ডাল, আমবাঙালীর জীবনের অনিবার্য অংশ। যখন নিজেকেই সময় দেবার অবসর হয় না, সেইসব অতিব্যস্ত দিন থেকে শুরু করে ছুটির মেজাজে বিশেষ কোনো উদযাপন, সর্বত্র রূপে-গন্ধে-স্বাদে ইন্দ্রিয়সুখের ডালি নিয়ে তারা হাজির। সেইসব জড়ো করে এ অধম বুভুক্ষুর দু-চারটি প্রলাপ।
সোনামুগডাল। বর্ষামুখর রাতে খিচুড়ির উপকরণ হিসাবে যার কদর কেবল অর্ধাঙ্গিনীর। তার আসল রূপ খোলে বিয়েবাড়ীর মধ্যাহ্নভোজে মুড়িঘন্টের ডালে। সঙ্গে জুঁইফুল ভাত। অনেকদিনের অসুস্থতার পর ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লে যেমন ঝরঝরে লাগে, তেমনি মুক্তকচ্ছ ধবল ভাত- যত্ন করে যা আঙুলে মেখে নেওয়া যায়। সন্ধ্যেবেলার চর্ব্যচোষ্যের আতিশয্যের মুখড়ায় এ একান্তই আত্মীয়তার আন্তরিক উদযাপন। অবশ্য অহিংস জনগোষ্ঠীর জন্য ফুলকপি-আলু-কড়াইশুঁটির সুযোগ্য বিকল্প থাকে। সকলের সঙ্গে পাত পেড়ে বসে খাবার যে ভরপেট আনন্দ, তা ছাড়া বোধহয় এই ডালের নবাবী স্বাদের ন্যায্য মূল্যায়ন হয় না।
নিজামতের কথা যখন উঠল, ছোলার ডালের কথা না বললেই নয়। নারকোলের ফিনফিনে টুকরো আর অর্ধচন্দ্রাকৃতি কাজুবাদামের বনেদিয়ানায় সে এক রাশভারী নৈবেদ্য। অবশ্য ঘিয়ে ভাজা ফুলকো লুচির সঙ্গত বিনা এই ঐশ্বর্য হৃদয়ঙ্গম করা মুশকিল। এই ডালে পড়ন্ত জমিদারী, শূন্য ঠাকুরদালান আর কাঁসার নকশি থালাবাটির চিত্রকল্প আছে। পরিবেশন যে ভুলতে বসা এক শিল্প- তা মনে করিয়ে দেওয়ার মেজাজ আছে। আমার ব্যক্তিগত মহাষ্টমীর দুপুর আর ভাইফোঁটার সকাল সেই ছোলার ডালের স্মৃতিতে সুবাসময়।
সিংহাসন থেকে চোখ ফিরিয়ে একবার রাজপথের ধারে তাকালেই ধুলোয় ছড়িয়ে থাকা মাণিক্যের খোঁজ মেলে। তড়কা যে আদতে যেকোনো ডালেরই মশলাদার অলঙ্করণ সেই ধারণা ফেলে সবুজ গোটামুগের এক সিন্ধুপ্রদেশীয় তেজী পদ বাংলার মহলে পরিচিতি পেল তড়কা নামে। পেটরোগা অথচ ভোজনরসিক বাঙালীর রুচির সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে খানিক অদলবদলও হল। সম্ভবত শিখদের সাহসিকতা আর ক্ষিপ্র পাঞ্জাবি লরির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যার মূল উৎস হয়ে উঠল খোলা আকাশের নীচে উন্মুক্ত ধাবা। প্লাস্টিকের টেবিলচেয়ার-জলের জগ, পলকা বাসন ইত্যাদির সমাহারে অচলায়তন ছেড়ে যাবার ডাক। পাথেয় কেবল একখন্ড মলমলে রুমালি রুটি- কী অদ্ভুত দক্ষতায় ছোট্ট এক ময়দার তালকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আকাশের মত বড় করে তোলা! ক্ষুদ্রের কোটরেও যে অনন্তের সূত্র থাকে।
রাস্তার অধিকার কারো একলার নয়। যারা চিরকাল মূল খাদ্যতালিকায় অপাংক্তেয়, তাদের নিরুপায় ভিড় জমে পথেঘাটে। লেবুরঙ বিকেলে কলেজফেরত ছুটির পরিসরে ঘিরে ধরে মুখরোচক সব খুচরো খাবারের পসরা। খুচরো পয়সা যার দাম। তার না আছে পুষ্টিগুণ, না আছে ক্ষুধানিবৃত্তির ক্ষমতা। কেবল আছে অল্পক্ষণের চটক। খেসারির ডালের বড়া তার মধ্যে অন্যতম। প্রধানত গবাদি পশুর খাবার স্বল্পমূল্য খেসারির ডাল, যা মানুষের প্রত্যঙ্গে পক্ষাঘাতের অভিশাপ অবধি বয়ে আনতে পারে - এহেন সাবধানবাণী শুনে এসেছি অনেককাল। তাই মুগডালের বড়া বলেই সাধারণত বিক্রির চেষ্টা হয়ে থাকে। ভেজালের জমানায় যদিও বিষে ভয় করা অবান্তর। আবলুশ কাঠের পাত্রে সাজানো স্তূপাকৃতি ডালবাটা থেকে কিছুটা গণ্ডূষে তুলে নেওয়া, আর অসামান্য সংযমে আঙুলের ফাঁক থেকে একটু একটু করে পরিমাণমত খসিয়ে দেওয়া ফুটন্ত বাসি তেলের কড়াইয়ে। সারিবদ্ধ বড়ার ঝাঁক অতিরিক্ত স্নেহপদার্থ ঝেড়ে উঠে আসে পোক্ত হাতের ছান্তায় --- অন্য হাতে দ্রুত ভরে ওঠে খদ্দেরের ঠোঙা। যার মোহময় স্বাদের একমাত্র চাবিকাঠি ধুলোবালিঘাম।
একবার জীবনের তাগিদে পথে নেমে এলে বাছবিচার করার অভ্যাস কমে। যা কিছু ভালো লাগে তাকে আপন করে নেওয়াই তো দস্তুর। যেখানে ডাল মাত্রেই প্রোটিন, পরিভাষায় আমিষ। তাই কাবুলি চানাও এ তালিকায় স্থান করে নেয় অসংকোচে। সত্যিই এর আমদানি খাইবার পাস বেয়ে হয়েছিল কিনা তা জানা নেই। তবে খাবারের জাতমান বজায় রাখতে হামেশাই নিমন্ত্রণবাড়ীতে মূল খাদ্যপর্বের ভূমিকা হিসেবে চানা মশলার রেওয়াজ দেখে আসছি। পাশাপাশি বনস্পতির স্নেহধন্য ভারিক্কি এক বাটোরা/রাধাবল্লভী। সুস্বাদু, তবে আমার কাছে মন ভরবার আগেই উদরপূর্তির অপচেষ্টা মাত্র। সে তুলনায় দেশী ছোলা, যার ত্বক ক্রান্তীয় রোদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাদামী, রেসের ঘোড়া আর নিয়মিত শরীরচর্চা করা মানুষজনের গণ্ডি তেমন একটা পেরোতে পারেনি। অপ্রধান উপাদান হিসাবে থেকে গিয়েছে রাস্তার খাবারে। আজকাল ছোলার চাট খানিক উন্নতি করে ছোটোখাটো সম্মেলনের অন্যতম অংশ হয়েছে বটে, কিন্তু সেও ওই ক্ষুধাবর্ধকের আসন মাত্র, ভূরিভোজের পদমর্যাদা নয়। উল্লেখ্য, দেশী ছোলা আর কাবুলি চানাকে উত্তর ভারতে যথাক্রমে চানা ও ছোলে বলা হয়ে থাকে। এই উলটপুরাণের উৎস কী, তা যদিও আমার জানা নেই।
অন্যদিকে, বিউলির ডালের ব্যাপারে আমার দুর্বলতা অন্য জায়গায়। বড়ি। একরাত ভিজে থাকা ডালের শরীরে যখন নমনীয়তা ভর করে, অক্লান্ত নিপুণ কবজি তাকে শিলনোড়ায় পিষে আর ফেটিয়ে পরবর্তী পর্বের জন্য প্রস্তুত করে। যতখানি নিষ্ঠা, বড়ি হবে ততটাই ফাঁপা ও মুচমুচে। সেইসঙ্গে বিভিন্ন পদের উপযোগী মশলাপাতি যোগ করে ইচ্ছেমত বৈচিত্র্যবিলাস। অধিকাংশ কুটিরশিল্পের মতই বড়ির রূপবর্ণনায় নারীসুলভ সৌকর্যের উপমা আসে। সাধারণ বড়ি হবে তীক্ষ্ণনাসা ও তন্বী - আর গয়না বড়ি হতে হবে কারুকার্যময়। তারপরে খোলামেলা ছাদ, চাতাল বা উঠোনময় পর্যাপ্ত রোদের দাবি। কাপড়ের টুকরোয় সারিবদ্ধ সৈনিকের মত সযত্নে সাজিয়ে দেওয়া হয় বড়ি। এবং কড়া পাহারা, যাতে কাকপক্ষীতেও না ঠুকরে দেয়। এতসব বাধাবিপত্তি পেরিয়ে তবেই দিনের শেষে প্রাপ্তি। অন্য ডালের বড়ি যে হয় না, এমন নয়। তবে তাদের কেউই বিউলির কৌলিন্য অর্জন করতে পারেনি। এছাড়াও, ছাপোষা ঘরে লাল চালের ভাত-পোস্তর বড়া-বিউলির ডালের নির্ঝঞ্ঝাট সঙ্ঘ যে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার গৃহযুদ্ধের অন্যতম স্বাদু হাতিয়ার, তা একবারের জন্য হলেও উল্লেখ করতেই হয়।
প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের এই টানাটানি বহুকালের। তাই আফগানের চানার অনুপ্রবেশের প্রতিবাদে বর্মা থেকে এসে পড়ল ঘুগনি। ডালের গোত্রভুক্ত না হওয়ায় প্রায় চানা মশলার প্রণালীতেই সুডৌল হরিদ্রাভ মটরের এই পদ বাঙালীর একান্ত আপন হয়ে উঠল। স্থানবিশেষে তার আবার আলাদা খাতির। মেলার ঘুগনি থাকবে আধোয়া শালপাতার বাটিতে, মিটমিটে লণ্ঠন জ্বেলে কুচানো পেঁয়াজ-লঙ্কা-ধনেপাতা, ঝুরিভাজা আর তেঁতুল জল শোভিত হয়ে। মুকুটে নৈবেদ্যের মত অল্প বিটনুনের ছিটে। খাবারের গুণগত মানের চেয়েও যেখানে চেনামুখের ভিড় আর বিক্রেতার প্লুতস্বরের আকর্ষণ বেশী। অন্যদিকে, বিজয়ার অতিথিসৎকারে চীনেমাটির পাত্রে যে অমোঘ ঘুগনি আসে, তাতে গৃহকর্ত্রীর নৈপুণ্যই প্রধান বিচার্য্য হয়ে ওঠে। নেহাতই তরকারির অভাবে ঘুগনির সঙ্গে হাতরুটির চলও আছে, তবে সেখানে ঘুগনীর আভিজাত্য কতদূর বজায় থাকে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়।
নামবাচক বিশেষ্য যে কেবল উচ্চারণে নয়, নামেই বদলে যেতে পারে, একথা এড়িয়ে গেলে শুধুই ভিন্নতার ভ্রম হয়। বহুদিন আমার জানা ছিল না, কলাই/মাসকলাই আদতে বিউলির নামান্তর। কলাই বলতে আমি জেনে এসেছি ক্ষয়িষ্ণুতা নিয়ন্ত্রণে বাসনের ওপর একপ্রকার সংকর ধাতুর প্রলেপ। আবার দক্ষিণ ভারতে যা উড়াদ ডাল --- দোসা থেকে মেদুবড়া সমস্ত জনপ্রিয় খাদ্যবস্তুর সর্বেসর্বা।। যেমন জানা ছিল না তুয়র/তুভর আসলে অড়হরের অবঙ্গীয় জাতভাই। অন্যান্য ডালের অনুকরণে স্বাদবদলের স্বার্থে মাঝেমধ্যে এই ডালের প্রসঙ্গ ওঠে। যদিও আমার মত সর্বভূকের মতে বিশুদ্ধ অড়হরের স্বাদ এমন কিছু মনে রাখবার নয়। পুষ্টির অজুহাতে পাঁচমিশালি ডালের গাদায় ভিড় ট্রেনের চতুর্থ আসনের মত কোনমতে ঠাঁই নিয়েছে কেবল।
পরিচয়ের যে মৌলিক ভেদ, সেখান থেকেই মটর ডাল আর মটরের স্বাতন্ত্র্যের শুরু। কড়াইশুঁটিকে অধিকাংশ উত্তর ও পশ্চিম ভারতীয় ভাষায় মটর বলে ডাকা হয় বলেই বোধহয় গণ্ডগোলের উৎপত্তি। হরিমটর (হরিৎ মটর) যে আক্ষরিক তারুণ্যে ভরপুর সবুজ কড়াইশুঁটি, খাদ্যাভাবের রূপক নয়, এমনটা জেনে সামান্য হলেও বাগধারার সৌষ্ঠববোধ টাল খেয়েছিল। যাই হোক। মটর ডালের বড়া মূল খাদ্যের সহযোগী ভাজাভুজির মধ্যে অন্যতম, যদিও একেবারে প্রথম সারির হয়তো নয়। আর উচ্ছে বা করলার ব্যাপারে অনেকের যতই বিরূপ মনোভাব থাকুক, স্বাস্থ্যসম্মত সুস্বাদু পদ হিসাবে তেতোর ডালের কথা তো সর্বজনবিদিত।
অতঃপর, যখন সব নদী আর পাখী ঘরে ফেরে, বিয়োগফলে পড়ে থাকে শেষ অঙ্কের দৃশ্যপট।
সোনামুগডাল। বর্ষামুখর রাতে খিচুড়ির উপকরণ হিসাবে যার কদর কেবল অর্ধাঙ্গিনীর। তার আসল রূপ খোলে বিয়েবাড়ীর মধ্যাহ্নভোজে মুড়িঘন্টের ডালে। সঙ্গে জুঁইফুল ভাত। অনেকদিনের অসুস্থতার পর ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লে যেমন ঝরঝরে লাগে, তেমনি মুক্তকচ্ছ ধবল ভাত- যত্ন করে যা আঙুলে মেখে নেওয়া যায়। সন্ধ্যেবেলার চর্ব্যচোষ্যের আতিশয্যের মুখড়ায় এ একান্তই আত্মীয়তার আন্তরিক উদযাপন। অবশ্য অহিংস জনগোষ্ঠীর জন্য ফুলকপি-আলু-কড়াইশুঁটির সুযোগ্য বিকল্প থাকে। সকলের সঙ্গে পাত পেড়ে বসে খাবার যে ভরপেট আনন্দ, তা ছাড়া বোধহয় এই ডালের নবাবী স্বাদের ন্যায্য মূল্যায়ন হয় না।
নিজামতের কথা যখন উঠল, ছোলার ডালের কথা না বললেই নয়। নারকোলের ফিনফিনে টুকরো আর অর্ধচন্দ্রাকৃতি কাজুবাদামের বনেদিয়ানায় সে এক রাশভারী নৈবেদ্য। অবশ্য ঘিয়ে ভাজা ফুলকো লুচির সঙ্গত বিনা এই ঐশ্বর্য হৃদয়ঙ্গম করা মুশকিল। এই ডালে পড়ন্ত জমিদারী, শূন্য ঠাকুরদালান আর কাঁসার নকশি থালাবাটির চিত্রকল্প আছে। পরিবেশন যে ভুলতে বসা এক শিল্প- তা মনে করিয়ে দেওয়ার মেজাজ আছে। আমার ব্যক্তিগত মহাষ্টমীর দুপুর আর ভাইফোঁটার সকাল সেই ছোলার ডালের স্মৃতিতে সুবাসময়।
সিংহাসন থেকে চোখ ফিরিয়ে একবার রাজপথের ধারে তাকালেই ধুলোয় ছড়িয়ে থাকা মাণিক্যের খোঁজ মেলে। তড়কা যে আদতে যেকোনো ডালেরই মশলাদার অলঙ্করণ সেই ধারণা ফেলে সবুজ গোটামুগের এক সিন্ধুপ্রদেশীয় তেজী পদ বাংলার মহলে পরিচিতি পেল তড়কা নামে। পেটরোগা অথচ ভোজনরসিক বাঙালীর রুচির সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে খানিক অদলবদলও হল। সম্ভবত শিখদের সাহসিকতা আর ক্ষিপ্র পাঞ্জাবি লরির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যার মূল উৎস হয়ে উঠল খোলা আকাশের নীচে উন্মুক্ত ধাবা। প্লাস্টিকের টেবিলচেয়ার-জলের জগ, পলকা বাসন ইত্যাদির সমাহারে অচলায়তন ছেড়ে যাবার ডাক। পাথেয় কেবল একখন্ড মলমলে রুমালি রুটি- কী অদ্ভুত দক্ষতায় ছোট্ট এক ময়দার তালকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আকাশের মত বড় করে তোলা! ক্ষুদ্রের কোটরেও যে অনন্তের সূত্র থাকে।
রাস্তার অধিকার কারো একলার নয়। যারা চিরকাল মূল খাদ্যতালিকায় অপাংক্তেয়, তাদের নিরুপায় ভিড় জমে পথেঘাটে। লেবুরঙ বিকেলে কলেজফেরত ছুটির পরিসরে ঘিরে ধরে মুখরোচক সব খুচরো খাবারের পসরা। খুচরো পয়সা যার দাম। তার না আছে পুষ্টিগুণ, না আছে ক্ষুধানিবৃত্তির ক্ষমতা। কেবল আছে অল্পক্ষণের চটক। খেসারির ডালের বড়া তার মধ্যে অন্যতম। প্রধানত গবাদি পশুর খাবার স্বল্পমূল্য খেসারির ডাল, যা মানুষের প্রত্যঙ্গে পক্ষাঘাতের অভিশাপ অবধি বয়ে আনতে পারে - এহেন সাবধানবাণী শুনে এসেছি অনেককাল। তাই মুগডালের বড়া বলেই সাধারণত বিক্রির চেষ্টা হয়ে থাকে। ভেজালের জমানায় যদিও বিষে ভয় করা অবান্তর। আবলুশ কাঠের পাত্রে সাজানো স্তূপাকৃতি ডালবাটা থেকে কিছুটা গণ্ডূষে তুলে নেওয়া, আর অসামান্য সংযমে আঙুলের ফাঁক থেকে একটু একটু করে পরিমাণমত খসিয়ে দেওয়া ফুটন্ত বাসি তেলের কড়াইয়ে। সারিবদ্ধ বড়ার ঝাঁক অতিরিক্ত স্নেহপদার্থ ঝেড়ে উঠে আসে পোক্ত হাতের ছান্তায় --- অন্য হাতে দ্রুত ভরে ওঠে খদ্দেরের ঠোঙা। যার মোহময় স্বাদের একমাত্র চাবিকাঠি ধুলোবালিঘাম।
একবার জীবনের তাগিদে পথে নেমে এলে বাছবিচার করার অভ্যাস কমে। যা কিছু ভালো লাগে তাকে আপন করে নেওয়াই তো দস্তুর। যেখানে ডাল মাত্রেই প্রোটিন, পরিভাষায় আমিষ। তাই কাবুলি চানাও এ তালিকায় স্থান করে নেয় অসংকোচে। সত্যিই এর আমদানি খাইবার পাস বেয়ে হয়েছিল কিনা তা জানা নেই। তবে খাবারের জাতমান বজায় রাখতে হামেশাই নিমন্ত্রণবাড়ীতে মূল খাদ্যপর্বের ভূমিকা হিসেবে চানা মশলার রেওয়াজ দেখে আসছি। পাশাপাশি বনস্পতির স্নেহধন্য ভারিক্কি এক বাটোরা/রাধাবল্লভী। সুস্বাদু, তবে আমার কাছে মন ভরবার আগেই উদরপূর্তির অপচেষ্টা মাত্র। সে তুলনায় দেশী ছোলা, যার ত্বক ক্রান্তীয় রোদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাদামী, রেসের ঘোড়া আর নিয়মিত শরীরচর্চা করা মানুষজনের গণ্ডি তেমন একটা পেরোতে পারেনি। অপ্রধান উপাদান হিসাবে থেকে গিয়েছে রাস্তার খাবারে। আজকাল ছোলার চাট খানিক উন্নতি করে ছোটোখাটো সম্মেলনের অন্যতম অংশ হয়েছে বটে, কিন্তু সেও ওই ক্ষুধাবর্ধকের আসন মাত্র, ভূরিভোজের পদমর্যাদা নয়। উল্লেখ্য, দেশী ছোলা আর কাবুলি চানাকে উত্তর ভারতে যথাক্রমে চানা ও ছোলে বলা হয়ে থাকে। এই উলটপুরাণের উৎস কী, তা যদিও আমার জানা নেই।
অন্যদিকে, বিউলির ডালের ব্যাপারে আমার দুর্বলতা অন্য জায়গায়। বড়ি। একরাত ভিজে থাকা ডালের শরীরে যখন নমনীয়তা ভর করে, অক্লান্ত নিপুণ কবজি তাকে শিলনোড়ায় পিষে আর ফেটিয়ে পরবর্তী পর্বের জন্য প্রস্তুত করে। যতখানি নিষ্ঠা, বড়ি হবে ততটাই ফাঁপা ও মুচমুচে। সেইসঙ্গে বিভিন্ন পদের উপযোগী মশলাপাতি যোগ করে ইচ্ছেমত বৈচিত্র্যবিলাস। অধিকাংশ কুটিরশিল্পের মতই বড়ির রূপবর্ণনায় নারীসুলভ সৌকর্যের উপমা আসে। সাধারণ বড়ি হবে তীক্ষ্ণনাসা ও তন্বী - আর গয়না বড়ি হতে হবে কারুকার্যময়। তারপরে খোলামেলা ছাদ, চাতাল বা উঠোনময় পর্যাপ্ত রোদের দাবি। কাপড়ের টুকরোয় সারিবদ্ধ সৈনিকের মত সযত্নে সাজিয়ে দেওয়া হয় বড়ি। এবং কড়া পাহারা, যাতে কাকপক্ষীতেও না ঠুকরে দেয়। এতসব বাধাবিপত্তি পেরিয়ে তবেই দিনের শেষে প্রাপ্তি। অন্য ডালের বড়ি যে হয় না, এমন নয়। তবে তাদের কেউই বিউলির কৌলিন্য অর্জন করতে পারেনি। এছাড়াও, ছাপোষা ঘরে লাল চালের ভাত-পোস্তর বড়া-বিউলির ডালের নির্ঝঞ্ঝাট সঙ্ঘ যে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার গৃহযুদ্ধের অন্যতম স্বাদু হাতিয়ার, তা একবারের জন্য হলেও উল্লেখ করতেই হয়।
প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের এই টানাটানি বহুকালের। তাই আফগানের চানার অনুপ্রবেশের প্রতিবাদে বর্মা থেকে এসে পড়ল ঘুগনি। ডালের গোত্রভুক্ত না হওয়ায় প্রায় চানা মশলার প্রণালীতেই সুডৌল হরিদ্রাভ মটরের এই পদ বাঙালীর একান্ত আপন হয়ে উঠল। স্থানবিশেষে তার আবার আলাদা খাতির। মেলার ঘুগনি থাকবে আধোয়া শালপাতার বাটিতে, মিটমিটে লণ্ঠন জ্বেলে কুচানো পেঁয়াজ-লঙ্কা-ধনেপাতা, ঝুরিভাজা আর তেঁতুল জল শোভিত হয়ে। মুকুটে নৈবেদ্যের মত অল্প বিটনুনের ছিটে। খাবারের গুণগত মানের চেয়েও যেখানে চেনামুখের ভিড় আর বিক্রেতার প্লুতস্বরের আকর্ষণ বেশী। অন্যদিকে, বিজয়ার অতিথিসৎকারে চীনেমাটির পাত্রে যে অমোঘ ঘুগনি আসে, তাতে গৃহকর্ত্রীর নৈপুণ্যই প্রধান বিচার্য্য হয়ে ওঠে। নেহাতই তরকারির অভাবে ঘুগনির সঙ্গে হাতরুটির চলও আছে, তবে সেখানে ঘুগনীর আভিজাত্য কতদূর বজায় থাকে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়।
নামবাচক বিশেষ্য যে কেবল উচ্চারণে নয়, নামেই বদলে যেতে পারে, একথা এড়িয়ে গেলে শুধুই ভিন্নতার ভ্রম হয়। বহুদিন আমার জানা ছিল না, কলাই/মাসকলাই আদতে বিউলির নামান্তর। কলাই বলতে আমি জেনে এসেছি ক্ষয়িষ্ণুতা নিয়ন্ত্রণে বাসনের ওপর একপ্রকার সংকর ধাতুর প্রলেপ। আবার দক্ষিণ ভারতে যা উড়াদ ডাল --- দোসা থেকে মেদুবড়া সমস্ত জনপ্রিয় খাদ্যবস্তুর সর্বেসর্বা।। যেমন জানা ছিল না তুয়র/তুভর আসলে অড়হরের অবঙ্গীয় জাতভাই। অন্যান্য ডালের অনুকরণে স্বাদবদলের স্বার্থে মাঝেমধ্যে এই ডালের প্রসঙ্গ ওঠে। যদিও আমার মত সর্বভূকের মতে বিশুদ্ধ অড়হরের স্বাদ এমন কিছু মনে রাখবার নয়। পুষ্টির অজুহাতে পাঁচমিশালি ডালের গাদায় ভিড় ট্রেনের চতুর্থ আসনের মত কোনমতে ঠাঁই নিয়েছে কেবল।
পরিচয়ের যে মৌলিক ভেদ, সেখান থেকেই মটর ডাল আর মটরের স্বাতন্ত্র্যের শুরু। কড়াইশুঁটিকে অধিকাংশ উত্তর ও পশ্চিম ভারতীয় ভাষায় মটর বলে ডাকা হয় বলেই বোধহয় গণ্ডগোলের উৎপত্তি। হরিমটর (হরিৎ মটর) যে আক্ষরিক তারুণ্যে ভরপুর সবুজ কড়াইশুঁটি, খাদ্যাভাবের রূপক নয়, এমনটা জেনে সামান্য হলেও বাগধারার সৌষ্ঠববোধ টাল খেয়েছিল। যাই হোক। মটর ডালের বড়া মূল খাদ্যের সহযোগী ভাজাভুজির মধ্যে অন্যতম, যদিও একেবারে প্রথম সারির হয়তো নয়। আর উচ্ছে বা করলার ব্যাপারে অনেকের যতই বিরূপ মনোভাব থাকুক, স্বাস্থ্যসম্মত সুস্বাদু পদ হিসাবে তেতোর ডালের কথা তো সর্বজনবিদিত।
অতঃপর, যখন সব নদী আর পাখী ঘরে ফেরে, বিয়োগফলে পড়ে থাকে শেষ অঙ্কের দৃশ্যপট।
আপন দেশে নিজগৃহে স্বপাক শাকান্ন ভক্ষণের সৌভাগ্য আমাদের নেই। তবু, সমস্ত দিন মানবসভ্যতার কলুষ পেরিয়ে মহাজাগতিক ঘটনাবলীর চক্রব্যূহে লড়তে লড়তে দিনের শেষে যখন পায়রার খোপে ফিরে আসি, ফেনাভাত আর সুসিদ্ধ মুসুর ডালের উষ্ণ ধোঁয়া ওঠা ঘ্রাণ যাবতীয় ব্যর্থতা আর অনিশ্চয়তার ক্লান্তি একনিমেষে ঘুচিয়ে দেয়। সামান্য লবণ, একটুকরো গন্ধরাজ লেবু, কয়েককুচি পেঁয়াজ, আধপলা সর্ষের তেল, আর তরোয়ালের মত শাণিত একটি কাঁচালঙ্কা। যেখানে রাজকীয় ব্যঞ্জনের আড়ম্বর নেই, কিন্তু মমত্বের মলম আছে। নিশ্চিন্তে শ্বাস নেবার ফুরসত আছে- যেমনটা কুরুশের পাড় দেওয়া আসন আর হাতপাখার হাওয়ায় থাকে। কোনোদিন সময় করে উঠতে পারলে কালোজিরে ফোড়ন দেবার শৌখিনতাও আছে। কিংবা কড়া আঁচে ভেজে নেওয়া শুকনোলঙ্কা আর ভাঙা আংটির মত পেঁয়াজের ফালি - আলতো করে সেঁধিয়ে দেওয়া সেদ্ধ চন্দ্রমুখী আলুর তপ্ত জঠরে। শুধু একটুকরো কলাপাতার অভাববোধ করি-- ইস্পাতের পাত্রের সে হৃদয় নেই, যে নিজেকে পুড়িয়ে দিয়ে ভাতডালের দুর্বল সংসারে অপার্থিব আমেজ এনে দিতে পারে। এই সেই ডাল, যা আমিষের রূপকার্থে অশৌচের উপসংহার হিসাবে ব্যবহার হয়ে এসেছে চিরকাল...
এখানেই পালার যবনিকা পতন, আজকের মত। মন ও পৌষ্টিকতন্ত্রের মোক্ষলাভ হোক। ডালে ডালে রসনামঞ্চ গড়ে উঠুক।
এখানেই পালার যবনিকা পতন, আজকের মত। মন ও পৌষ্টিকতন্ত্রের মোক্ষলাভ হোক। ডালে ডালে রসনামঞ্চ গড়ে উঠুক।
Comments
Post a Comment