Skip to main content

পেশা : এক অপদার্থের কাহিনী


ছোটো থেকেই আমি বেশ কর্মবীর। জন্মেছি যখন কিছু তো একটা করে যেতে হবে - একথাটা ভেতরে শেকড় গেড়ে বসেছিল। ওই বয়সে সমাজের জীবিকাভিত্তিক শ্রেণী ও বর্ণভেদের ধারণা তৈরী হয়না, ফলে নির্বাচনে কোনো বাঁধন ছিল না। মা'কে রসিয়ে রসিয়ে শোনাতাম সেইসব জল্পনার কথা। মায়েরা চিরকাল শিশুসন্তানের অসংলগ্ন কথাকে অতিমানবিক প্রতিভার স্ফূরণ বলে ভুল করে এসেছে। তাই দিব্যি ছিলাম।

সময়ের দৈর্ঘ্য অনুযায়ী পেশার মোটামুটি দুরকম ভাগ। কিছু স্বপ্ন থাকে নেপথ্যে, অনেকবছর ধরে বাঁচে। বাদবাকি যা হয়, ওই মরসুমি শাকসবজির মত।

একে একে বলা যাক।

পাড়ার মুড়ি-চিঁড়ের দোকান। খইবাতাসা-ছোলাবাদাম-নকুলদানা এসবের সঙ্গে একটা গোটা তাক জুড়ে থরে থরে সাজানো চানাচুর-ঝুরিভাজার বয়াম। বিবিধ রূপরসবর্ণ ও স্বাদের। ভাজাভুজি বা মশলাদার খাবারে তখন নিষেধাজ্ঞা। ফলে মায়ের কাছে কাতর ঘ্যানঘ্যান করে কোনো লাভ হত না। এদিকে রবীন্দ্রভারতী থেকে ফেরবার সময় অনেক পড়ুয়াই (আমার চেয়ে মাত্র বিশবছরের বড়!) অক্লেশে ওইসব দুর্লভ খাদ্যদ্রব্য কিনে নিয়ে যেত। অতঃপর, অসহায় আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, বড় হয়ে শুধু চানাচুর-ঝুরিভাজারই দোকান দেব (হলদিরামের নাম শুনিনি তখনও), বেশ বড় করে। এতে আমার খাবার সুরাহা কীকরে হবে, সে অবশ্য ভেবে দেখিনি।

দুর্গাপুর। পুজোর ছুটিতে মেজোমাসীর বাড়ী বেড়াতে যাবার সময় ট্রেনের জানলা দিয়ে দিগন্তবিস্তৃত ধানক্ষেত দেখে আমি মোহিত হয়ে গেলাম। এর আগে চাষের জমি দেখিনি এমনটা নয়, তবে তারা এর ব্যাপ্তির কাছে নস্যি। মাঠের পর মাঠ কাঁচা-পাকা বিভিন্ন উচ্চতার ধানগাছ, একা একা বাতাসে আয়েস করে দুলছে। পরপর বেশ কয়েকটা স্টেশন পেরিয়ে যাওয়ার পর, বলাকওয়া নেইআমার মনে হতে লাগল, কৃষক হওয়াই এ জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। ট্রাক্টর চালানো ম্লেচ্ছ চাষী নয়, বলদের ঘাড়ে জোয়াল চাপিয়ে টোকা মাথায় দিয়ে লাঙল হাতে রোদে-জলে-শীতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাজ করে চলা সনাতন চাষী, যেমনটা গল্পের বইতে থাকে। লাঙল যার, জমিতে তার অধিকার কতটা সে বোঝবার মত পরিণত হইনি তখনো।

পাশের বাড়ী। তাদের দু-তিন পুরুষের বনেদী অট্টালিকার একটা অংশের মেরামত চলছে। সারাদিন মিস্ত্রিমজুরদের হল্লা। সিমেন্ট-বালি-স্টোনচিপ্স মিশিয়ে মশলা তৈরী হচ্ছে, তার ঘড়ঘড় ওয়াজ। একতলায় রাস্তার পাশে এইসব চলছে, কিছুটা বানানো হয়ে গেলে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে তিনতলায়। সেখানে অসাধারণ দক্ষতায় পাত্র থেকে তুলে ইঁটের গাঁথনির ওপর ওই ভিজে নরম মশলা মাখিয়ে দিচ্ছে একজন। অনবরত, নিষ্ঠাভরে। ওই বিশেষ কায়দা র ওই মশলার প্রতি মার গেই দুর্বলতা ছিল, এবারে ছাদ থেকে চাক্ষুষ করে র সামলানো গেল না। রাজমিস্ত্রি হতে পারলে জীবন সার্থক হয়ে যেত। সত্যি সত্যি খেলনার বাটিতে মশলা চেয়ে এনেছিলামর কর্নির অভাবে পুরোনো ভাঙা স্কেল। ছাদে দু-চারটে ইঁট ছড়িয়েছিটিয়ে পড়েছিল। তাতেই মার হাতেখড়ি। একলব্যের মত। 

বা কোনো এক শীতের ঝলমলে দুপুর। বড়দিনের ছুটি। শৃঙ্গজয় বা সমুদ্রমন্থনের বিলাসের বদলে চৌকাঠ পেরিয়ে শিশিরবিন্দু চাক্ষুষ করার আদর্শে বড় হওয়া আমার বেড়ানো বলতে ইডেন গার্ডেন, বা তারামণ্ডল। শুধুমাত্র আমার বড়লোকি আবদার পূরণ করতে বাসের বদলে ট্যাক্সি। সময় বাঁচানোর জন্য বাবা রাজপথ এড়িয়ে অলিগলির সুলুকসন্ধান দিচ্ছে, আর অবলীলায় তা বুঝে নিচ্ছে
ট্যাক্সিচালক। সেইসময় খেলার মাঠ আর আঁকার স্কুলে নিজে নিজে চিনে যেতে পারলেই আমি একধাপ বড় হয়ে যাই। স্বভাবতই, আমারও অমন একটা হলুদ ট্যাক্সি আর তার সারথির আসনের প্রতি অযান্ত্রিক লোভ হয়েছিল। আর অনেকখানি সম্ভ্রম। সেই থেকেই নিজের মত করে পথঘাট জানতে শেখা। কেবল শারদোৎসবকালীন জিপিএসের বাইরেও যে শহরের একটা অন্তর্জাল আছে। নাগরিক যানবাহনের দিনলিপির পাশাপাশি কলকাতার রাস্তার একটুআধটু ইতিহাস পড়া হয়েছে। মুগ্ধতা বেড়েছে। কিন্তু এখনো ট্যাক্সির মিটার দেখে ভাড়া হিসাব করার অভূতপূর্ব সূত্রের রহস্যোদ্ধার হয়নি।  

এইসবের পাশাপাশি গড়ে উঠছিল স্বদেশচেতনা। জেলা-রাজ্য-রাষ্ট্র ইত্যাদির কূটনৈতিক ধারণা তখনও তৈরী হয়নি। দেশের বাইরেও যে আস্ত একটা পৃথিবী আছে, মহাবিশ্ব আছে - তাও জানা ছিল না। কিন্তু দুষ্টু শেয়াল আর অভাগিনী রাজকন্যার গল্পগাথার সঙ্গে সঙ্গেই পড়তে পেয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জীবনী। কচিমনে অবাঞ্ছিত প্রভাব না পড়ে, তেমন সরলীকৃত সংক্ষিপ্ত লেখনী। আমি উদ্বুদ্ধ হয়ে গেলাম। নিজের সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা না থাকায় নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব বলে মনে হত। ভাবতাম – আমি যদি বিপ্লবী হতাম, নেতা হতাম (তখনও রাজনীতির দলাদলি মতবিরোধ ইত্যাদির ব্যাপারে তেমন কিছু জানা ছিল না); বিদ্রোহের পরিকল্পনায় দেশভাগের নীতিতে যেসব ফাঁকফোকর চোখে পড়ছিল সেসব কিছুই ঘটত না। আমাকে বাদ দিয়েই আগেভাগে স্বাধীনতা, প্রজাতন্ত্র, ধাপে ধাপে দেশভাগ এসব সেরে ফেলায় ভীষণ রাগ আর আফশোস ছিল। আমি ছাড়া তো দেশের কথা আর কেউ ভাবে না, সুতরাং আমি না ভাবলে কি বিপদটাই না হবে - এসব গভীর চিন্তায় আবিষ্ট হয়ে থাকতাম। 

একটু বড় হতেই, যখন বোঝা গেল আমার পছন্দ মত স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনবার আশা নেইআর স্বাধীন হয়েও দেশে আহামরি কিছু ঘটে যায় নি, নতুন একটা ফিকির খুঁজে বের করা গেল। অর্থনীতি। মেহনতী সম্প্রদায় থেকে অধ্যাপক-প্রযুক্তিবিদ থেকে দেশের বড় বড় শিল্পপতি (টাটা আর বিড়লা ছাড়া তখন অন্য কারো নামই শুনিনি সম্ভবত) - এদের জীবনযাপনের মৌলিক স্তরে স্বাচ্ছন্দ্যের যে চোখে পড়বার মত তারতম্য, যার আন্দাজ অনেকটাই খবরের কাগজ আর মাসিক পত্রিকা পড়ে গড়ে ওঠা, অবিলম্বে সেই বৈষম্য ঘুচিয়ে ফেলা জরুরী। ছোটোখাটো ছক কষা চলছিল। বলা বাহুল্য, ওই আকাশকুসুম কল্পনার স্পর্ধা হয়েছিল ঘরের একদিকের দেওয়ালে তাকভর্তি অর্থনীতির বইপত্র দেখে, যার একপাতাও পড়ে দেখবার সাহস এখনো আমার হয়নি।

এর মধ্যে হঠাৎ করেই ভুঁইফোঁড়ের মত জেগে উঠল ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের শখ। বাড়ী বাড়ী ঘুরে যারা ওজনদরে পুরনো কাঁচের শিশিবোতল, ম্যাগাজিন, ভাঙাচোরা ধাতব জিনিসের টুকরোটাকরা ইত্যাদি কিনে নিয়ে যেত, তাদেরই একজন আমি বই পড়তে ভালোবাসি বলে অন্যান্য বাড়ী থেকে কেনা শারদীয়ার নবকল্লোল-সানন্দা-সুখী গৃহকোণ-আনন্দলোক এইসব ধার দিত। আমার ছুটিরদিনের খোরাক। মোমরং-প্যাস্টেল-স্কেচ-জলরং-ফ্যাব্রিক সবকিছু নিয়ে আমি কাজে লেগে গেলাম। পোশাক, পাদুকা আর অলঙ্কার। কখনোসখনো উষ্ণীষ। একের পর এক আঁকার খাতা শেষ হতে লাগল। মাঝেমধ্যে পুতুলটুতুল নিয়ে মহড়া দিতাম বটে, তবে কোনো একদিন সত্যিকারের মঞ্চ, লালকার্পেট আর চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া আলোর অলীক স্বপ্ন দেখবার অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল।

চাণক্যের দর্শ বেশীদিন টেকেনি। অর্থতন্ত্রের মত তুলনামূলক বিমূর্ত বিষয়ের চেয়ে ততদিনে দেশ ও বিশেষত রাজ্যের চিকিৎসাব্যবস্থার দুর্গতি মাকে বেশী নাড়া দিতে শুরু করেছে। এবারে র লগা খেয়াল নয়, রীতিমত কোমর বেঁধে খাতাকলম নিয়ে প্রকল্পের খসড়া বানানো শুরু হল। প্রত্যন্ত গ্রামে নতুন নতুন স্বাস্থ্যকেন্দ্র, জন সচেতনতা শিবির, হাসপাতালের পরিকাঠামোর উন্নয়ন ও বেসরকারীকরণের অপনয়ন, সংশ্লিষ্ট যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি - এইসব। এমনকি কোন খাতে কত ব্যয়, কর্মীসংখ্যা তারও সন্ন মান হিসেব করে রাখা হয়েছিল। কোনো এক জনপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হত একজন অবসরপ্রাপ্ত জেলাশাসকের সারাজীবনের রোমহর্ষক অভিজ্ঞতার কথা। যুগ্ম জেলাশাসক বড়মামা আর এই ভদ্রলোক আমাকে পরোক্ষে অনুপ্রাণিত করেছেন কিনা নিশ্চিত নই।

আর, উপরোক্ত এইসকল বিচিত্র দিবাস্বপ্নমঞ্জরীর আড়ালে, অন্তঃসলিলা সাধ ছিল লেখালিখি এবং চিত্রপরিচালনার। সে নিয়ে মূর্খ ছেলেমানুষী আর অন্ধ আত্মম্ভরিতাও ছিল বিস্তর। পঞ্চবর্ষীয়া আমি প্রথম ছড়া (কবিতা আর ছড়ার তফাৎ বুঝতাম না তখন) লেখবার পর যখন জানতে পেলাম রবিকবির কাব্যরচনার সূত্রপাত আরেকটু বেশী বয়সে, কী যে গর্ব হয়েছিল তার বর্ণনা দেবার ভাষা আমার শব্দকোষে নেই। আর তার বছর তিনেক পরে পথের পাঁচালীর চিত্ররূপ (যাত্রা, থিয়েটার আর ছায়াছবির ভেদাভেদও পরিষ্কার ছিল না) পরিপাটি করে কল্পনা করার পর সত্যজিৎ রায়ের ওপর কী বিধ্বংসী অভিমান হয়েছিল সে আর না বলাই ভালো। আমার সাংস্কৃতিক অতিসক্রিয়তায় বাপমায়ের দেওয়া নাম সার্থক করবার প্রাণান্ত চেষ্টা করছি এমন জনমতও শোনা গেছে।

এই মার ষোলো বছরের রঙীন যাপন। তারপর, प्राप्तेषु षोड़शबर्षे पुत्रमित्रवदाचरेत्” জাতীয় উত্তরণ মার হল। সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায়, সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী বাবার আইন, অর্থনীতি বা মনস্তত্ত্বে মেয়ের উচ্চশিক্ষার আশায় তোয়াক্কা না করে; চেনাপরিচিতের পরম বিস্ময়ে, অপ্রত্যাশিতভাবে আমার প্রাকৃতিক বিজ্ঞানচর্চার শুরু। প্রায় প্রস্তুতিহীন। অনাগতের মত। বিকল্প বিষয়সামগ্রী পর্যন্ত ভেবে রাখা ছিল।  

কিন্তু, পদার্থবিদ্যার প্রেমে পড়ে র সবকিছু খড়কুটোর মত ভেসে গেল।

যে সময় কেবল পেনসিলে লিখতে শিখেছি, সবার মত আমিও ছাদে উঠে চাঁদতারা দেখতে যেতাম। মাকে নিরুত্তর শুনে যেতে হত “ওই আকাশটা যে আসলে একটা ঢাকনা” বা “এই আকাশের পেছনেও আরেকটা আকাশ আছে” - এইসব ভিত্তিহীন উপলব্ধি।

বাদবাকিটা সবার জানা। 

Comments

Popular posts from this blog

হে সই-সব,

আমিও যে কোনোকালে শিশু ছিলাম, আর প্রতিটি দিন বাঙ্ময় শিশুদিবস ছিল, তার প্রমাণ এই নিম্নোল্লিখিত 'কবিতা'গুচ্ছ।  জীবনবিমার কোম্পানি প্রতি বছর একটা করে ডাইরি দিত, কীজানি কার বারোমাস্যা লিখবার প্রেরণা। তার পাতায় পাতায় রীতিমত তারিখ দিয়ে, চার-পাঁচ লাইন জুড়ে জুড়ে ঈগলের ঠ্যাঙের মত হাতের লেখায় আমি হিজিবিজি জমিয়ে রাখতাম। আবার ভাবতুম পেন্সিলের কোম্পানির নাম কেন বেছে বেছে অপ্সরা বা নটরাজ হয়, আর খাতার কোম্পানি গুডবয়। তখন ধারণা ছিল, পৃথিবীর (একেবারে বিশ্বস্তরে না ভাবলে ঠিক সেই গুরুত্বটা অনুধাবন করা মুশকিল হয়ে যেত) স-ম-স্ত কবিতাই আট পংক্তির। ফলতঃ, সেই সাড়ে চার বছর বয়সে মৌলিক কিছু একটা লেখবার চেষ্টা করে দেখা গেল, "উঠল বাউল সকালেতে একতারাটি নিয়ে, একতারাটি পরের দিনই হায়রে, ভেঙে গিয়ে সে ভাঙা মনে কাঁদতে গেল বনের ধারে গিয়ে- " ছ'লাইনের বেশী এগোল না। এর পরে কী হওয়া উচিৎ কিছুতেই বুঝতে পারলাম না। আমার লেখা প্রথম 'কবিতা' একটি সার্থক ছোটগল্প হতে হতেও হল না।   এর পরেরটা সম্ভবত সদ্য উপেন্দ্রকিশোর পড়বার ফল। প্রথম শ্রেণীতে পড়তে বাংলা আর ইংরেজি ক্ল...

ল্যাদকথন: একটি শনিবাসরীয় চলভাষালাপ

[সময়কাল ও স্থান: অপ্রাসঙ্গিক। ল্যাদ স্থানকালাতীত।]  আমি: হ্যাঁ বলো। মা: কী করছিস? আমি এই একটু দুধচা করলাম, চিনিছাড়া। [স্লা......র্প]  (রোজ এইভাবেই কথোপকথন শুরু হয়)  আমি: এই একটু লেবুচা আর ল্যাদ খাচ্ছি। মা: অ্যাঁ! কী খাচ্ছিস? আমি: ল্যাদ, ল্যাদ।  মা: (কীরকম একটা দ্বিধান্বিত গলায়) বুঝতে পারছিনা। (ঘাড় ঘুরিয়ে বাবাকে) টিভিটা কমাও না! সারাদিন চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খবর দেখেই যাচ্ছে! তুমুন একটা নতুন খাবারের নাম বলল, ঠিক করে শুনতেই পেলাম না।  আমি: !!!!!!! মা: (এবার আমার দিকে ফিরে) হ্যাঁ বল।  আমি:  নতুন খাবার আবার কী? বললাম তো ল্যাদ।  মা: ও! আমেরিকান খাবার?  আমি: উফফ এতে আমেরিকান কোত্থেকে এল? আশ্চর্য্য! ল্যাদ জানো না? মা: (খচে গিয়ে) তোরা আজকাল কী খাস কী বলিস আমি বুঝতে পারি না। বিদেশী খাবারের নাম আমি কীকরে জানব?  আমি: বারবার বলছি এটা খাবার না। ল্যাদ। বুঝেছো? লয়ে যফলা আকার - ল্যাদ।  মা: (ভুরু কুঁচকে) মানে? আমি: ল্যাদ মানে ল্যাদ। এইটা না বোঝার কী আছে?  মা: (ভীষণ কাঁইমাই করে) ধুর আমি বুঝতে পারছি না। আমি কি অ...

খুকির প্রত্যাবর্তন, ও ধন্যবাদগাথা

সেই সময়ের কথা। যখন পাশের পাড়াকে মনে হত পৃথিবীর শেষ প্রান্ত, আর মাসিক পত্রিকার শিশুবিভাগে কাঁচাহাতের গল্প-কবিতা লিখে পাঠাবার সময় বাদামী খামের বাঁদিকে গোটা গোটা অক্ষরে লিখতাম "প্রযত্নে.. বাবার নাম"। যখন যাবতীয় সৃষ্টিশীল শিল্পচর্চার বিপরীতে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানকে মনে হত গম্ভীর প্রাণহীন ব্যাপারস্যাপার; অন্যদিকে কল্পবিজ্ঞান আর খবরের কাগজে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কথা পড়ে রুশদেশী উপকথার অজানি-দেশের-না-জানি-কী এর মত অদ্ভুত ঘোরলাগা রোমাঞ্চ হত। তালগোল পাকিয়ে যেত সব। যখন বিদেশ মানে আমার কাছে বাংলার বাইরের সমগ্র বিশ্ব - কোনোকালেই যার ধারেকাছে পৌঁছানো হবে না আমার। এইসব ছাইপাঁশ ভাবতে ভাবতে যখন শীতের নিস্তব্ধ দুপুর বা গরমের ভ্যাপসা বিকেলে স্কুলের বারান্দায়-পার্কের মাঠে এমনকি জনবহুল বাজারহাটেও কেমন করে যেন নিজের মধ্যে ভীষণভাবে একা হয়ে যেতাম। অন্তরীপের মত।  তারপর, জীবন গিয়েছে চলে একটি দশক পার। যেসব মানুষের সাথে প্রতিদিন কথাবার্তা হয়, যাদের ওপর আমার দৈনন্দিন যাপন অনেকখানি নির্ভর করে থাকে, সেইসব মুখ বদলেছে। নতুন মুখের ভিড়ে ছোট্ট...

আলোকমঞ্জীর

।১। বিনোদিনীর ঘুম ভাঙে ভোরবেলায়। ছোট্টবেলাকার অভ্যেস। গেরামে বেড়ে উঠলে যেমনটি হয়। সেই যে গো, গাঁয়ের নামটি অঞ্জনা আর নদীর নামটি খঞ্জনা। ভাদ্দরমাস পেরোল কি পেরোল না, সেখেনে ভোরের দিকে হিম পড়ে। আর সারারাত ধরে টুপটাপ ঝরে পড়ে শিউলি। তার বুকের কাছটা ভোরের সুয্যির মত টকটকে কমলা। এতো সন কেটে গেল, সেই শিরশিরে হাওয়াটুকু রয়ে গেছে অমলিন। আর আছে বালিকাবেলার কড়ি ও কোমল। বিনোদিনী, আর তার শিউলিফুল পাতানো সই, স্নেহলতা। তাদের কোঁচড় ভর্তি শিশিরভেজা ফুল। ঘাটের কাছে ছলাৎ ছল, গল্প বলে নদীর জল। এমনি সময় নাম না জানা কোনো পাখি ডেকে উঠলেই বিনোদিনীর অবুঝ  মন  উথালপাথাল করে ওঠে...  ।২। নতুন পাড়ায় আসার পর  থেকে ভাবনার একটাও বন্ধু হয়নি। উফ, এরা আবার কীনা পাড়াকে বলে সোসাইটি। ভাবনা ওদের চেয়ে ঢের বেশী ইংলিশ স্টোরিজ পড়ে, তাই বলে কি ওরকম থেমে থেমে বেঙ্গলি বলে? এমা, না না, বেঙ্গলি না, বাংলা। ওদের পাশের ফ্ল্যাটের দিদুন কেমন মিষ্টি মিষ্টি বাংলা বলে, ওর মা তো অমনি বলে না। দিদুন বলে কিনা, মা তোমার ...

আলু-থালু

মেয়েটিকে একলা দেখে প্রৌঢ়া সহযাত্রিণী শুধোলেন, তাঁদের পরিবারের সঙ্গে রাতের খাবার ভাগ করে খেতে তার কোনো আপত্তি আছে কীনা। বাড়ী থেকে বানিয়ে আনা গরম খাবার, একেবারেই সাদামাটা; তবে সঙ্গে বাচ্চা ও বয়স্ক মানুষ আছে- তারা প্যান্ট্রির হাবিজাবি খেতে পারেনা। আর স্টেশনে দাঁড়ালেই খুচরো ভাজাভুজি মুখরোচক যা বিক্রি করতে আসে তার গুণমান তো কহতব্য নয়। একা মানুষের অবশ্য রান্না করে আনা ভারী ঝক্কি।    এর আগে মেয়েটিকে নিয়ে একপ্রস্থ আলোচনা হয়েছে ট্রেনের কুপে। ঢলঢলে টিশার্ট আর অনেকগুলো পকেটওয়ালা প্যান্ট, উবুঝুঁটি, মশমশে কেডস, ঢাউস ব্যাগপত্তর, তার ওপর এই দেড়দিনের দীর্ঘ যাত্রায় সঙ্গীহীন - এমন অসৈরণ ব্যাপার তাঁদের ছেলেবেলায় দেখা যেত না। আধুনিক না ছাই! ভয়ডর নেই মনে - সংস্কারের ঘটশ্রাদ্ধ করে ছেড়েছে। আর খাবারেরও বলিহারি - কীসব বার্গার-চিপ্স-আলুভাজা হ্যানাত্যানা! এইজন্যই অমন ঘাড়েগর্দানে একাকার। মেয়েমানুষ নয় একটু ভারী চেহারা হওয়া ভালো, তা বলে এতটা! মেয়েটি হেডফোনের আড়াল থেকে গুঞ্জনের আভাস পেয়েছে, আর করুণায় হেসেছে। সনাতনী আর সেকেলের মধ্যেকার কয়েক যোজন দূরত্ব যারা দেখতে পায়নি, তাদের অভিধ...

অসংলগ্ন

জ্বরের ঘোরে সবকিছু অন্যরকম লাগে। কপাল জুড়ে কাঠকয়লার উনুন। ওমের বদলে ছ্যাঁকা। মর্গের মতো ভয়াল ঠান্ডা হাতপায়ের তালু। লক্ষণ সুবিধের নয়।  ইন্দ্রিয়ের আশেপাশে শেকল পড়ে গ্যাছে। অবসাদের চেয়েও ভারী। বা শান্তিনিকেতনী শাল। আরো ওজনদার। শাল বলতে আবার বনেদী কাঠের কথা মনে আসে। নিরক্ষীয় বর্ষাপ্রবণ অঞ্চলের আদিম মহারণ্য। ঘন, অন্ধকার। কারাগারের কুঠুরির মতো। চেনা আসবাব, দৈনন্দিন ব্যবহার্য সালভাদর দালির চিত্রকল্পের মতো, ধনুষ্টঙ্কারের যন্ত্রণার মতো গলে পড়তে থাকে এঁকেবেঁকে। সাততলার জানলার জাল দিয়ে রাতের নাগরিক আকাশ বা রাজপথ অলস আলকাতরার মতো কালো মনে হয়। ঘর গরম রাখার যন্ত্রে একঘেয়ে আওয়াজ। শ্রুতিনির্বন্ধ। ঝিঁঝির ডাকের মত আচ্ছন্ন লাগে। ঘর্মক্লান্ত গরমের দিনে পুরোনো পাখার আওয়াজে যেমন ঝিম ধরে আসতো। বেসিনে জল পড়ার শব্দ শুনে নোঙর মাস্তুল ডিঙি নৌকার কথা মনে পড়ে। ইন্দ্রনাথের কথা, হাকলবেরি ফিনের কথা, ফটিকচাঁদের কথা। অপক্ক হাতে দিনান্তের সৈকতে তাজা মাছ কেনাবেচার প্যাস্টেল ছবি আঁকার কথা।  খিদিরপুর  ডকে প্রথমবার বাণিজ্যিক জাহাজ...

বীণা ও বাণী

তথাকথিত আস্তিকতা বলতে যা বোঝায়, কোনোকালেই আমার তা ছিল না। আমাদের ঘরে সন্ধ্যেবেলার শাঁখবাতি নেই, নীলষষ্ঠীর উপোস নেই। ভাস্কর্য আর মৃৎশিল্পের নিদর্শন স্বরূপ বুদ্ধ-খৃষ্ট-নানকের মূর্তি সাজানো আছে। প্রাচীন সাহিত্যের অংশ হিসাবে ধর্মগ্রন্থ আছে। দেশবিদেশের সনাতন লোকাচারের ইতিহাস জানবার, এবং যুক্তিহীন বিশ্বাসজনিত আনুগত্যের অভ্যাসকে অতিক্রম করেও তাকে যথাসম্ভব নিরপেক্ষভাবে সম্মান করার শিক্ষাটুকু আছে। আছে হালখাতায় বাংলা বর্ষপঞ্জী সংগ্রহ। ঈদের বিরিয়ানি আর ফিরনির যুগলবন্দীতে জন্নতলাভ। চৌকাঠে আর ছাদে হেমন্তের শিরশিরে হাওয়া উপেক্ষা করে দীপাবলির মোমবাতি জ্বালানো আছে। আলো ভাগ করে নেবার আকুলতা আছে, আলোয় ফেরবার আর্তি আছে। আর আছে সরস্বতীপুজো, ঘরকুনো মুখচোরা কিশোরীর একমাত্র আপন উৎসব। সহপাঠিনীর ছোট্ট ফোকলা ভাইবোন, চাঁদা চাইতে এসে বানান বলতে গিয়ে ঘাবড়ে যাওয়া পাড়ার সমিতির ছেলেছোকরা, বা নির্বিবাদী গৃহপরিচারিকার অনভ্যস্ত উচ্চারণে শৈশবেই আমার পিতৃমাতৃদত্ত নামের দৈবী উত্তরণ ঘটেছিল। তারপর আর নিজের সারসত্য সন্ধানে বেরিয়ে পড়া ছাড়া উপায় ছিল না। সেই শুরু আজন্মের সারস্বত সাধনার। আমি চিরকাল কমপ্ল্যান আর আধগ্রাস ...

টাঙলা

বাংলা শব্দে গোলগাল একটা ব্যাপার আছে। যেমন অক্ষর, তেমনি ধ্বনি। মাত্রা টেনে বর্ণমালা গাঁথবার রীতি দেবনাগরীতেই ছিল। কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত তীক্ষ্ণতার বদলে বাংলা অক্ষরে যা আছে তা হল কোমলতা, স্নিগ্ধতা, শান্ত নিবিড় একটা ভাব। শাপলার ডাঁটা, ফলসার থোক, শালিধানের চিঁড়ে বা কুবোপাখির ডাক ভাবলে যেমনটা হয়। সংস্কৃত শব্দে যুক্তাক্ষরের ঝঙ্কারে আভিজাত্য আছে, দৃপ্ত গৌরব আছে, প্রচ্ছন্ন অহংও বুঝি আছে। বাংলায় সেই যুক্তবর্ণকে বেণীপুতুলের মত-মেটে কুঁজোর মত-কেঠো ঘোড়ার মত গড়েপিটে-ছেঁচে-ডেবে নেওয়া হয়েছে; যাতে ধার কম, স্বরের আধার বেশী। তাই ব-ম-য-ফলায় (যেমন- নিঃস্ব, পদ্ম, সখ্য ইত্যাদি) স্বতন্ত্র বর্ণের আঘাতের বদলে দ্বিত্বব্যঞ্জনে জিভকে আরাম দেবার একটা আলসে চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। আলসে অবশ্য কোঠাবাড়ির ছাদেরও হয়, যেখানে নুনহলুদ ছোপ ফুলছাপা শাড়ির পাশে আচারের বয়াম ঝিমোয়। যেমন অক্ষর, তেমনি ধ্বনি। এঁটেল মাটির মত ভিজে ভিজে, হেঁটে গেলে যাতে পদচিহ্ন পড়ে। তার ওপর দিয়ে ধুলো উড়িয়ে টগবগিয়ে ঘোড়সওয়ার যায় না, পদাতিক কাহারের কাঁধে পালকি যায় দুলকি চালে। তা বলে কি একেবারেই তেজ ন...

শেষবারের মতো

অ - নে - ক দিন পরে।    হাওড়া স্টেশনে ট্রেন ঢুকবে কিছুক্ষণের মধ্যে। সাঁতরাগাছি পেরোনোর পরেই সকলের একটু একটু করে মালপত্র নামাবার ব্যস্ততা। আমার দুটো মাত্র ছোটো ছোটো ব্যাগ , তাই মটকা মেরে পড়ে থাকব। নীচের বার্থ হলে পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাব , অন্ধকারের ঘনত্ব থেকে বুঝে নেব ট্রেন কত লেট ( ঠিকঠাক সময়ে চললে সে ট্রেন অন্তত ভারতীয় নয় ) । লোকজন সারি বেঁধে দরজার কাছে জড়ো হতে থাকবে। যাদের সঙ্গে জিনিস বেশী তাদের উৎকণ্ঠাও বেশী। দূরপাল্লার ট্রেন সাধারণত নির্দিষ্ট কিছু প্ল্যাটফর্মেই আসে , তাই প্ল্যাটফর্মের নম্বর আন্দাজ করতে পারার বাহাদুরি এখানে খাটবে না। ট্রেনের এক একটা কামরা প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে থাকবে , আ র দক্ষ অভিজ্ঞ মালবাহীরা লাফ দিয়ে উঠেই দরদাম করতে শুরু করে দেবে। দু - পাঁচ টাকা নিয়েও দর হবে   বোধহয়।  শিল্প যত সূক্ষ্ম হয় ততই তার কদর বেশী ।   আমিও এর মধ্যে চোখটোখ কচলে উঠে বসব। অত রাতে " মন্দ্রিত করিয়া তোলে জীবনের মহামন্ত্রধ্বনি"   এইসব ভেবেটেবে মন ভালো হয়ে যাবে।    সকলে যখন সমস্ত মালপত্রের সঙ্গে দলের বাদবাকিদের গুনে নিতে ব্যস্ত , ট্রেন থেকে নেমে আমি চলমা...

পাড়া

ঘর-বারান্দা, বাড়ী, পাঁচিলের চৌহদ্দি। ছোটোখাটো বস্তি। সারিসারি জবরদখল হয়ে যাওয়া সরকারী খাসজমি। রেশন, তেলেভাজা-বইখাতা-বাসন আর মনিহারির দোকান, মুদিখানা, বস্ত্রালয়, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। দুবেলা সব্জী আর মাছের অস্থায়ী বাজার। খেলার মাঠ, পার্ক, বাঁধানো রক, ক্লাবঘর। পুরসভা বা পঞ্চায়েতের ব্লকের ভেতরে একখন্ড রাজনৈতিক সংজ্ঞাহীন অঞ্চল, স্বতন্ত্র সভ্যতা। তথাকথিত আত্মীয়তার ঊর্ধ্বে, নিছক পরিচয়ের সূত্রে গড়ে ওঠা স্বাজাত্যবোধ। পাড়া। সবাই সবার খোঁজ রাখে। পথেঘাটে দোকানবাজারে নিতান্ত সাধারণ বারোমাস্যার আদানপ্রদান। ডিগ্রী পাশ বা চাকরির খবরে স্বস্তি আসে, বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে রক্ষণশীল গুঞ্জন ওঠে, সুস্থসবল সন্তানের জন্মে খুশীর হাওয়া বয়। রাতবিরেতে শ্মশানবন্ধু জোগাড় করতে কখনো বেগ পেতে হয় না। সন্ততিত্যজ্য অশীতিপর বৃদ্ধা, কিঞ্চিৎ মানসিক ভারসাম্যহীন অবিবাহিতা প্রৌঢ়া বা বহুজনের সংসারে এককোণে খুদকুঁড়োর মত পড়ে থাকা স্নায়ুরোগাক্রান্ত যুবকের পারিবারিক ইতিহাস ছাপোষা জনজীবনে দুশ্চিন্তা, সহানুভূতি আর অনিশ্চয়তাবোধের সঞ্চার করে। কেউ বাড়ী বিক্রি কর...