এক চান্দ্রমাস হয়ে এলো প্রায়। পশ্চিম গোলার্ধের জলহাওয়া, গাছপালা, ঘরবাড়ী, লোকজন সবই মোটামুটি ধাতস্থ হয়ে এসেছে। নতুন যাপন, অপরিচিত সাংস্কৃতিক ধরণধারণ। যদিও আমাদের প্রজন্মে বিশ্বায়নের দাপটে কোনো কিছুই তেমন অপ্রত্যাশিত নয় আর। মূল ফারাক এই যে এখানে সব কিছু বড় বেশী মসৃণ, স্বচ্ছন্দ, পরিমিত। অনধিকার চর্চার বদভ্যেস কারো নেই, তেমনি পাড়াসুলভ এমনকি হাউজিং কমপ্লেক্সসুলভ আত্মীয়তাও আশা করে না কেউ। সম্ভবত রন্ধনপ্রণালী, পরিবেশন আর খাদ্যাভ্যাসে এর একটা বিচিত্র প্রতিফলন খেয়াল করা যায়। একেই যুক্তরাষ্ট্রের স্বতন্ত্র খাবারদাবার বলতে আদৌ কিছু আছে কিনা তা তর্কসাপেক্ষ। তার ওপর বহু পরিচিত বিদেশী খাবারই ভারতীয়করণের পর যে আদল নিয়েছে তা নিঃসন্দেহে এখানকার চেয়ে স্বাদে ও রূপে ভিন্ন। বহুজাতিক রসনার সাথে সামঞ্জস্য রাখতে গিয়ে এখানে কোথাও, সে রেস্তোরাঁ, পিকনিক বা পার্টি যাই হোক রেঁধেবেড়ে সাজিয়েগুছিয়ে খেতে দেবার প্রথা খুব একটা নেই - সমস্ত সম্ভাব্য উপকরণ যে যার জায়গায় স্তূপীকৃত হয়ে থাকে, আন্দাজ বা পছন্দমত মিলিয়েমিশিয়ে নিলেই হল। তার না আছে ক্রমানুসার, বা পরিমাণবোধ। আগুনের সাথে রাঁধুনীর সহযোগী ভূমিকা নেই বললেই চলে, ফলে সময়ের অনুমানের পারদর্শিতাও অপ্রাসঙ্গিক। খাদ্যের মূল আস্বাদের থেকে অধিকাংশ সময়ে সঙ্গতের প্রতাপ এতো বেশি হয়ে দাঁড়ায় যে সবটাই বাহুল্য বলে মনে হয়। প্রথম বিশ্বের দেশ, প্রাচুর্য্যের লীলাভূমি।
এমতাবস্থায়, হাতের গুণের ওপর খাদ্যবস্তুর বিমূর্ত (এবং দুর্বোধ্য রহস্যময়) স্বাদনির্ভরতার স্মৃতি শস্যশ্যামলা নদীমাতৃক দেশের ভোজনরসিক জনগোষ্ঠীর বংশোদ্ভূত আমায় ওলোটপালোট করে দিলো। আমিষ-নিরামিষ, ঝাল-তেতো-টক-নোনতা-মিষ্টি এবং একই জিনিসের কালিয়া-ঝোল-ভাপা-অম্বল বা ছেঁচকি-ডালনা-ঘন্ট-চচ্চড়ি ইত্যাদি বিবিধ প্রস্তুতকরণ। ছন্নছাড়া স্বাধীনতার পরিবর্তে তেলজল মশলা আর প্রধান উপকরণ একত্রে সম্পৃক্ত হয়ে একটাই পদ, একটাই পরিবার। সকলের রুচির সাথে তাল রেখে নিয়মিত স্বাদবদল। যৌথ পরিবারের সকলে নির্দিষ্ট বিভাগীয় বিশারদ। রবিবাসরীয় জলখাবার থেকে হঠাৎ পাওয়া ছুটির দিনে ভাতঘুমের অনুঘটক ভূরিভোজ - তার বিস্তার অনেক। পার্বণে তো কথাই নেই। এখানে শিল্প আর দায়ভারের তফাৎ বুঝতে হয়। বাড়ির দালান-উঠোন জুড়ে আসনপিঁড়ি - এক পৃথিবী খাদ্যসম্ভার। রেটিংএর বাণিজ্যিক কৌশলের বহুপূর্বেই পাচককে নিঃস্বার্থ প্রতিক্রিয়া জানাবার, আর পরিবর্তে পাচক বা পরিবেশকের পক্ষ থেকে উক্ত অমৃতের কিয়দংশ আরো একবার চেখে দেখার জন্য সাধবার স্বতঃস্ফূর্ত রীতি ছিল। আছে। বহু অভাব আর অসচ্ছলতার মধ্যেও অফুরন্ত সৃষ্টিশীলতা আর আন্তরিকতা। আছে।
এরপর, আমার আর কীই বা করার ছিল। যা হবার, তাই হল। এমন কিছু দুর্ঘটনার আঁচ করেই বিপুল পরিমাণ তৈজসপত্র আর দেশীয় রান্নার সামগ্রী নিয়ে আসা। গৃহস্থালীর খুঁটিনাটিতে রীতিমত অপটু হয়েও কেবল সাহস আর মনোবল সঞ্চয় করে শাকসব্জী আর মাছমাংসের বাজার প্রায় ফাঁকা করে ফেলা। অবিশ্বাস্য রকমের দুর্দান্ত রাঁধুনী হয়েও নানা অবাঞ্ছিত সাংসারিক জটিলতায় যেসব মাতৃস্থানীয়েরা গোছানো রান্নাঘরটুকু পাননি সারাজীবন, তাঁদের এক শতাংশ না হয়েও আমার তা অনায়াসেই মিলেছে। অযোগ্য প্রাপ্তি। আমার কর্তব্য কম, সুযোগসুবিধা তুলনায় অনেক বেশী। সমালোচকের বোঝা নেই। শুধুমাত্র উদ্যোগের জন্যেই তারিফ আছে। আমার ভরসা বাড়ে। খানিক আত্মতৃপ্তি। যে আমি রান্নাবাটি খেলতে প্রবল অপছন্দ করতাম, আর কোনোকালে একটা গোটা শসা বা আলুর খোসাও ছাড়িয়েছি কিনা মনে করতে পারিনা, সেই আমি কাজ সেরে ঘরে ফিরে একা একা অবলীলায় পুঁইশাকের চচ্চড়ি, মোচার ঘন্ট, থোড়ের ছেঁচকি, এঁচোড়ের ডালনা, শুক্তো এইসব রেঁধে ফেলি।
রোজকার ডালভাতের ঝক্কি এখন তুচ্ছ মনে হয়। প্রাতরাশের সাথে সাথে ছোটখাটো মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থাও সেরে ফেলি। দিনের শেষে বেসিন জুড়ে পড়ে থাকে ইস্পাত, চীনামাটি আর প্লাস্টিকের বস্তুবাদী বাসনসংসার। গুণমানের নিগূঢ় তর্কে না গিয়েও, নিজে হাতে একেবারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোনো আহার্য্য তৈরীর মধ্যে যে অনাবিল সন্তুষ্টি আর আনন্দ আছে, তা পরের দিনকয়েক বাইরের জগতের মুখোমুখি হবার আশ্চর্য শক্তি যোগায়। অনেককিছুই তো করায়ত্ত হয় না, তবু, কিছু তো হয়। যার যতখানি সাধ্য। সাধ। শখও।
![]() |
বড়িহীন শুক্তো (উপরে ), মাঝে: এঁচোড়ের ডালনা (বাঁদিকে), মোচার ঘন্ট(ডানদিকে), নীচে: পুঁইশাকের চচ্চড়ি(বাঁদিকে ), থোড়ের ছেঁচকি(ডানদিকে) |
![]() |
ব্যঞ্জনধারক। বাসনসংসার। |
Comments
Post a Comment