত্রীর মত অনাবিল আবেগহীনতায় ঘোষিত প্ল্যাটফর্মের
দিকে রওনা দিই। ঘরে ফেরার
পালা। কাজ পড়ে আছে অনেক।
অভ্যাস
বড়ো দায়। অন্যের রাজ্যপাট আজকাল আপন মনে হয়। সবই তো
ঘর। প্রবাস বলে কিছু হয় না।
Comments
Post a Comment