Skip to main content

ডাল-পালা


ডাল, আমবাঙালীর জীবনের অনিবার্য অংশ। যখন নিজেকেই সময় দেবার অবসর হয় না, সেইসব অতিব্যস্ত দিন থেকে শুরু করে ছুটির মেজাজে বিশেষ কোনো উদযাপন, সর্বত্র রূপে-গন্ধে-স্বাদে ইন্দ্রিয়সুখের ডালি নিয়ে তারা হাজির। সেইসব জড়ো করে এ অধম বুভুক্ষুর দু-চারটি প্রলাপ।  

সোনামুগডাল। বর্ষামুখর রাতে খিচুড়ির উপকরণ হিসাবে যার কদর কেবল অর্ধাঙ্গিনীর। তার আসল রূপ খোলে বিয়েবাড়ীর মধ্যাহ্নভোজে মুড়িঘন্টের ডালে। সঙ্গে জুঁইফুল ভাত। অনেকদিনের অসুস্থতার পর ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লে যেমন ঝরঝরে লাগে, তেমনি মুক্তকচ্ছ ধবল ভাত- যত্ন করে যা আঙুলে মেখে নেওয়া যায়। সন্ধ্যেবেলার চর্ব্যচোষ্যের আতিশয্যের মুখড়ায় এ একান্তই আত্মীয়তার আন্তরিক উদযাপন। অবশ্য অহিংস জনগোষ্ঠীর জন্য ফুলকপি-আলু-কড়াইশুঁটির সুযোগ্য বিকল্প থাকে। সকলের সঙ্গে পাত পেড়ে বসে খাবার যে ভরপেট আনন্দ, তা ছাড়া বোধহয় এই ডালের নবাবী স্বাদের ন্যায্য মূল্যায়ন হয় না।
  
নিজামতের কথা যখন উঠল, ছোলার ডালের কথা না বললেই নয়। নারকোলের ফিনফিনে টুকরো আর অর্ধচন্দ্রাকৃতি কাজুবাদামের বনেদিয়ানায় সে এক রাশভারী নৈবেদ্য। অবশ্য ঘিয়ে ভাজা ফুলকো লুচির সঙ্গত বিনা এই ঐশ্বর্য হৃদয়ঙ্গম করা মুশকিল। এই ডালে পড়ন্ত জমিদারী, শূন্য ঠাকুরদালান আর কাঁসার নকশি থালাবাটির চিত্রকল্প আছে। পরিবেশন যে ভুলতে বসা এক শিল্প- তা মনে করিয়ে দেওয়ার মেজাজ আছে। আমার ব্যক্তিগত মহাষ্টমীর দুপুর আর ভাইফোঁটার সকাল সেই ছোলার ডালের স্মৃতিতে সুবাসময়।   

সিংহাসন থেকে চোখ ফিরিয়ে একবার রাজপথের ধারে তাকালেই ধুলোয় ছড়িয়ে থাকা মাণিক্যের খোঁজ মেলে। তড়কা যে আদতে যেকোনো ডালেরই মশলাদার অলঙ্করণ সেই ধারণা ফেলে সবুজ গোটামুগের এক সিন্ধুপ্রদেশীয় তেজী পদ বাংলার মহলে পরিচিতি পেল তড়কা নামে। পেটরোগা অথচ ভোজনরসিক বাঙালীর রুচির সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে খানিক অদলবদলও হল। সম্ভবত শিখদের সাহসিকতা আর ক্ষিপ্র পাঞ্জাবি লরির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যার মূল উৎস হয়ে উঠল খোলা আকাশের নীচে উন্মুক্ত ধাবা। প্লাস্টিকের টেবিলচেয়ার-জলের জগ, পলকা বাসন ইত্যাদির সমাহারে অচলায়তন ছেড়ে যাবার ডাক। পাথেয় কেবল একখন্ড মলমলে রুমালি রুটি- কী অদ্ভুত দক্ষতায় ছোট্ট এক ময়দার তালকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আকাশের মত বড় করে তোলা! ক্ষুদ্রের কোটরেও যে অনন্তের সূত্র থাকে। 

রাস্তার অধিকার কারো একলার নয়। যারা চিরকাল মূল খাদ্যতালিকায় অপাংক্তেয়, তাদের নিরুপায় ভিড় জমে পথেঘাটে। লেবুরঙ বিকেলে কলেজফেরত ছুটির পরিসরে ঘিরে ধরে মুখরোচক সব খুচরো খাবারের পসরা। খুচরো পয়সা যার দাম। তার না আছে পুষ্টিগুণ, না আছে ক্ষুধানিবৃত্তির ক্ষমতা। কেবল আছে অল্পক্ষণের চটক। খেসারির ডালের বড়া তার মধ্যে অন্যতম। প্রধানত গবাদি পশুর খাবার স্বল্পমূল্য খেসারির ডাল, যা মানুষের প্রত্যঙ্গে পক্ষাঘাতের অভিশাপ অবধি বয়ে আনতে পারে - এহেন সাবধানবাণী শুনে এসেছি অনেককাল। তাই মুগডালের বড়া বলেই সাধারণত বিক্রির চেষ্টা হয়ে থাকে। ভেজালের জমানায় যদিও বিষে ভয় করা অবান্তর। আবলুশ কাঠের পাত্রে সাজানো স্তূপাকৃতি ডালবাটা থেকে কিছুটা গণ্ডূষে তুলে নেওয়া, আর অসামান্য সংযমে আঙুলের ফাঁক থেকে একটু একটু করে পরিমাণমত খসিয়ে দেওয়া ফুটন্ত বাসি তেলের কড়াইয়ে। সারিবদ্ধ বড়ার ঝাঁক অতিরিক্ত স্নেহপদার্থ ঝেড়ে উঠে আসে পোক্ত হাতের ছান্তায় --- অন্য হাতে দ্রুত ভরে ওঠে খদ্দেরের ঠোঙা। যার মোহময় স্বাদের একমাত্র চাবিকাঠি ধুলোবালিঘাম।

একবার জীবনের তাগিদে পথে নেমে এলে বাছবিচার করার অভ্যাস কমে। যা কিছু ভালো লাগে তাকে আপন করে নেওয়াই তো দস্তুর। যেখানে ডাল মাত্রেই প্রোটিন, পরিভাষায় আমিষ। তাই কাবুলি চানাও এ তালিকায় স্থান করে নেয় অসংকোচে। সত্যিই এর আমদানি খাইবার পাস বেয়ে হয়েছিল কিনা তা জানা নেই। তবে খাবারের জাতমান বজায় রাখতে হামেশাই নিমন্ত্রণবাড়ীতে মূল খাদ্যপর্বের ভূমিকা হিসেবে চানা মশলার রেওয়াজ দেখে আসছি। পাশাপাশি বনস্পতির স্নেহধন্য ভারিক্কি এক বাটোরা/রাধাবল্লভী। সুস্বাদু, তবে আমার কাছে মন ভরবার আগেই উদরপূর্তির অপচেষ্টা মাত্র। সে তুলনায় দেশী ছোলা, যার ত্বক ক্রান্তীয় রোদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাদামী, রেসের ঘোড়া আর নিয়মিত শরীরচর্চা করা মানুষজনের গণ্ডি তেমন একটা পেরোতে পারেনি। অপ্রধান উপাদান হিসাবে থেকে গিয়েছে রাস্তার খাবারে। আজকাল ছোলার চাট খানিক উন্নতি করে ছোটোখাটো সম্মেলনের অন্যতম অংশ হয়েছে বটে, কিন্তু সেও ওই ক্ষুধাবর্ধকের আসন মাত্র, ভূরিভোজের পদমর্যাদা নয়। উল্লেখ্য, দেশী ছোলা আর কাবুলি চানাকে উত্তর ভারতে যথাক্রমে চানা ও ছোলে বলা হয়ে থাকে। এই উলটপুরাণের উৎস কী, তা যদিও আমার জানা নেই।

অন্যদিকে, বিউলির ডালের ব্যাপারে আমার দুর্বলতা অন্য জায়গায়। বড়ি। একরাত ভিজে থাকা ডালের শরীরে যখন নমনীয়তা ভর করে, অক্লান্ত নিপুণ কবজি তাকে শিলনোড়ায় পিষে আর ফেটিয়ে পরবর্তী পর্বের জন্য প্রস্তুত করে। যতখানি নিষ্ঠা, বড়ি হবে ততটাই ফাঁপা ও মুচমুচে। সেইসঙ্গে বিভিন্ন পদের উপযোগী মশলাপাতি যোগ করে ইচ্ছেমত বৈচিত্র্যবিলাস। অধিকাংশ কুটিরশিল্পের মতই বড়ির রূপবর্ণনায় নারীসুলভ সৌকর্যের উপমা আসে। সাধারণ বড়ি হবে তীক্ষ্ণনাসা ও তন্বী - আর গয়না বড়ি হতে হবে কারুকার্যময়। তারপরে খোলামেলা ছাদ, চাতাল বা উঠোনময় পর্যাপ্ত রোদের দাবি। কাপড়ের টুকরোয় সারিবদ্ধ সৈনিকের মত সযত্নে সাজিয়ে দেওয়া হয় বড়ি। এবং কড়া পাহারা, যাতে কাকপক্ষীতেও না ঠুকরে দেয়। এতসব বাধাবিপত্তি পেরিয়ে তবেই দিনের শেষে প্রাপ্তি। অন্য ডালের বড়ি যে হয় না, এমন নয়। তবে তাদের কেউই বিউলির কৌলিন্য অর্জন করতে পারেনি। ছাড়াও, ছাপোষা ঘরে লাল চালের ভাত-পোস্তর বড়া-বিউলির ডালের নির্ঝঞ্ঝাট সঙ্ঘ যে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার গৃহযুদ্ধের অন্যতম স্বাদু হাতিয়ার, তা একবারের জন্য হলেও উল্লেখ করতেই হয়।

প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের এই টানাটানি বহুকালের। তাই আফগানের চানার অনুপ্রবেশের প্রতিবাদে বর্মা থেকে এসে পড়ল ঘুগনি। ডালের গোত্রভুক্ত না হওয়ায় প্রায় চানা মশলার প্রণালীতেই সুডৌল হরিদ্রাভ মটরের এই পদ বাঙালীর একান্ত আপন হয়ে উঠল। স্থানবিশেষে তার আবার আলাদা খাতির। মেলার ঘুগনি থাকবে আধোয়া শালপাতার বাটিতে, মিটমিটে লণ্ঠন জ্বেলে কুচানো পেঁয়াজ-লঙ্কা-ধনেপাতা, ঝুরিভাজা আর তেঁতুল জল শোভিত হয়ে। মুকুটে নৈবেদ্যের মত অল্প বিটনুনের ছিটে খাবারের গুগত মানের চেয়েও যেখানে চেনামুখের ভিড় আর বিক্রেতার প্লুস্বরের আকর্ষণ বেশী। অন্যদিকে, বিজয়ার অতিথিসৎকারে চীনেমাটির পাত্রে যে অমোঘ ঘুগনি আসে, তাতে গৃহকর্ত্রীর নৈপুণ্যই প্রধান বিচার্য্য হয়ে ওঠেনেহাতই তরকারির অভাবে ঘুগনির সঙ্গে হাতরুটি চলও আছে, তবে সেখানে ঘুগনীর আভিজাত্য কতদূর বজায় থাকে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়।  
 
নামবাচক বিশেষ্য যে কেবল উচ্চারণে নয়, নামেই বদলে যেতে পারে, একথা এড়িয়ে গেলে শুধুই ভিন্নতার ভ্রম হয়। বহুদিন  আমার জানা ছিল না, কলাই/মাসকলাই আদতে বিউলির নামান্তর। কলাই বলতে আমি জেনে এসেছি ক্ষয়িষ্ণুতা নিয়ন্ত্রণে বাসনের ওপর একপ্রকার সংকর ধাতুর প্রলেপ। আবার দক্ষিণ ভারতে যা উড়াদ ডাল --- দোসা থেকে মেদুবড়া সমস্ত জনপ্রিয় খাদ্যবস্তুর সর্বেসর্বা।। যেমন জানা ছিল না তুয়র/তুভর আসলে অড়হরের অবঙ্গীয় জাতভাই। অন্যান্য ডালের অনুকরণে স্বাদবদলের স্বার্থে মাঝেমধ্যে এই ডালের প্রসঙ্গ ওঠে। যদিও আমার মত সর্বভূকের মতে বিশুদ্ধ অড়হরের স্বাদ এমন কিছু মনে রাখবার নয়। পুষ্টির অজুহাতে পাঁচমিশালি ডালের গাদায় ভিড় ট্রেনের চতুর্থ আসনের মত কোনমতে ঠাঁই নিয়েছে কেবল।  

পরিচয়ের যে মৌলিক ভেদ, সেখান থেকেই মটর ডাল আর মটরের স্বাতন্ত্র্যের শুরু। কড়াইশুঁটিকে অধিকাংশ উত্তর ও পশ্চিম ভারতীয় ভাষায় মটর বলে ডাকা হয় বলেই বোধহয় গণ্ডগোলের উৎপত্তি। হরিমটর (হরিৎ মটর) যে আক্ষরিক তারুণ্যে ভরপুর সবুজ কড়াইশুঁটি, খাদ্যাভাবের রূপক নয়, এমনটা জেনে সামান্য হলেও বাগধারার সৌষ্ঠববোধ টাল খেয়েছিল। যাই হোক। মটর ডালের বড়া মূল খাদ্যের সহযোগী ভাজাভুজির মধ্যে অন্যতম, যদিও একেবারে প্রথম সারির হয়তো নয়। আর উচ্ছে বা করলার ব্যাপারে অনেকের যতই বিরূপ মনোভাব থাকুক, স্বাস্থ্যসম্মত সুস্বাদু পদ হিসাবে তেতোর ডালের কথা তো সর্বজনবিদিত।   

অতঃপর, যখন সব নদী আর পাখী ঘরে ফেরে, বিয়োগফলে পড়ে থাকে শেষ অঙ্কের দৃশ্যপট।

আপন দেশে নিজগৃহে স্বপাক শাকান্ন ভক্ষণের সৌভাগ্য আমাদের নেই। তবু, সমস্ত দিন মানবসভ্যতার কলুষ পেরিয়ে মহাজাগতিক ঘটনাবলীর চক্রব্যূহে লড়তে লড়তে দিনের শেষে যখন পায়রার খোপে ফিরে আসি, ফেনাভাত আর সুসিদ্ধ মুসুর ডালের উষ্ণ ধোঁয়া ওঠা ঘ্রাণ যাবতীয় ব্যর্থতা আর অনিশ্চয়তার ক্লান্তি একনিমেষে ঘুচিয়ে দেয়। সামান্য লবণ, একটুকরো গন্ধরাজ লেবু, কয়েককুচি পেঁয়াজ, আধপলা সর্ষের তেল, আর তরোয়ালের মত শাণিত একটি কাঁচালঙ্কা। যেখানে রাজকীয় ব্যঞ্জনের আড়ম্বর নেই, কিন্তু মমত্বের মলম আছে। নিশ্চিন্তে শ্বাস নেবার ফুরসত আছে- যেমনটা কুরুশের পাড় দেওয়া আসন আর হাতপাখার হাওয়ায় থাকে। কোনোদিন সময় করে উঠতে পারলে কালোজিরে ফোড়ন দেবার শৌখিনতাও আছে। কিংবা কড়া আঁচে ভেজে নেওয়া শুকনোলঙ্কা আর ভাঙা আংটির মত পেঁয়াজের ফালি - আলতো করে সেঁধিয়ে দেওয়া সেদ্ধ চন্দ্রমুখী আলুর তপ্ত জঠরে। শুধু একটুকরো কলাপাতার অভাববোধ করি-- ইস্পাতের পাত্রের সে হৃদয় নেই, যে নিজেকে পুড়িয়ে দিয়ে ভাতডালের দুর্বল সংসারে অপার্থিব আমেজ এনে দিতে পারে। এই সেই ডাল, যা আমিষের রূপকার্থে অশৌচের উপসংহার হিসাবে ব্যবহার হয়ে এসেছে চিরকাল...   

এখানেই পালার যবনিকা পতন, আজকের মত।  মন ও পৌষ্টিকতন্ত্রের মোক্ষলাভ হোক। ডালে ডালে রসনামঞ্চ গড়ে উঠুক।

Comments

Popular posts from this blog

হে সই-সব,

আমিও যে কোনোকালে শিশু ছিলাম, আর প্রতিটি দিন বাঙ্ময় শিশুদিবস ছিল, তার প্রমাণ এই নিম্নোল্লিখিত 'কবিতা'গুচ্ছ।  জীবনবিমার কোম্পানি প্রতি বছর একটা করে ডাইরি দিত, কীজানি কার বারোমাস্যা লিখবার প্রেরণা। তার পাতায় পাতায় রীতিমত তারিখ দিয়ে, চার-পাঁচ লাইন জুড়ে জুড়ে ঈগলের ঠ্যাঙের মত হাতের লেখায় আমি হিজিবিজি জমিয়ে রাখতাম। আবার ভাবতুম পেন্সিলের কোম্পানির নাম কেন বেছে বেছে অপ্সরা বা নটরাজ হয়, আর খাতার কোম্পানি গুডবয়। তখন ধারণা ছিল, পৃথিবীর (একেবারে বিশ্বস্তরে না ভাবলে ঠিক সেই গুরুত্বটা অনুধাবন করা মুশকিল হয়ে যেত) স-ম-স্ত কবিতাই আট পংক্তির। ফলতঃ, সেই সাড়ে চার বছর বয়সে মৌলিক কিছু একটা লেখবার চেষ্টা করে দেখা গেল, "উঠল বাউল সকালেতে একতারাটি নিয়ে, একতারাটি পরের দিনই হায়রে, ভেঙে গিয়ে সে ভাঙা মনে কাঁদতে গেল বনের ধারে গিয়ে- " ছ'লাইনের বেশী এগোল না। এর পরে কী হওয়া উচিৎ কিছুতেই বুঝতে পারলাম না। আমার লেখা প্রথম 'কবিতা' একটি সার্থক ছোটগল্প হতে হতেও হল না।   এর পরেরটা সম্ভবত সদ্য উপেন্দ্রকিশোর পড়বার ফল। প্রথম শ্রেণীতে পড়তে বাংলা আর ইংরেজি ক্ল...

ল্যাদকথন: একটি শনিবাসরীয় চলভাষালাপ

[সময়কাল ও স্থান: অপ্রাসঙ্গিক। ল্যাদ স্থানকালাতীত।]  আমি: হ্যাঁ বলো। মা: কী করছিস? আমি এই একটু দুধচা করলাম, চিনিছাড়া। [স্লা......র্প]  (রোজ এইভাবেই কথোপকথন শুরু হয়)  আমি: এই একটু লেবুচা আর ল্যাদ খাচ্ছি। মা: অ্যাঁ! কী খাচ্ছিস? আমি: ল্যাদ, ল্যাদ।  মা: (কীরকম একটা দ্বিধান্বিত গলায়) বুঝতে পারছিনা। (ঘাড় ঘুরিয়ে বাবাকে) টিভিটা কমাও না! সারাদিন চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খবর দেখেই যাচ্ছে! তুমুন একটা নতুন খাবারের নাম বলল, ঠিক করে শুনতেই পেলাম না।  আমি: !!!!!!! মা: (এবার আমার দিকে ফিরে) হ্যাঁ বল।  আমি:  নতুন খাবার আবার কী? বললাম তো ল্যাদ।  মা: ও! আমেরিকান খাবার?  আমি: উফফ এতে আমেরিকান কোত্থেকে এল? আশ্চর্য্য! ল্যাদ জানো না? মা: (খচে গিয়ে) তোরা আজকাল কী খাস কী বলিস আমি বুঝতে পারি না। বিদেশী খাবারের নাম আমি কীকরে জানব?  আমি: বারবার বলছি এটা খাবার না। ল্যাদ। বুঝেছো? লয়ে যফলা আকার - ল্যাদ।  মা: (ভুরু কুঁচকে) মানে? আমি: ল্যাদ মানে ল্যাদ। এইটা না বোঝার কী আছে?  মা: (ভীষণ কাঁইমাই করে) ধুর আমি বুঝতে পারছি না। আমি কি অ...

খুকির প্রত্যাবর্তন, ও ধন্যবাদগাথা

সেই সময়ের কথা। যখন পাশের পাড়াকে মনে হত পৃথিবীর শেষ প্রান্ত, আর মাসিক পত্রিকার শিশুবিভাগে কাঁচাহাতের গল্প-কবিতা লিখে পাঠাবার সময় বাদামী খামের বাঁদিকে গোটা গোটা অক্ষরে লিখতাম "প্রযত্নে.. বাবার নাম"। যখন যাবতীয় সৃষ্টিশীল শিল্পচর্চার বিপরীতে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানকে মনে হত গম্ভীর প্রাণহীন ব্যাপারস্যাপার; অন্যদিকে কল্পবিজ্ঞান আর খবরের কাগজে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কথা পড়ে রুশদেশী উপকথার অজানি-দেশের-না-জানি-কী এর মত অদ্ভুত ঘোরলাগা রোমাঞ্চ হত। তালগোল পাকিয়ে যেত সব। যখন বিদেশ মানে আমার কাছে বাংলার বাইরের সমগ্র বিশ্ব - কোনোকালেই যার ধারেকাছে পৌঁছানো হবে না আমার। এইসব ছাইপাঁশ ভাবতে ভাবতে যখন শীতের নিস্তব্ধ দুপুর বা গরমের ভ্যাপসা বিকেলে স্কুলের বারান্দায়-পার্কের মাঠে এমনকি জনবহুল বাজারহাটেও কেমন করে যেন নিজের মধ্যে ভীষণভাবে একা হয়ে যেতাম। অন্তরীপের মত।  তারপর, জীবন গিয়েছে চলে একটি দশক পার। যেসব মানুষের সাথে প্রতিদিন কথাবার্তা হয়, যাদের ওপর আমার দৈনন্দিন যাপন অনেকখানি নির্ভর করে থাকে, সেইসব মুখ বদলেছে। নতুন মুখের ভিড়ে ছোট্ট...

আলোকমঞ্জীর

।১। বিনোদিনীর ঘুম ভাঙে ভোরবেলায়। ছোট্টবেলাকার অভ্যেস। গেরামে বেড়ে উঠলে যেমনটি হয়। সেই যে গো, গাঁয়ের নামটি অঞ্জনা আর নদীর নামটি খঞ্জনা। ভাদ্দরমাস পেরোল কি পেরোল না, সেখেনে ভোরের দিকে হিম পড়ে। আর সারারাত ধরে টুপটাপ ঝরে পড়ে শিউলি। তার বুকের কাছটা ভোরের সুয্যির মত টকটকে কমলা। এতো সন কেটে গেল, সেই শিরশিরে হাওয়াটুকু রয়ে গেছে অমলিন। আর আছে বালিকাবেলার কড়ি ও কোমল। বিনোদিনী, আর তার শিউলিফুল পাতানো সই, স্নেহলতা। তাদের কোঁচড় ভর্তি শিশিরভেজা ফুল। ঘাটের কাছে ছলাৎ ছল, গল্প বলে নদীর জল। এমনি সময় নাম না জানা কোনো পাখি ডেকে উঠলেই বিনোদিনীর অবুঝ  মন  উথালপাথাল করে ওঠে...  ।২। নতুন পাড়ায় আসার পর  থেকে ভাবনার একটাও বন্ধু হয়নি। উফ, এরা আবার কীনা পাড়াকে বলে সোসাইটি। ভাবনা ওদের চেয়ে ঢের বেশী ইংলিশ স্টোরিজ পড়ে, তাই বলে কি ওরকম থেমে থেমে বেঙ্গলি বলে? এমা, না না, বেঙ্গলি না, বাংলা। ওদের পাশের ফ্ল্যাটের দিদুন কেমন মিষ্টি মিষ্টি বাংলা বলে, ওর মা তো অমনি বলে না। দিদুন বলে কিনা, মা তোমার ...

আলু-থালু

মেয়েটিকে একলা দেখে প্রৌঢ়া সহযাত্রিণী শুধোলেন, তাঁদের পরিবারের সঙ্গে রাতের খাবার ভাগ করে খেতে তার কোনো আপত্তি আছে কীনা। বাড়ী থেকে বানিয়ে আনা গরম খাবার, একেবারেই সাদামাটা; তবে সঙ্গে বাচ্চা ও বয়স্ক মানুষ আছে- তারা প্যান্ট্রির হাবিজাবি খেতে পারেনা। আর স্টেশনে দাঁড়ালেই খুচরো ভাজাভুজি মুখরোচক যা বিক্রি করতে আসে তার গুণমান তো কহতব্য নয়। একা মানুষের অবশ্য রান্না করে আনা ভারী ঝক্কি।    এর আগে মেয়েটিকে নিয়ে একপ্রস্থ আলোচনা হয়েছে ট্রেনের কুপে। ঢলঢলে টিশার্ট আর অনেকগুলো পকেটওয়ালা প্যান্ট, উবুঝুঁটি, মশমশে কেডস, ঢাউস ব্যাগপত্তর, তার ওপর এই দেড়দিনের দীর্ঘ যাত্রায় সঙ্গীহীন - এমন অসৈরণ ব্যাপার তাঁদের ছেলেবেলায় দেখা যেত না। আধুনিক না ছাই! ভয়ডর নেই মনে - সংস্কারের ঘটশ্রাদ্ধ করে ছেড়েছে। আর খাবারেরও বলিহারি - কীসব বার্গার-চিপ্স-আলুভাজা হ্যানাত্যানা! এইজন্যই অমন ঘাড়েগর্দানে একাকার। মেয়েমানুষ নয় একটু ভারী চেহারা হওয়া ভালো, তা বলে এতটা! মেয়েটি হেডফোনের আড়াল থেকে গুঞ্জনের আভাস পেয়েছে, আর করুণায় হেসেছে। সনাতনী আর সেকেলের মধ্যেকার কয়েক যোজন দূরত্ব যারা দেখতে পায়নি, তাদের অভিধ...

অসংলগ্ন

জ্বরের ঘোরে সবকিছু অন্যরকম লাগে। কপাল জুড়ে কাঠকয়লার উনুন। ওমের বদলে ছ্যাঁকা। মর্গের মতো ভয়াল ঠান্ডা হাতপায়ের তালু। লক্ষণ সুবিধের নয়।  ইন্দ্রিয়ের আশেপাশে শেকল পড়ে গ্যাছে। অবসাদের চেয়েও ভারী। বা শান্তিনিকেতনী শাল। আরো ওজনদার। শাল বলতে আবার বনেদী কাঠের কথা মনে আসে। নিরক্ষীয় বর্ষাপ্রবণ অঞ্চলের আদিম মহারণ্য। ঘন, অন্ধকার। কারাগারের কুঠুরির মতো। চেনা আসবাব, দৈনন্দিন ব্যবহার্য সালভাদর দালির চিত্রকল্পের মতো, ধনুষ্টঙ্কারের যন্ত্রণার মতো গলে পড়তে থাকে এঁকেবেঁকে। সাততলার জানলার জাল দিয়ে রাতের নাগরিক আকাশ বা রাজপথ অলস আলকাতরার মতো কালো মনে হয়। ঘর গরম রাখার যন্ত্রে একঘেয়ে আওয়াজ। শ্রুতিনির্বন্ধ। ঝিঁঝির ডাকের মত আচ্ছন্ন লাগে। ঘর্মক্লান্ত গরমের দিনে পুরোনো পাখার আওয়াজে যেমন ঝিম ধরে আসতো। বেসিনে জল পড়ার শব্দ শুনে নোঙর মাস্তুল ডিঙি নৌকার কথা মনে পড়ে। ইন্দ্রনাথের কথা, হাকলবেরি ফিনের কথা, ফটিকচাঁদের কথা। অপক্ক হাতে দিনান্তের সৈকতে তাজা মাছ কেনাবেচার প্যাস্টেল ছবি আঁকার কথা।  খিদিরপুর  ডকে প্রথমবার বাণিজ্যিক জাহাজ...

বীণা ও বাণী

তথাকথিত আস্তিকতা বলতে যা বোঝায়, কোনোকালেই আমার তা ছিল না। আমাদের ঘরে সন্ধ্যেবেলার শাঁখবাতি নেই, নীলষষ্ঠীর উপোস নেই। ভাস্কর্য আর মৃৎশিল্পের নিদর্শন স্বরূপ বুদ্ধ-খৃষ্ট-নানকের মূর্তি সাজানো আছে। প্রাচীন সাহিত্যের অংশ হিসাবে ধর্মগ্রন্থ আছে। দেশবিদেশের সনাতন লোকাচারের ইতিহাস জানবার, এবং যুক্তিহীন বিশ্বাসজনিত আনুগত্যের অভ্যাসকে অতিক্রম করেও তাকে যথাসম্ভব নিরপেক্ষভাবে সম্মান করার শিক্ষাটুকু আছে। আছে হালখাতায় বাংলা বর্ষপঞ্জী সংগ্রহ। ঈদের বিরিয়ানি আর ফিরনির যুগলবন্দীতে জন্নতলাভ। চৌকাঠে আর ছাদে হেমন্তের শিরশিরে হাওয়া উপেক্ষা করে দীপাবলির মোমবাতি জ্বালানো আছে। আলো ভাগ করে নেবার আকুলতা আছে, আলোয় ফেরবার আর্তি আছে। আর আছে সরস্বতীপুজো, ঘরকুনো মুখচোরা কিশোরীর একমাত্র আপন উৎসব। সহপাঠিনীর ছোট্ট ফোকলা ভাইবোন, চাঁদা চাইতে এসে বানান বলতে গিয়ে ঘাবড়ে যাওয়া পাড়ার সমিতির ছেলেছোকরা, বা নির্বিবাদী গৃহপরিচারিকার অনভ্যস্ত উচ্চারণে শৈশবেই আমার পিতৃমাতৃদত্ত নামের দৈবী উত্তরণ ঘটেছিল। তারপর আর নিজের সারসত্য সন্ধানে বেরিয়ে পড়া ছাড়া উপায় ছিল না। সেই শুরু আজন্মের সারস্বত সাধনার। আমি চিরকাল কমপ্ল্যান আর আধগ্রাস ...

টাঙলা

বাংলা শব্দে গোলগাল একটা ব্যাপার আছে। যেমন অক্ষর, তেমনি ধ্বনি। মাত্রা টেনে বর্ণমালা গাঁথবার রীতি দেবনাগরীতেই ছিল। কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত তীক্ষ্ণতার বদলে বাংলা অক্ষরে যা আছে তা হল কোমলতা, স্নিগ্ধতা, শান্ত নিবিড় একটা ভাব। শাপলার ডাঁটা, ফলসার থোক, শালিধানের চিঁড়ে বা কুবোপাখির ডাক ভাবলে যেমনটা হয়। সংস্কৃত শব্দে যুক্তাক্ষরের ঝঙ্কারে আভিজাত্য আছে, দৃপ্ত গৌরব আছে, প্রচ্ছন্ন অহংও বুঝি আছে। বাংলায় সেই যুক্তবর্ণকে বেণীপুতুলের মত-মেটে কুঁজোর মত-কেঠো ঘোড়ার মত গড়েপিটে-ছেঁচে-ডেবে নেওয়া হয়েছে; যাতে ধার কম, স্বরের আধার বেশী। তাই ব-ম-য-ফলায় (যেমন- নিঃস্ব, পদ্ম, সখ্য ইত্যাদি) স্বতন্ত্র বর্ণের আঘাতের বদলে দ্বিত্বব্যঞ্জনে জিভকে আরাম দেবার একটা আলসে চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। আলসে অবশ্য কোঠাবাড়ির ছাদেরও হয়, যেখানে নুনহলুদ ছোপ ফুলছাপা শাড়ির পাশে আচারের বয়াম ঝিমোয়। যেমন অক্ষর, তেমনি ধ্বনি। এঁটেল মাটির মত ভিজে ভিজে, হেঁটে গেলে যাতে পদচিহ্ন পড়ে। তার ওপর দিয়ে ধুলো উড়িয়ে টগবগিয়ে ঘোড়সওয়ার যায় না, পদাতিক কাহারের কাঁধে পালকি যায় দুলকি চালে। তা বলে কি একেবারেই তেজ ন...

শেষবারের মতো

অ - নে - ক দিন পরে।    হাওড়া স্টেশনে ট্রেন ঢুকবে কিছুক্ষণের মধ্যে। সাঁতরাগাছি পেরোনোর পরেই সকলের একটু একটু করে মালপত্র নামাবার ব্যস্ততা। আমার দুটো মাত্র ছোটো ছোটো ব্যাগ , তাই মটকা মেরে পড়ে থাকব। নীচের বার্থ হলে পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাব , অন্ধকারের ঘনত্ব থেকে বুঝে নেব ট্রেন কত লেট ( ঠিকঠাক সময়ে চললে সে ট্রেন অন্তত ভারতীয় নয় ) । লোকজন সারি বেঁধে দরজার কাছে জড়ো হতে থাকবে। যাদের সঙ্গে জিনিস বেশী তাদের উৎকণ্ঠাও বেশী। দূরপাল্লার ট্রেন সাধারণত নির্দিষ্ট কিছু প্ল্যাটফর্মেই আসে , তাই প্ল্যাটফর্মের নম্বর আন্দাজ করতে পারার বাহাদুরি এখানে খাটবে না। ট্রেনের এক একটা কামরা প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে থাকবে , আ র দক্ষ অভিজ্ঞ মালবাহীরা লাফ দিয়ে উঠেই দরদাম করতে শুরু করে দেবে। দু - পাঁচ টাকা নিয়েও দর হবে   বোধহয়।  শিল্প যত সূক্ষ্ম হয় ততই তার কদর বেশী ।   আমিও এর মধ্যে চোখটোখ কচলে উঠে বসব। অত রাতে " মন্দ্রিত করিয়া তোলে জীবনের মহামন্ত্রধ্বনি"   এইসব ভেবেটেবে মন ভালো হয়ে যাবে।    সকলে যখন সমস্ত মালপত্রের সঙ্গে দলের বাদবাকিদের গুনে নিতে ব্যস্ত , ট্রেন থেকে নেমে আমি চলমা...

পাড়া

ঘর-বারান্দা, বাড়ী, পাঁচিলের চৌহদ্দি। ছোটোখাটো বস্তি। সারিসারি জবরদখল হয়ে যাওয়া সরকারী খাসজমি। রেশন, তেলেভাজা-বইখাতা-বাসন আর মনিহারির দোকান, মুদিখানা, বস্ত্রালয়, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। দুবেলা সব্জী আর মাছের অস্থায়ী বাজার। খেলার মাঠ, পার্ক, বাঁধানো রক, ক্লাবঘর। পুরসভা বা পঞ্চায়েতের ব্লকের ভেতরে একখন্ড রাজনৈতিক সংজ্ঞাহীন অঞ্চল, স্বতন্ত্র সভ্যতা। তথাকথিত আত্মীয়তার ঊর্ধ্বে, নিছক পরিচয়ের সূত্রে গড়ে ওঠা স্বাজাত্যবোধ। পাড়া। সবাই সবার খোঁজ রাখে। পথেঘাটে দোকানবাজারে নিতান্ত সাধারণ বারোমাস্যার আদানপ্রদান। ডিগ্রী পাশ বা চাকরির খবরে স্বস্তি আসে, বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে রক্ষণশীল গুঞ্জন ওঠে, সুস্থসবল সন্তানের জন্মে খুশীর হাওয়া বয়। রাতবিরেতে শ্মশানবন্ধু জোগাড় করতে কখনো বেগ পেতে হয় না। সন্ততিত্যজ্য অশীতিপর বৃদ্ধা, কিঞ্চিৎ মানসিক ভারসাম্যহীন অবিবাহিতা প্রৌঢ়া বা বহুজনের সংসারে এককোণে খুদকুঁড়োর মত পড়ে থাকা স্নায়ুরোগাক্রান্ত যুবকের পারিবারিক ইতিহাস ছাপোষা জনজীবনে দুশ্চিন্তা, সহানুভূতি আর অনিশ্চয়তাবোধের সঞ্চার করে। কেউ বাড়ী বিক্রি কর...