আদিকাল থেকে যেসকল ধর্মচর্চা বিবর্তনের অলিগলি আর মহাসড়ক পেরিয়ে আজও বেঁচেবর্তে আছে, তার মধ্যে অন্যতম হিন্দুধর্ম। কোনো মহামান্য প্রচারকের মতবাদ ও বাণীর ঊর্ধ্বে নেহাতই দৈনন্দিন অভ্যাসে গড়ে ওঠা সনাতনী সংস্কার, যাকে পরবর্তীকালে একাধিক বিরুদ্ধ ও সংশোধিত ধর্মাধর্মের পাশাপাশি খানিক অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই 'ধর্ম' হিসাবে শনাক্ত করা হয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত মহাদেশেই নদীমাতৃক প্রাচীন সভ্যতায় পঞ্চভূতের আরাধনার রীতি ছিল। আর ছিল গুণ ও ঋপুর একনিষ্ঠ তপস্যা। একান্তই স্বাভাবিক প্রবৃত্তিজাত বিশ্বাস, তা থেকে সংগঠিত নিয়মনীতি। নিজেদের অসাধ্য যা কিছু, তা-ই অতিপ্রাকৃত, দৈব। তবু, বিমূর্ত ও অখন্ড ধারণাকে সহজবোধ্য করতে যখন ঈশ্বরের দরবারেও শ্রমবিভাজন হল, আর তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তৈরী হল সাকার সঙ্কেত, কল্পনার যাবতীয় স্পর্ধায় ভিড় করে এল মানুষ ও অন্যান্য পশুপাখির আদল। উপাসনার নামে শুরু হল গভীর আত্মবীক্ষণ। নিজের সামর্থ্যের পরিধি বিশ্লেষণের অনন্তযাত্রা। প্রজ্ঞা আর চেতনার আলো সেই উন্নয়নের পথে একমদ্বিতীয় হাতিয়ার। আশ্চর্য্যের বিষয়, প্রায় সমস্ত পিতৃতান্ত্রিক সমাজেই প্রকৃতির পাশাপাশি জ্ঞান ও শিল্পকলার প্রতীক হিসাবে চিরকাল নারীমূর্তির আধিপত্য।
সিন্ধু-সরস্বতীর উপত্যকায় সহস্রাব্দ পূর্বের মানুষজনও এর ব্যতিক্রম ছিল না। তার ওপর মহিলাকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থা, যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। নদীর নামে নগরসভ্যতা, নদীর নামেই দেবী। সর্বার্থে মাতৃবন্দনা। সেই শ্বেতপদ্মাসনার জ্যোতির্ময়ী লালিত্য ক্রমে ক্রমে ছড়িয়ে পড়ল পূর্বে আর দক্ষিণে। আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের প্রভাবে তার বহিরঙ্গের রূপ বদলাল, কিন্তু অন্তরের অকৃত্রিম দীপ্তির কোনো পরিবর্তন হল না।
এদিকে, আদিবাসী ও বহিরাগত বহুবিধ জনগোষ্ঠীর অনন্য সংমিশ্রণ বঙ্গভূমির নিজস্ব ঐতিহ্য বলতে কিছু ছিল না। ছিল কেবল যত্ন করে নতুন পরিচয় গড়বার আকুল নিজস্বতা। ধর্মের নামে প্রচলিত নীরস আচারবিচার ও কৃচ্ছ্রসাধনকে অতিক্রম করে ঈশ্বরের সঙ্গে আত্মীয়তার সাহস, মানসসঞ্জাত প্রতিমার কাঠামোয় মানুষেরই প্রতিবিম্ব খুঁজে ফেরবার আপাতধৃষ্টতা আর কেউ দেখিয়েছে কিনা তা তর্কসাপেক্ষ।। এরই সঙ্গে সঙ্গে গড়ে উঠেছে বিশ্বসংস্কৃতির বিপুল বৈচিত্র্যকে সাদরে আত্মীকরণ করবার, ভিন্নতার ঐশ্বর্যকে কদর করবার দামাল শখ ও ঘরোয়া অধ্যবসায়। পেশাগত দায়বদ্ধতার বাইরেও প্রতিদানের শর্তহীন যে নিভৃত ভালোবাসা বেঁচে থাকে, শত ঝঞ্ঝার পরেও তাকে প্রাণভরে উদযাপন করবার জন্য বুকের পাটা লাগে বৈকি।
তাই বাঙালীর বাণীবন্দনা শুধু মেধা ও বুদ্ধিমত্তার ভিক্ষাপ্রার্থনা নয়, উপবাস-পুষ্পাঞ্জলি-নৈবেদ্যর আড়ম্বর নয়- পুঁথিপড়া পান্ডিত্যের সাফল্যের পরেও জীবনবোধের আদর্শ আরো একবার ঝালিয়ে নেবার উত্তরণসরণী মাত্র। দেশের শিকড় আলগা করে অচেনা প্রবাসে এসে নতুন যাপনের অবসরেও যে সন্ধানে অব্যাহতি নেই। শেখবার কোনো শুভলগ্ন নেই, বয়সও নেই। তাই পঞ্জিকানির্দেশিত তিথির নির্ঘন্ট ফেলে এসে, প্রায় একপক্ষকাল পরে, কোনো এক সাধারণ সপ্তাহান্তে আমাদের জিয়নকাঠির আয়োজন। বহুমূল্য স্বর্ণরৌপ্য নয়, কাঁসা-পেতল-ইস্পাতের নিতান্ত নগণ্য এক সম্মিলিত পরিবার, যার ঝলসে দেবার দেমাক নেই, কিন্তু আগলে রাখার মত দৃঢ় সুগভীর যূথবদ্ধতা আছে। আর আছে উত্তরাধিকার বহনের অহংকারী অঙ্গীকার।
Comments
Post a Comment