Skip to main content

বিলাসিতা

।।১।।

মাঝরাত। দোকানপাট বন্ধ। যাত্রীবাহী গাড়ীঘোড়া দূরস্থ; অতন্দ্র সেপাইয়ের মত সারারাত যেসব লরি-ট্রাক-ম্যাটাডোর পায়চারী করে, কারো দেখা নেই আজ। আশেপাশের সমস্ত বাড়ীতেই আলো নিভে গেছে ততক্ষণে। ছাপোষা মধ্যবিত্ত গৃহস্থের এ সময়ে কোনো কাজ থাকবার কথাও নয়। আমাদের বাড়ীর সামনের রাস্তায় সমস্ত ল্যাম্পপোস্ট অচল। সামনের তিনমাথার মোড় থেকে যে গলিটা সামান্য বাঁদিকে বেঁকে গেছে সেখান থেকে একটুআধটু ম্লান লো চুঁইয়ে এসেছে মাত্র। দু-একটা নেড়ী কুকুর ছড়িয়েছিটিয়ে শুয়েবসে ছে এদিকসেদিক। বাতাসে অল্প গুমোট ভাব। নিঃঝুম থমথমে পরিবেশ। 

তারপর, কেউ কিছু জানবার আগেই কাকিনী সরোবরের মত ঘন নীল-কালো আকাশ আস্তে আস্তে লালচে বেগুনী হতে থাকবে, আর অশুভ সংকেতের মত ধুলোটে আস্তরণে অস্পষ্ট হয়ে আসবে সে রঙ। চাঁদ তারা ইত্যাদি দূরসম্পর্কের আত্মীয়দের মাঝখানে দুর্ভেদ্য দেওয়াল উঠবে। মন্দ্রস্বরে মেঘ ডাকবে দরবারী গাইয়ের হরকতের মত। তাকে আড়াল করবার মত চারদিকে কোনো সভ্যজগতের শব্দ নেই। তাই একটু পরেই, পর্দানশীন সালঙ্কারা অন্তঃপুরবাসিনীর অন্ধ করে দেবার মত রূপ নিয়ে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠবে বেপরোয়া। আকাশ ভেঙে প্রলয়ঙ্করী বৃষ্টি নামবে। যাদের ঘরের জানলা বন্ধ তারা তোলপাড় করে দেওয়া বজ্রনির্ঘোষ টের পাবে না এতটুকু। গাছপালা বাড়ীঘর যে যার মত ভিজে যাবে চুপচাপ। ঝাপসা হয়ে আসবে অদূরবর্তী নির্মীয়মাণ বহুতল। রাস্তায় জল জমতে থাকবে। উঁচু দোকানের সামনের না ডুবে যা‍ওয়া সিঁড়ির সংখ্যা থেকে জলের উচ্চতা (গভীরতা সম্ভবত প্রাকৃতিক জলাশয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য) অনুমান করা যাবে। সবকিছু ঘটে চলবে নিরুপদ্রব। ব্যস্ততার চিহ্নমাত্র নেই।

কেবল আমি, নিরুপায়ভাবে একা একা জেগে সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবার মুহূর্তের অপেক্ষা করব। তবুও মোমবাতি জ্বালব - জলরঙের সরঞ্জাম খুঁজে বার করবার চেষ্টা করব, ময়লা হলদে আবছায়ায় সবকিছুই রহস্যঘন দেখাবে। নেপথ্যে মেঘমল্লারে বন্দিশ বাজতে থাকবে। একা, এবং একমাত্র।

।।২।।

নিষ্পাপ ভোর। কোনো আবহাওয়াজনিত কারণে সূর্যের পৌরুষ তেমন টের পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ সংযত মার্জিত একটা রোদ্দুর আছে। আকাশ জুড়ে জলসা ভাঙার ক্লান্তি। আগের রাতের বৃষ্টির হালকা আমেজ। 

আর কেউ ঘুম থেকে ওঠবার আগেই আমি খালি পায়ে এবড়োখেবড়ো সিঁড়ি পেরিয়ে ছাদে উঠে আসব। জলছাদ না হওয়ায় কাদামাটির রাস্তার মত সবটা নরম হয়ে থাকবে। ভেজা ধুলোবালি পায়ের তলা জাপটে ধরবে। প্লাস্টার না করা শ্যাওলা ধরে যাওয়া আলগা গাঁথনির নগ্ন ইঁটের পাঁচিল থেকে অদ্ভুত অভাবী গন্ধ বের হবে। মৃত অনাবিষ্কৃত সভ্যতার নগরপত্তনের মত অবসাদগ্রস্ত হয়ে থাকবে টিন আর টালির চালের বিস্তৃত বস্তি। বাড়ীর পেছনের ছোট্ট একফালি জমির অবহেলায় বেড়ে ওঠা ফলন্ত পেয়ারাগাছ, আর পাশের বাড়ীর সাজানো বাগানের কামিনীফুলের সুবাস মিলেমিশে যাবে। বহুদিন তালাবন্ধ পড়ে থাকা চিলেকোঠার প্রাচীন ঘ্রাণ, আর চিরকাল নাগালের বাইরে থেকে যাওয়া অনেককিছুর নিরাকার অবর্ণনীয় গন্ধে মন আর বাতাস ভারী হয়ে উঠবে। 

।।৩।।

বেলা পড়ে আসবে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে যেমন সেকালের দাপুটে রাশভারী গৃহকর্তাদের মেজাজ একটু হলেও নরম হয়ে আসত, তেমন করেই খর রোদ ভোঁতা হতে থাকবে। সাদাটে আলোয় আস্তে আস্তে সোনালী হলুদ রঙ ধরবে। [যদি শীতকাল আর ছুটির দিন হয়, ছাদে মাদুর পেতে পড়তে বসা আমার মাথার ওপর থেকে পিছন দিকে সূর্য হেলে যেতে থাকবে। দিস্তা খাতায় আমার একখণ্ড ছায়া পড়বে।] দুপুরের তীব্র রোদের মধ্যে পেশাগতভাবে সফল এবং বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের যে ঐকান্তিক নিঃসঙ্গতা থাকে, তাকে সামাল দিতেই সম্ভবত এই পরিবর্তন। [পশ্চিমের প্রতি ব্যাখ্যাতীত আকর্ষণ আমাকে কিছুটা ঘুরে বসতে বাধ্য করবে।] বিকেলের রোদের এই পরিণত আচরণে আমি আনমনা হয়ে যাব, ফিরে আসা ব্যর্থতার গ্লানিতে বিষণ্ণ লাগবে। সম্ভবত আর্দ্রতা, তাপমাত্রা ইত্যাদির এক বিশেষ সাংখ্যমানে বিকেল থেকে সন্ধে গড়ানোর ব্রহ্মমূহুর্তে অলৌকিক মায়াবী পুরনো-পোস্টকার্ডের-মত-হলদে আভায় ভরে যাবে আকাশ। অস্তগামী সূর্যের লালচে কমলার দৃপ্ত অগ্নিময়তাও আলতো কোমল দেখাবে। গরুর খুরে ওড়া ধুলোয় বিচ্ছুরিত হয়ে ব্যাকরণগত বিশুদ্ধ গোধূলি নামার উপায় শহরে নেই। তবুও, কিছু তো হবে। (এই 'কিছু'র জন্য “কনে দেখা আলো”র মত সনাতন পিতৃতান্ত্রিক উপমা পর্যন্ত মেনে নেওয়া যায়।) আমি জগৎসংসারের সবকিছু ভুলে গিয়ে বিবশ আর আচ্ছন্ন হয়ে থাকব। বাসায় ফেরা পাখি বা গৃহস্থের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যস্ততায় আমার কীই বা যায় আসে! নিজের হারিয়ে যাওয়া অতীতের নগণ্য স্মৃতি আর জাগতিক স্বপ্ন অপার্থিব আদল নিয়ে এসে আমাকে ঘিরে রাখবে, আগলে রাখবে বহুক্ষণ। 

(অথবা)

না ঘটা অতীত, আর বিমূর্ত ভবিষ্যতের সাধ্যাতীত সাফল্যের কথা ভেবে ভেবে দুপুরের বনেদী আলস্য উদযাপন করব। ঘুলঘুলি দিয়ে আলতো হাসির মত বিচক্ষণ রোদ আসবে। জানলার গ্রিলে অবিন্যস্ত পা রেখে আধশোয়া ভাতঘুমপ্রিয় বেকারত্ব প্রশ্রয় পাবে। শিল কাটানোর দমদার হাঁক বা 'দিলখুশ মটকা'র রিনরিনে ঘন্টির আওয়াজ খেয়াল হবে না। এই অবসরটুকুতে নির্জনতার থেকে বড় কোনো প্রাপ্তি হয় না। মন্থর, অনিমেষ।

বিকেল হতে না হতেই কালচে ধূসর মেঘ করতে শুরু করবে। ঈশান আর নৈঋত কোণের ফারাক বোঝা ভার। তখনো সূর্য অস্ত না যাওয়ায় খুব একটা অন্ধকার হবে না, কিন্তু, অন্যরকম হাওয়া দেবে। তার গতি, অভিমুখ, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সমস্ত প্রকৃতিই চেনাজানা কিছুর চেয়ে অন্যরকম। অতএব, অতুলনীয়। জোরে দুলতে দুলতে একতলায় রান্নাঘরের পাশের ফলবতী পেঁপেগাছ ভেঙে পড়বে কিনা, এমনকি তার ছিঁড়ে গিয়ে যাতায়াত আর যোগাযোগ ব্যবস্থায় কোনো দুর্বিপাকের সম্ভাবনা ও তার ফলাফলের ভয়াবহতা কতখানি - এসব ক্ষুদ্র তুচ্ছ দুশ্চিন্তা আমার মাথায় আসবে না। অনর্থক ভারাক্রান্ত হবার দায় আমার নেই। শুধু মনে হতে থাকবে, এবার নিশ্চয়ই সবকিছু ওলোটপালোট করে দিয়ে নতুন, একেবারে নতুন কিছু ঘটতে চলেছে।

.

আশা আছে, এখনো আশা আছে। ওই ভরসাতেই তো বাঁচা।

Comments

Popular posts from this blog

হে সই-সব,

আমিও যে কোনোকালে শিশু ছিলাম, আর প্রতিটি দিন বাঙ্ময় শিশুদিবস ছিল, তার প্রমাণ এই নিম্নোল্লিখিত 'কবিতা'গুচ্ছ।  জীবনবিমার কোম্পানি প্রতি বছর একটা করে ডাইরি দিত, কীজানি কার বারোমাস্যা লিখবার প্রেরণা। তার পাতায় পাতায় রীতিমত তারিখ দিয়ে, চার-পাঁচ লাইন জুড়ে জুড়ে ঈগলের ঠ্যাঙের মত হাতের লেখায় আমি হিজিবিজি জমিয়ে রাখতাম। আবার ভাবতুম পেন্সিলের কোম্পানির নাম কেন বেছে বেছে অপ্সরা বা নটরাজ হয়, আর খাতার কোম্পানি গুডবয়। তখন ধারণা ছিল, পৃথিবীর (একেবারে বিশ্বস্তরে না ভাবলে ঠিক সেই গুরুত্বটা অনুধাবন করা মুশকিল হয়ে যেত) স-ম-স্ত কবিতাই আট পংক্তির। ফলতঃ, সেই সাড়ে চার বছর বয়সে মৌলিক কিছু একটা লেখবার চেষ্টা করে দেখা গেল, "উঠল বাউল সকালেতে একতারাটি নিয়ে, একতারাটি পরের দিনই হায়রে, ভেঙে গিয়ে সে ভাঙা মনে কাঁদতে গেল বনের ধারে গিয়ে- " ছ'লাইনের বেশী এগোল না। এর পরে কী হওয়া উচিৎ কিছুতেই বুঝতে পারলাম না। আমার লেখা প্রথম 'কবিতা' একটি সার্থক ছোটগল্প হতে হতেও হল না।   এর পরেরটা সম্ভবত সদ্য উপেন্দ্রকিশোর পড়বার ফল। প্রথম শ্রেণীতে পড়তে বাংলা আর ইংরেজি ক্ল...

ল্যাদকথন: একটি শনিবাসরীয় চলভাষালাপ

[সময়কাল ও স্থান: অপ্রাসঙ্গিক। ল্যাদ স্থানকালাতীত।]  আমি: হ্যাঁ বলো। মা: কী করছিস? আমি এই একটু দুধচা করলাম, চিনিছাড়া। [স্লা......র্প]  (রোজ এইভাবেই কথোপকথন শুরু হয়)  আমি: এই একটু লেবুচা আর ল্যাদ খাচ্ছি। মা: অ্যাঁ! কী খাচ্ছিস? আমি: ল্যাদ, ল্যাদ।  মা: (কীরকম একটা দ্বিধান্বিত গলায়) বুঝতে পারছিনা। (ঘাড় ঘুরিয়ে বাবাকে) টিভিটা কমাও না! সারাদিন চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খবর দেখেই যাচ্ছে! তুমুন একটা নতুন খাবারের নাম বলল, ঠিক করে শুনতেই পেলাম না।  আমি: !!!!!!! মা: (এবার আমার দিকে ফিরে) হ্যাঁ বল।  আমি:  নতুন খাবার আবার কী? বললাম তো ল্যাদ।  মা: ও! আমেরিকান খাবার?  আমি: উফফ এতে আমেরিকান কোত্থেকে এল? আশ্চর্য্য! ল্যাদ জানো না? মা: (খচে গিয়ে) তোরা আজকাল কী খাস কী বলিস আমি বুঝতে পারি না। বিদেশী খাবারের নাম আমি কীকরে জানব?  আমি: বারবার বলছি এটা খাবার না। ল্যাদ। বুঝেছো? লয়ে যফলা আকার - ল্যাদ।  মা: (ভুরু কুঁচকে) মানে? আমি: ল্যাদ মানে ল্যাদ। এইটা না বোঝার কী আছে?  মা: (ভীষণ কাঁইমাই করে) ধুর আমি বুঝতে পারছি না। আমি কি অ...

খুকির প্রত্যাবর্তন, ও ধন্যবাদগাথা

সেই সময়ের কথা। যখন পাশের পাড়াকে মনে হত পৃথিবীর শেষ প্রান্ত, আর মাসিক পত্রিকার শিশুবিভাগে কাঁচাহাতের গল্প-কবিতা লিখে পাঠাবার সময় বাদামী খামের বাঁদিকে গোটা গোটা অক্ষরে লিখতাম "প্রযত্নে.. বাবার নাম"। যখন যাবতীয় সৃষ্টিশীল শিল্পচর্চার বিপরীতে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানকে মনে হত গম্ভীর প্রাণহীন ব্যাপারস্যাপার; অন্যদিকে কল্পবিজ্ঞান আর খবরের কাগজে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কথা পড়ে রুশদেশী উপকথার অজানি-দেশের-না-জানি-কী এর মত অদ্ভুত ঘোরলাগা রোমাঞ্চ হত। তালগোল পাকিয়ে যেত সব। যখন বিদেশ মানে আমার কাছে বাংলার বাইরের সমগ্র বিশ্ব - কোনোকালেই যার ধারেকাছে পৌঁছানো হবে না আমার। এইসব ছাইপাঁশ ভাবতে ভাবতে যখন শীতের নিস্তব্ধ দুপুর বা গরমের ভ্যাপসা বিকেলে স্কুলের বারান্দায়-পার্কের মাঠে এমনকি জনবহুল বাজারহাটেও কেমন করে যেন নিজের মধ্যে ভীষণভাবে একা হয়ে যেতাম। অন্তরীপের মত।  তারপর, জীবন গিয়েছে চলে একটি দশক পার। যেসব মানুষের সাথে প্রতিদিন কথাবার্তা হয়, যাদের ওপর আমার দৈনন্দিন যাপন অনেকখানি নির্ভর করে থাকে, সেইসব মুখ বদলেছে। নতুন মুখের ভিড়ে ছোট্ট...

আলোকমঞ্জীর

।১। বিনোদিনীর ঘুম ভাঙে ভোরবেলায়। ছোট্টবেলাকার অভ্যেস। গেরামে বেড়ে উঠলে যেমনটি হয়। সেই যে গো, গাঁয়ের নামটি অঞ্জনা আর নদীর নামটি খঞ্জনা। ভাদ্দরমাস পেরোল কি পেরোল না, সেখেনে ভোরের দিকে হিম পড়ে। আর সারারাত ধরে টুপটাপ ঝরে পড়ে শিউলি। তার বুকের কাছটা ভোরের সুয্যির মত টকটকে কমলা। এতো সন কেটে গেল, সেই শিরশিরে হাওয়াটুকু রয়ে গেছে অমলিন। আর আছে বালিকাবেলার কড়ি ও কোমল। বিনোদিনী, আর তার শিউলিফুল পাতানো সই, স্নেহলতা। তাদের কোঁচড় ভর্তি শিশিরভেজা ফুল। ঘাটের কাছে ছলাৎ ছল, গল্প বলে নদীর জল। এমনি সময় নাম না জানা কোনো পাখি ডেকে উঠলেই বিনোদিনীর অবুঝ  মন  উথালপাথাল করে ওঠে...  ।২। নতুন পাড়ায় আসার পর  থেকে ভাবনার একটাও বন্ধু হয়নি। উফ, এরা আবার কীনা পাড়াকে বলে সোসাইটি। ভাবনা ওদের চেয়ে ঢের বেশী ইংলিশ স্টোরিজ পড়ে, তাই বলে কি ওরকম থেমে থেমে বেঙ্গলি বলে? এমা, না না, বেঙ্গলি না, বাংলা। ওদের পাশের ফ্ল্যাটের দিদুন কেমন মিষ্টি মিষ্টি বাংলা বলে, ওর মা তো অমনি বলে না। দিদুন বলে কিনা, মা তোমার ...

আলু-থালু

মেয়েটিকে একলা দেখে প্রৌঢ়া সহযাত্রিণী শুধোলেন, তাঁদের পরিবারের সঙ্গে রাতের খাবার ভাগ করে খেতে তার কোনো আপত্তি আছে কীনা। বাড়ী থেকে বানিয়ে আনা গরম খাবার, একেবারেই সাদামাটা; তবে সঙ্গে বাচ্চা ও বয়স্ক মানুষ আছে- তারা প্যান্ট্রির হাবিজাবি খেতে পারেনা। আর স্টেশনে দাঁড়ালেই খুচরো ভাজাভুজি মুখরোচক যা বিক্রি করতে আসে তার গুণমান তো কহতব্য নয়। একা মানুষের অবশ্য রান্না করে আনা ভারী ঝক্কি।    এর আগে মেয়েটিকে নিয়ে একপ্রস্থ আলোচনা হয়েছে ট্রেনের কুপে। ঢলঢলে টিশার্ট আর অনেকগুলো পকেটওয়ালা প্যান্ট, উবুঝুঁটি, মশমশে কেডস, ঢাউস ব্যাগপত্তর, তার ওপর এই দেড়দিনের দীর্ঘ যাত্রায় সঙ্গীহীন - এমন অসৈরণ ব্যাপার তাঁদের ছেলেবেলায় দেখা যেত না। আধুনিক না ছাই! ভয়ডর নেই মনে - সংস্কারের ঘটশ্রাদ্ধ করে ছেড়েছে। আর খাবারেরও বলিহারি - কীসব বার্গার-চিপ্স-আলুভাজা হ্যানাত্যানা! এইজন্যই অমন ঘাড়েগর্দানে একাকার। মেয়েমানুষ নয় একটু ভারী চেহারা হওয়া ভালো, তা বলে এতটা! মেয়েটি হেডফোনের আড়াল থেকে গুঞ্জনের আভাস পেয়েছে, আর করুণায় হেসেছে। সনাতনী আর সেকেলের মধ্যেকার কয়েক যোজন দূরত্ব যারা দেখতে পায়নি, তাদের অভিধ...

অসংলগ্ন

জ্বরের ঘোরে সবকিছু অন্যরকম লাগে। কপাল জুড়ে কাঠকয়লার উনুন। ওমের বদলে ছ্যাঁকা। মর্গের মতো ভয়াল ঠান্ডা হাতপায়ের তালু। লক্ষণ সুবিধের নয়।  ইন্দ্রিয়ের আশেপাশে শেকল পড়ে গ্যাছে। অবসাদের চেয়েও ভারী। বা শান্তিনিকেতনী শাল। আরো ওজনদার। শাল বলতে আবার বনেদী কাঠের কথা মনে আসে। নিরক্ষীয় বর্ষাপ্রবণ অঞ্চলের আদিম মহারণ্য। ঘন, অন্ধকার। কারাগারের কুঠুরির মতো। চেনা আসবাব, দৈনন্দিন ব্যবহার্য সালভাদর দালির চিত্রকল্পের মতো, ধনুষ্টঙ্কারের যন্ত্রণার মতো গলে পড়তে থাকে এঁকেবেঁকে। সাততলার জানলার জাল দিয়ে রাতের নাগরিক আকাশ বা রাজপথ অলস আলকাতরার মতো কালো মনে হয়। ঘর গরম রাখার যন্ত্রে একঘেয়ে আওয়াজ। শ্রুতিনির্বন্ধ। ঝিঁঝির ডাকের মত আচ্ছন্ন লাগে। ঘর্মক্লান্ত গরমের দিনে পুরোনো পাখার আওয়াজে যেমন ঝিম ধরে আসতো। বেসিনে জল পড়ার শব্দ শুনে নোঙর মাস্তুল ডিঙি নৌকার কথা মনে পড়ে। ইন্দ্রনাথের কথা, হাকলবেরি ফিনের কথা, ফটিকচাঁদের কথা। অপক্ক হাতে দিনান্তের সৈকতে তাজা মাছ কেনাবেচার প্যাস্টেল ছবি আঁকার কথা।  খিদিরপুর  ডকে প্রথমবার বাণিজ্যিক জাহাজ...

বীণা ও বাণী

তথাকথিত আস্তিকতা বলতে যা বোঝায়, কোনোকালেই আমার তা ছিল না। আমাদের ঘরে সন্ধ্যেবেলার শাঁখবাতি নেই, নীলষষ্ঠীর উপোস নেই। ভাস্কর্য আর মৃৎশিল্পের নিদর্শন স্বরূপ বুদ্ধ-খৃষ্ট-নানকের মূর্তি সাজানো আছে। প্রাচীন সাহিত্যের অংশ হিসাবে ধর্মগ্রন্থ আছে। দেশবিদেশের সনাতন লোকাচারের ইতিহাস জানবার, এবং যুক্তিহীন বিশ্বাসজনিত আনুগত্যের অভ্যাসকে অতিক্রম করেও তাকে যথাসম্ভব নিরপেক্ষভাবে সম্মান করার শিক্ষাটুকু আছে। আছে হালখাতায় বাংলা বর্ষপঞ্জী সংগ্রহ। ঈদের বিরিয়ানি আর ফিরনির যুগলবন্দীতে জন্নতলাভ। চৌকাঠে আর ছাদে হেমন্তের শিরশিরে হাওয়া উপেক্ষা করে দীপাবলির মোমবাতি জ্বালানো আছে। আলো ভাগ করে নেবার আকুলতা আছে, আলোয় ফেরবার আর্তি আছে। আর আছে সরস্বতীপুজো, ঘরকুনো মুখচোরা কিশোরীর একমাত্র আপন উৎসব। সহপাঠিনীর ছোট্ট ফোকলা ভাইবোন, চাঁদা চাইতে এসে বানান বলতে গিয়ে ঘাবড়ে যাওয়া পাড়ার সমিতির ছেলেছোকরা, বা নির্বিবাদী গৃহপরিচারিকার অনভ্যস্ত উচ্চারণে শৈশবেই আমার পিতৃমাতৃদত্ত নামের দৈবী উত্তরণ ঘটেছিল। তারপর আর নিজের সারসত্য সন্ধানে বেরিয়ে পড়া ছাড়া উপায় ছিল না। সেই শুরু আজন্মের সারস্বত সাধনার। আমি চিরকাল কমপ্ল্যান আর আধগ্রাস ...

টাঙলা

বাংলা শব্দে গোলগাল একটা ব্যাপার আছে। যেমন অক্ষর, তেমনি ধ্বনি। মাত্রা টেনে বর্ণমালা গাঁথবার রীতি দেবনাগরীতেই ছিল। কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত তীক্ষ্ণতার বদলে বাংলা অক্ষরে যা আছে তা হল কোমলতা, স্নিগ্ধতা, শান্ত নিবিড় একটা ভাব। শাপলার ডাঁটা, ফলসার থোক, শালিধানের চিঁড়ে বা কুবোপাখির ডাক ভাবলে যেমনটা হয়। সংস্কৃত শব্দে যুক্তাক্ষরের ঝঙ্কারে আভিজাত্য আছে, দৃপ্ত গৌরব আছে, প্রচ্ছন্ন অহংও বুঝি আছে। বাংলায় সেই যুক্তবর্ণকে বেণীপুতুলের মত-মেটে কুঁজোর মত-কেঠো ঘোড়ার মত গড়েপিটে-ছেঁচে-ডেবে নেওয়া হয়েছে; যাতে ধার কম, স্বরের আধার বেশী। তাই ব-ম-য-ফলায় (যেমন- নিঃস্ব, পদ্ম, সখ্য ইত্যাদি) স্বতন্ত্র বর্ণের আঘাতের বদলে দ্বিত্বব্যঞ্জনে জিভকে আরাম দেবার একটা আলসে চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। আলসে অবশ্য কোঠাবাড়ির ছাদেরও হয়, যেখানে নুনহলুদ ছোপ ফুলছাপা শাড়ির পাশে আচারের বয়াম ঝিমোয়। যেমন অক্ষর, তেমনি ধ্বনি। এঁটেল মাটির মত ভিজে ভিজে, হেঁটে গেলে যাতে পদচিহ্ন পড়ে। তার ওপর দিয়ে ধুলো উড়িয়ে টগবগিয়ে ঘোড়সওয়ার যায় না, পদাতিক কাহারের কাঁধে পালকি যায় দুলকি চালে। তা বলে কি একেবারেই তেজ ন...

শেষবারের মতো

অ - নে - ক দিন পরে।    হাওড়া স্টেশনে ট্রেন ঢুকবে কিছুক্ষণের মধ্যে। সাঁতরাগাছি পেরোনোর পরেই সকলের একটু একটু করে মালপত্র নামাবার ব্যস্ততা। আমার দুটো মাত্র ছোটো ছোটো ব্যাগ , তাই মটকা মেরে পড়ে থাকব। নীচের বার্থ হলে পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাব , অন্ধকারের ঘনত্ব থেকে বুঝে নেব ট্রেন কত লেট ( ঠিকঠাক সময়ে চললে সে ট্রেন অন্তত ভারতীয় নয় ) । লোকজন সারি বেঁধে দরজার কাছে জড়ো হতে থাকবে। যাদের সঙ্গে জিনিস বেশী তাদের উৎকণ্ঠাও বেশী। দূরপাল্লার ট্রেন সাধারণত নির্দিষ্ট কিছু প্ল্যাটফর্মেই আসে , তাই প্ল্যাটফর্মের নম্বর আন্দাজ করতে পারার বাহাদুরি এখানে খাটবে না। ট্রেনের এক একটা কামরা প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে থাকবে , আ র দক্ষ অভিজ্ঞ মালবাহীরা লাফ দিয়ে উঠেই দরদাম করতে শুরু করে দেবে। দু - পাঁচ টাকা নিয়েও দর হবে   বোধহয়।  শিল্প যত সূক্ষ্ম হয় ততই তার কদর বেশী ।   আমিও এর মধ্যে চোখটোখ কচলে উঠে বসব। অত রাতে " মন্দ্রিত করিয়া তোলে জীবনের মহামন্ত্রধ্বনি"   এইসব ভেবেটেবে মন ভালো হয়ে যাবে।    সকলে যখন সমস্ত মালপত্রের সঙ্গে দলের বাদবাকিদের গুনে নিতে ব্যস্ত , ট্রেন থেকে নেমে আমি চলমা...

পাড়া

ঘর-বারান্দা, বাড়ী, পাঁচিলের চৌহদ্দি। ছোটোখাটো বস্তি। সারিসারি জবরদখল হয়ে যাওয়া সরকারী খাসজমি। রেশন, তেলেভাজা-বইখাতা-বাসন আর মনিহারির দোকান, মুদিখানা, বস্ত্রালয়, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। দুবেলা সব্জী আর মাছের অস্থায়ী বাজার। খেলার মাঠ, পার্ক, বাঁধানো রক, ক্লাবঘর। পুরসভা বা পঞ্চায়েতের ব্লকের ভেতরে একখন্ড রাজনৈতিক সংজ্ঞাহীন অঞ্চল, স্বতন্ত্র সভ্যতা। তথাকথিত আত্মীয়তার ঊর্ধ্বে, নিছক পরিচয়ের সূত্রে গড়ে ওঠা স্বাজাত্যবোধ। পাড়া। সবাই সবার খোঁজ রাখে। পথেঘাটে দোকানবাজারে নিতান্ত সাধারণ বারোমাস্যার আদানপ্রদান। ডিগ্রী পাশ বা চাকরির খবরে স্বস্তি আসে, বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে রক্ষণশীল গুঞ্জন ওঠে, সুস্থসবল সন্তানের জন্মে খুশীর হাওয়া বয়। রাতবিরেতে শ্মশানবন্ধু জোগাড় করতে কখনো বেগ পেতে হয় না। সন্ততিত্যজ্য অশীতিপর বৃদ্ধা, কিঞ্চিৎ মানসিক ভারসাম্যহীন অবিবাহিতা প্রৌঢ়া বা বহুজনের সংসারে এককোণে খুদকুঁড়োর মত পড়ে থাকা স্নায়ুরোগাক্রান্ত যুবকের পারিবারিক ইতিহাস ছাপোষা জনজীবনে দুশ্চিন্তা, সহানুভূতি আর অনিশ্চয়তাবোধের সঞ্চার করে। কেউ বাড়ী বিক্রি কর...