ছোটো থেকেই আমি বেশ কর্মবীর। জন্মেছি যখন কিছু তো একটা করে যেতে হবে - একথাটা ভেতরে শেকড় গেড়ে বসেছিল। ওই বয়সে সমাজের জীবিকাভিত্তিক শ্রেণী ও বর্ণভেদের ধারণা তৈরী হয়না, ফলে নির্বাচনে কোনো বাঁধন ছিল না। মা'কে রসিয়ে রসিয়ে শোনাতাম সেইসব জল্পনার কথা। মায়েরা চিরকাল শিশুসন্তানের অসংলগ্ন কথাকে অতিমানবিক প্রতিভার স্ফূরণ বলে ভুল করে এসেছে। তাই দিব্যি ছিলাম।
সময়ের
দৈর্ঘ্য অনুযায়ী পেশার মোটামুটি
দুরকম ভাগ। কিছু স্বপ্ন থাকে
নেপথ্যে,
অনেকবছর
ধরে বাঁচে।
বাদবাকি যা হয়,
ওই
মরসুমি শাকসবজির মত।
একে
একে বলা যাক।
পাড়ার
মুড়ি-চিঁড়ের
দোকান। খইবাতাসা-ছোলাবাদাম-নকুলদানা
এসবের সঙ্গে একটা গোটা তাক
জুড়ে থরে থরে সাজানো চানাচুর-ঝুরিভাজার
বয়াম। বিবিধ রূপরসবর্ণ ও
স্বাদের। ভাজাভুজি বা মশলাদার
খাবারে তখন নিষেধাজ্ঞা। ফলে
মায়ের কাছে কাতর
ঘ্যানঘ্যান
করে কোনো লাভ হত না। এদিকে
রবীন্দ্রভারতী থেকে ফেরবার
সময় অনেক পড়ুয়াই (আমার
চেয়ে মাত্র বিশবছরের বড়!)
অক্লেশে
ওইসব দুর্লভ খাদ্যদ্রব্য
কিনে নিয়ে যেত। অতঃপর,
অসহায় আমি
সিদ্ধান্ত নিলাম,
বড়
হয়ে শুধু চানাচুর-ঝুরিভাজারই
দোকান দেব (হলদিরামের
নাম শুনিনি তখনও),
বেশ
বড় করে। এতে আমার খাবার সুরাহা
কীকরে হবে,
সে
অবশ্য ভেবে দেখিনি।
দুর্গাপুর।
পুজোর ছুটিতে মেজোমাসীর বাড়ী
বেড়াতে যাবার সময় ট্রেনের
জানলা দিয়ে দিগন্তবিস্তৃত
ধানক্ষেত দেখে আমি মোহিত
হয়ে গেলাম। এর আগে চাষের জমি
দেখিনি এমনটা নয়,
তবে
তারা এর ব্যাপ্তির কাছে নস্যি।
মাঠের পর মাঠ কাঁচা-পাকা
বিভিন্ন উচ্চতার ধানগাছ,
একা
একা বাতাসে আয়েস করে দুলছে।
পরপর বেশ কয়েকটা স্টেশন পেরিয়ে
যাওয়ার পর,
বলাকওয়া
নেই, আমার
মনে হতে লাগল,
কৃষক
হওয়াই এ জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।
ট্রাক্টর চালানো ম্লেচ্ছ
চাষী নয়,
বলদের
ঘাড়ে জোয়াল চাপিয়ে টোকা মাথায়
দিয়ে লাঙল হাতে রোদে-জলে-শীতে
মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাজ করে
চলা সনাতন চাষী,
যেমনটা
গল্পের বইতে থাকে। লাঙল যার,
জমিতে
তার অধিকার কতটা সে বোঝবার মত
পরিণত হইনি তখনো।
পাশের
বাড়ী। তাদের দু-তিন
পুরুষের বনেদী অট্টালিকার
একটা অংশের মেরামত চলছে।
সারাদিন মিস্ত্রিমজুরদের
হল্লা। সিমেন্ট-বালি-স্টোনচিপ্স
মিশিয়ে মশলা তৈরী হচ্ছে,
তার
ঘড়ঘড় আওয়াজ। একতলায় রাস্তার
পাশে এইসব চলছে,
কিছুটা
বানানো হয়ে গেলে পাঠিয়ে দেওয়া
হচ্ছে তিনতলায়। সেখানে অসাধারণ
দক্ষতায় পাত্র থেকে তুলে ইঁটের
গাঁথনির ওপর ওই ভিজে নরম মশলা
মাখিয়ে দিচ্ছে একজন। অনবরত,
নিষ্ঠাভরে।
ওই বিশেষ কায়দা আর ওই মশলার
প্রতি আমার আগেই দুর্বলতা
ছিল,
এবারে
ছাদ থেকে চাক্ষুষ করে আর
সামলানো গেল না। রাজমিস্ত্রি
হতে পারলে জীবন সার্থক হয়ে
যেত। সত্যি সত্যি খেলনার
বাটিতে মশলা চেয়ে এনেছিলাম, আর
কর্নির অভাবে পুরোনো ভাঙা
স্কেল। ছাদে দু-চারটে
ইঁট ছড়িয়েছিটিয়ে পড়েছিল।
তাতেই আমার হাতেখড়ি। একলব্যের
মত।
বা কোনো এক শীতের ঝলমলে দুপুর। বড়দিনের ছুটি। শৃঙ্গজয় বা সমুদ্রমন্থনের বিলাসের বদলে চৌকাঠ পেরিয়ে শিশিরবিন্দু চাক্ষুষ করার আদর্শে বড় হওয়া আমার বেড়ানো বলতে ইডেন গার্ডেন, বা তারামণ্ডল। শুধুমাত্র আমার বড়লোকি আবদার পূরণ করতে বাসের বদলে ট্যাক্সি। সময় বাঁচানোর জন্য বাবা রাজপথ এড়িয়ে অলিগলির সুলুকসন্ধান দিচ্ছে, আর অবলীলায় তা বুঝে নিচ্ছে ট্যাক্সিচালক। সেইসময় খেলার মাঠ আর আঁকার স্কুলে নিজে নিজে চিনে যেতে পারলেই আমি একধাপ বড় হয়ে যাই। স্বভাবতই, আমারও অমন একটা হলুদ ট্যাক্সি আর তার সারথির আসনের প্রতি অযান্ত্রিক লোভ হয়েছিল। আর অনেকখানি সম্ভ্রম। সেই থেকেই নিজের মত করে পথঘাট জানতে শেখা। কেবল শারদোৎসবকালীন জিপিএসের বাইরেও যে শহরের একটা অন্তর্জাল আছে। নাগরিক যানবাহনের দিনলিপির পাশাপাশি কলকাতার রাস্তার একটুআধটু ইতিহাস পড়া হয়েছে। মুগ্ধতা বেড়েছে। কিন্তু এখনো ট্যাক্সির মিটার দেখে ভাড়া হিসাব করার অভূতপূর্ব সূত্রের রহস্যোদ্ধার হয়নি।
বা কোনো এক শীতের ঝলমলে দুপুর। বড়দিনের ছুটি। শৃঙ্গজয় বা সমুদ্রমন্থনের বিলাসের বদলে চৌকাঠ পেরিয়ে শিশিরবিন্দু চাক্ষুষ করার আদর্শে বড় হওয়া আমার বেড়ানো বলতে ইডেন গার্ডেন, বা তারামণ্ডল। শুধুমাত্র আমার বড়লোকি আবদার পূরণ করতে বাসের বদলে ট্যাক্সি। সময় বাঁচানোর জন্য বাবা রাজপথ এড়িয়ে অলিগলির সুলুকসন্ধান দিচ্ছে, আর অবলীলায় তা বুঝে নিচ্ছে ট্যাক্সিচালক। সেইসময় খেলার মাঠ আর আঁকার স্কুলে নিজে নিজে চিনে যেতে পারলেই আমি একধাপ বড় হয়ে যাই। স্বভাবতই, আমারও অমন একটা হলুদ ট্যাক্সি আর তার সারথির আসনের প্রতি অযান্ত্রিক লোভ হয়েছিল। আর অনেকখানি সম্ভ্রম। সেই থেকেই নিজের মত করে পথঘাট জানতে শেখা। কেবল শারদোৎসবকালীন জিপিএসের বাইরেও যে শহরের একটা অন্তর্জাল আছে। নাগরিক যানবাহনের দিনলিপির পাশাপাশি কলকাতার রাস্তার একটুআধটু ইতিহাস পড়া হয়েছে। মুগ্ধতা বেড়েছে। কিন্তু এখনো ট্যাক্সির মিটার দেখে ভাড়া হিসাব করার অভূতপূর্ব সূত্রের রহস্যোদ্ধার হয়নি।
এইসবের
পাশাপাশি গড়ে উঠছিল স্বদেশচেতনা।
জেলা-রাজ্য-রাষ্ট্র ইত্যাদির কূটনৈতিক ধারণা
তখনও তৈরী হয়নি। দেশের বাইরেও
যে আস্ত একটা পৃথিবী আছে,
মহাবিশ্ব আছে -
তাও
জানা ছিল না। কিন্তু দুষ্টু
শেয়াল আর অভাগিনী রাজকন্যার
গল্পগাথার সঙ্গে সঙ্গেই পড়তে
পেয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধের
ইতিহাস,
স্বাধীনতা
সংগ্রামীদের জীবনী। কচিমনে
অবাঞ্ছিত প্রভাব না পড়ে,
তেমন
সরলীকৃত সংক্ষিপ্ত লেখনী। আমি উদ্বুদ্ধ হয়ে গেলাম।
নিজের সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা
সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা
না থাকায় নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ
ব্যক্তিত্ব বলে মনে হত। ভাবতাম – আমি যদি বিপ্লবী
হতাম,
নেতা
হতাম (তখনও
রাজনীতির দলাদলি মতবিরোধ
ইত্যাদির ব্যাপারে তেমন কিছু
জানা ছিল না);
বিদ্রোহের
পরিকল্পনায়
দেশভাগের
নীতিতে যেসব ফাঁকফোকর চোখে
পড়ছিল সেসব কিছুই ঘটত না। আমাকে বাদ দিয়েই আগেভাগে
স্বাধীনতা,
প্রজাতন্ত্র,
ধাপে
ধাপে দেশভাগ এসব সেরে ফেলায়
ভীষণ রাগ আর আফশোস ছিল। আমি
ছাড়া তো দেশের কথা আর কেউ ভাবে
না,
সুতরাং আমি না ভাবলে কি বিপদটাই না
হবে -
এসব
গভীর চিন্তায় আবিষ্ট হয়ে
থাকতাম।
একটু
বড় হতেই,
যখন
বোঝা গেল আমার পছন্দ মত
স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনবার আশা নেই, আর
স্বাধীন হয়েও দেশে আহামরি
কিছু ঘটে যায় নি,
নতুন
একটা ফিকির খুঁজে বের করা গেল।
অর্থনীতি। মেহনতী সম্প্রদায়
থেকে অধ্যাপক-প্রযুক্তিবিদ
থেকে দেশের বড় বড় শিল্পপতি
(টাটা আর বিড়লা ছাড়া তখন অন্য কারো
নামই শুনিনি সম্ভবত)
- এদের
জীবনযাপনের মৌলিক স্তরে
স্বাচ্ছন্দ্যের যে চোখে পড়বার
মত তারতম্য,
যার আন্দাজ অনেকটাই খবরের কাগজ আর মাসিক পত্রিকা পড়ে গড়ে
ওঠা,
অবিলম্বে
সেই বৈষম্য ঘুচিয়ে ফেলা জরুরী।
ছোটোখাটো ছক কষা চলছিল। বলা
বাহুল্য,
ওই আকাশকুসুম কল্পনার স্পর্ধা
হয়েছিল ঘরের একদিকের দেওয়ালে
তাকভর্তি অর্থনীতির বইপত্র
দেখে,
যার
একপাতাও পড়ে দেখবার সাহস এখনো আমার হয়নি।
এর
মধ্যে হঠাৎ করেই ভুঁইফোঁড়ের
মত জেগে উঠল ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের
শখ। বাড়ী বাড়ী ঘুরে যারা ওজনদরে
পুরনো কাঁচের শিশিবোতল,
ম্যাগাজিন,
ভাঙাচোরা
ধাতব জিনিসের টুকরোটাকরা
ইত্যাদি কিনে নিয়ে যেত,
তাদেরই
একজন আমি বই পড়তে ভালোবাসি
বলে অন্যান্য বাড়ী থেকে কেনা
শারদীয়ার নবকল্লোল-সানন্দা-সুখী
গৃহকোণ-আনন্দলোক
এইসব ধার দিত। আমার ছুটিরদিনের
খোরাক। মোমরং-প্যাস্টেল-স্কেচ-জলরং-ফ্যাব্রিক
সবকিছু নিয়ে আমি কাজে লেগে
গেলাম। পোশাক, পাদুকা আর অলঙ্কার। কখনোসখনো উষ্ণীষ।
একের পর এক আঁকার খাতা শেষ
হতে লাগল। মাঝেমধ্যে পুতুলটুতুল
নিয়ে মহড়া দিতাম বটে,
তবে
কোনো একদিন সত্যিকারের মঞ্চ,
লালকার্পেট আর চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া আলোর
অলীক স্বপ্ন দেখবার অভ্যেস
হয়ে গিয়েছিল।
চাণক্যের আদর্শ বেশীদিন টেকেনি।
অর্থতন্ত্রের মত তুলনামূলক
বিমূর্ত বিষয়ের চেয়ে ততদিনে
দেশ ও বিশেষত রাজ্যের
চিকিৎসাব্যবস্থার
দুর্গতি আমাকে বেশী নাড়া
দিতে শুরু করেছে। এবারে আর আলগা খেয়াল নয়,
রীতিমত
কোমর বেঁধে খাতাকলম নিয়ে
প্রকল্পের খসড়া বানানো শুরু
হল। প্রত্যন্ত গ্রামে নতুন
নতুন স্বাস্থ্যকেন্দ্র,
জন
সচেতনতা শিবির,
হাসপাতালের
পরিকাঠামোর উন্নয়ন ও বেসরকারীকরণের
অপনয়ন,
সংশ্লিষ্ট
যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার
উন্নতি -
এইসব।
এমনকি কোন খাতে কত ব্যয়,
কর্মীসংখ্যা
তারও আসন্ন মান হিসেব করে
রাখা হয়েছিল। কোনো এক জনপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হত একজন অবসরপ্রাপ্ত জেলাশাসকের সারাজীবনের রোমহর্ষক অভিজ্ঞতার কথা। যুগ্ম জেলাশাসক বড়মামা আর এই ভদ্রলোক আমাকে পরোক্ষে অনুপ্রাণিত করেছেন কিনা নিশ্চিত নই।
আর,
উপরোক্ত এইসকল
বিচিত্র দিবাস্বপ্নমঞ্জরীর আড়ালে,
অন্তঃসলিলা
সাধ ছিল লেখালিখি এবং
চিত্রপরিচালনার। সে নিয়ে
মূর্খ ছেলেমানুষী আর
অন্ধ আত্মম্ভরিতাও
ছিল বিস্তর। পঞ্চমবর্ষীয়া আমি প্রথম ছড়া (কবিতা আর ছড়ার তফাৎ বুঝতাম না তখন)
লেখবার
পর যখন জানতে পেলাম রবিকবির
কাব্যরচনার সূত্রপাত আরেকটু
বেশী বয়সে,
কী
যে গর্ব হয়েছিল তার বর্ণনা
দেবার ভাষা আমার শব্দকোষে
নেই। আর তার বছর তিনেক পরে
পথের পাঁচালীর চিত্ররূপ
(যাত্রা,
থিয়েটার আর ছায়াছবির ভেদাভেদও পরিষ্কার
ছিল না)
পরিপাটি
করে কল্পনা করার পর সত্যজিৎ
রায়ের ওপর কী বিধ্বংসী অভিমান হয়েছিল সে আর না বলাই ভালো। আমার সাংস্কৃতিক অতিসক্রিয়তায় বাপমায়ের দেওয়া নাম সার্থক করবার প্রাণান্ত চেষ্টা করছি এমন জনমতও শোনা গেছে।
এই আমার ষোলো বছরের রঙীন যাপন।
তারপর,
“प्राप्तेषु षोड़शबर्षे
पुत्रमित्रवदाचरेत्”
জাতীয়
উত্তরণ আমার হল। সম্পূর্ণ
স্বেচ্ছায়,
সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী বাবার আইন, অর্থনীতি বা মনস্তত্ত্বে মেয়ের উচ্চশিক্ষার আশায় তোয়াক্কা না করে; চেনাপরিচিতের
পরম বিস্ময়ে,
অপ্রত্যাশিতভাবে
আমার প্রাকৃতিক বিজ্ঞানচর্চার
শুরু। প্রায় প্রস্তুতিহীন।
অনাগতের মত। বিকল্প বিষয়সামগ্রী
পর্যন্ত ভেবে রাখা ছিল।
কিন্তু,
পদার্থবিদ্যার
প্রেমে পড়ে আর সবকিছু খড়কুটোর
মত ভেসে গেল।
যে
সময় কেবল পেনসিলে লিখতে শিখেছি, সবার মত আমিও ছাদে উঠে চাঁদতারা
দেখতে যেতাম। মাকে নিরুত্তর
শুনে যেতে হত “ওই আকাশটা যে আসলে একটা ঢাকনা” বা “এই আকাশের পেছনেও আরেকটা আকাশ আছে” -
এইসব
ভিত্তিহীন উপলব্ধি।
বাদবাকিটা
সবার জানা।
Comments
Post a Comment