আমার দূরপাল্লার ট্রেনযাত্রার অভিজ্ঞতা বরাবরই বেশ ভালো। দু-একটা অবাঞ্ছিত ঘটনা যে ঘটে না তা নয়, তবে সেসব মনে না রাখাই শ্রেয় (সতর্ক থাকাটুকু ছাড়া)। সে অর্থে প্রথম পশ্চিমবাংলার বাইরে বেরনো কলেজের দ্বিতীয় বছরে। কুড়ি বছর বয়সে। একধাক্কায় পুণে, দুহাজার কিলোমিটারের বেশী দূরত্ব। পূর্ব থেকে একেবারে পশ্চিমে। প্রথম শীতাতপ কামরার আমেজ, রেল কর্তৃপক্ষের দেওয়া চারবেলার আহার্য্য - প্রায় একদিন ট্রেনেই গতিশীল বসবাস। সহপাঠীদের সঙ্গে। সাতদিনব্যাপী শিক্ষামূলক ভ্রমণ। গবেষণা প্রতিষ্ঠানে। সবকিছুই প্রথম ছিল। এমনকি হাওড়া স্টেশনের সাথে আলাপও মূলত তখন থেকেই।
উদ্যোক্তা ছিলাম মূলত আমরাই। চিঠিচাপাটির প্রত্যুত্তর ইত্যাদির ব্যাপারে অধ্যাপকদের নিয়মিত তাগাদা দেওয়া ছাড়া তেমন কিছু করতে হয়নি; যদি না চারজন মিলে দেড় লক্ষ নগদ টাকা (ত্রিশজনের মাথাপিছু পাঁচহাজার ইত্যাদি) ব্যাগে ভরে অতিব্যস্ত জনবহুল কলেজস্ট্রীট থেকে বাসে শেয়ালদা গিয়ে, কৌতূহলী ভিড়ে ঠাসা কাউন্টারের সামনে রুদ্ধশ্বাসে প্রতি ছয়জনের টিকিটের খরচ আলাদা করে গুনেগেঁথে, সকলে এক কামরাতেই পাবে এইসব নিশ্চিত করে, কোনোরকম দুর্ঘটনা না ঘটিয়ে প্রত্যাশিত সময়ের মধ্যে ফিরে আসায় কোনো কৃতিত্ব থেকে থাকে। সবার যোগদানের উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে এক ছিল না, তবে উদ্দীপনা ছিল সমান তীব্র। তার নেপথ্য কারণও হয়তো ভিন্ন ছিল, কিন্তু সাতসকালে সবাই যখন একে একে জড়ো হচ্ছে প্ল্যাটফর্মে, কার কত বেশী মালপত্র সেই নিয়ে লঘু কথাবার্তা চলছে, আর ছাত্রীদের মায়েরা নিরাপত্তা সম্পর্কিত সতর্কবার্তা ও উদ্বেগ একে অপরের সাথে ভাগ করে নিচ্ছে - কোথাও মনে হয়েছিল এবার সবারই কিছু একটা প্রথম হতে চলেছে।
শীতাতপ কামরার বাইরে থেকে জানলার কালো কাঁচ পেরিয়ে কিছু দেখতে পাওয়া দুষ্কর। তবু সারিসারি শুভাকাঙ্ক্ষী মুখ হাত নাড়ে। প্রথম কামরার সঙ্গে যখন ইঞ্জিন জোড়া হয়, সামান্য দুলে ওঠে ট্রেনের সর্পিল শরীর। সবাই জিনিসপত্র সামলে বসে। তারপর ট্রেন ছাড়বার মুহূর্তে হালকা ঝাঁকুনি, প্রযুক্তির কল্যাণে যা মসৃণ। স্হিতিজাড্য। হঠাৎ করে, জীবনে প্রথমবার, উৎপাটিত শিকড়ের জন্য আমার মনকেমন হয়েছিল। যদিও দীর্ঘ প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্ত পেরিয়ে যাবার পর বসন্তের মিঠে রোদে সকল উদ্বাস্তুর যন্ত্রণা বাষ্প হয়ে যায়।
মানসম্মান বজায় রাখতে হলে ট্রেনযাত্রার কথা সবিস্তারে না বলাই ভালো। বিশেষত বয়োজ্যেষ্ঠ দাদাদিদিরা যদি ডটপেন দিয়ে ঘুমন্ত সহপাঠিনীর গোঁফদাড়ি এঁকে দেয়, আর বেচারী শিকার কাগজকাটার কাঁচি হাতে সম্ভাব্য অপরাধীকে তাড়া করে। যাইহোক, কয়েকঘন্টার মধ্যেই সমস্ত কামরা আমাদের দখলে। যে বয়সের যা ধর্ম। কেউ দাবার বোর্ড পেতে বসেছে, উদাত্ত গলায় গান গাওয়া হচ্ছে এদিকসেদিক, বিজ্ঞান-রাজনীতি-শিল্পকলা বিভিন্ন বিষয়ে মননশীল আলোচনা চলছে, তাস এবং মাফিয়া খেলতে খেলতে মানুষজন পরিশ্রান্ত। সহযাত্রীরা বিনিপয়সার বিনোদন উপভোগ করছেন দিব্য।
আর আমি, সাইড লোয়ার বার্থের অপার্থিব বিলাস এবং এসির হিম একসঙ্গে আত্মস্থ করতে না পেরে কুটকুটে কম্বলের গুহায় কোনো এক গণিতজ্ঞের জীবনচরিত পড়বার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছি। দুপুরে পাতলা এবং বিস্বাদ ডাল ছলকে পড়েছে জামায়। প্রতি প্রহরে মায়ের চিন্তান্বিত গলার উত্তরে দায়সারাভাবে 'সব ঠিকাছে, রাজ্যের বাইরে এলেই রোমিংয়ের খরচা (যেটার নামই শুনিনি আগে কোনোদিন)' এইসব বলে ফোন রেখে দিচ্ছি। ক্লান্ত লাগছে, ঘুম আসছে না। আড়াই চামচ চায়ের দাম শুনে অমৃত ফিরিয়ে দিয়েছি। মোটের ওপর নাজেহাল অবস্থা। জগতের আনন্দযজ্ঞে আমি নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছি।
দুঃখের দিন সবারই শেষ হয় কখনও। আমারও হল। আপার বার্থ থেকে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে মহারাষ্ট্রীয় ভোর দেখবার পর। নেমে আসতেই হল। বাদামী-হলদে রঙের কী ভীষণ শুকনো নির্লিপ্ত মরুসদৃশ ভোর! এদিকে ট্রেনের গতি কমে আসছে, অথচ গরম চায়ের ভুবনমোহিনী হাঁক, বা আসনের তলা থেকে মালপত্র বের করার ব্যস্ততা আমি টের পাচ্ছি না। কাঁচের গায়ে নাক ঠেকিয়ে দেখছি অসবুজ ভিন্নতা। এবারের মতো যাত্রা তবে শেষ। নতুন নগরী, নতুন মানুষ, নতুন ভাষা ও দুর্বোধ্য কোলাহল আরো কত কী।
মধ্যিখানের অর্ধপক্ষকাল আমার এই নগণ্য জীবনের সবচেয়ে (বা অন্যতম) স্মরণীয় ঘটনা। সেকথা থাক। ফেরবার সময় আমরা সকলেই অবশ্য যেনতেনপ্রকারেণ চেয়েছিলাম আমাদের নাকের ডগা দিয়ে ট্রেন বেরিয়ে যাক। আমরা পড়ে থাকি। হয়নি। এদিকে ট্রেনে আমার প্রাত্যহিক ক্রিয়াকলাপ গতবারের চেয়ে অনেক স্বচ্ছন্দ হয়েছে। মাঝরাতে 'মেমরী গেম' খেলতেও দ্বিধাবোধ হয়নি। মাত্র একবারের দীর্ঘ ট্রেনযাত্রার অভিজ্ঞতায় দারুণ অভ্যস্ত হয়ে গিয়ে সবাইকে ডেকে ডেকে আমার অভিযোজন ক্ষমতার নিদর্শন দেখিয়েছিলাম। সেখান থেকেই বাদবাকি গল্পের শুরু।
বিকেলবেলা। ভোডাফোন সুললিত স্বরে জানান দিল রোমিং শেষ। আমরা স্বাগত ইত্যাদি। বাইরের আবছা অন্ধকারে প্রাণবন্ত সবুজের আভাস। পুকুর, চালাঘর, ছড়িয়েছিটিয়ে গাছ এইসব। 'নমো নমো নমো সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি'। সত্যি সত্যি কবিতাপাঠের আসর। ইস্কুলের বাংলা প্রশ্নপত্র নিয়ে সমালোচনা। গতানুগতিক রবীন্দ্রকাব্য পার হয়ে জীবনানন্দের 'সুচেতনা'। কার সামনে এই অনন্য শিল্পকীর্তি কেন নিষিদ্ধ তা নিয়ে বালখিল্য লুকোচুরি।
... এর মধ্যেই ট্রেন আবারও ধীর হয়ে আসে। বাইরে সেইসব উৎকণ্ঠিত মুখের সারি। এখন আর নতুন কোনো ভোর নেই। বাতাসে অপরিচিত ভাষায় ঘোষণা নেই। গত সাতদিনের যূথবদ্ধতা থেকে ছিটকে যাওয়া আছে। আর অন্য কোনো ট্রেনের জন্য অপেক্ষমান যাত্রীদের সমুদ্র অতিক্রম করে ভারী হয়ে যাওয়া ট্রলির ধ্বস্ত দেহ টানতে টানতে ট্যাক্সির জন্যে অপেক্ষা। খানিক থিতিয়ে নেওয়া। আর আকুল অপেক্ষা আগামীর। পরবর্তী পর্বের...
Comments
Post a Comment