Skip to main content

Posts

Showing posts from 2017

যাতায়াত-১

আমার দূরপাল্লার ট্রেনযাত্রার অভিজ্ঞতা বরাবরই বেশ ভালো। দু-একটা অবাঞ্ছিত ঘটনা যে ঘটে না তা নয়, তবে সেসব মনে না রাখাই শ্রেয় (সতর্ক থাকাটুকু ছাড়া)। সে অর্থে প্রথম পশ্চিমবাংলার বাইরে বেরনো কলেজের দ্বিতীয় বছরে। কুড়ি বছর বয়সে। একধাক্কায় পুণে, দুহাজার কিলোমিটারের বেশী দূরত্ব। পূর্ব থেকে একেবারে পশ্চিমে। প্রথম শীতাতপ কামরার আমেজ, রেল কর্তৃপক্ষের দেওয়া চারবেলার আহার্য্য - প্রায় একদিন ট্রেনেই গতিশীল বসবাস। সহপাঠীদের সঙ্গে। সাতদিনব্যাপী শিক্ষামূলক ভ্রমণ। গবেষণা প্রতিষ্ঠানে। সবকিছুই প্রথম ছিল। এমনকি হাওড়া স্টেশনের সাথে আলাপও মূলত তখন থেকেই।   উদ্যোক্তা ছিলাম মূলত আমরাই। চিঠিচাপাটির প্রত্যুত্তর ইত্যাদির ব্যাপারে অধ্যাপকদের নিয়মিত তাগাদা দেওয়া ছাড়া তেমন কিছু করতে হয়নি; যদি না চারজন মিলে দেড় লক্ষ নগদ টাকা (ত্রিশজনের মাথাপিছু পাঁচহাজার ইত্যাদি) ব্যাগে ভরে  অতিব্যস্ত জনবহুল কলেজস্ট্রীট থেকে বাসে শেয়ালদা গিয়ে, কৌতূহলী ভিড়ে ঠাসা  কাউন্টারের সামনে রুদ্ধশ্বাসে প্রতি  ছয়জনের টিকিটের  খরচ  আ লাদা করে গুনেগেঁথে, সকলে এক কামরাতেই পাবে এইসব নিশ্চিত করে, ক...

হেমন্তিকার চিঠি

শীত এসে গ্যালো। ক্রান্তীয় সমতলভূমির গৃহস্থের কাছে যা মূলত একটি ধারণামাত্র। গনগনে আগুনের আঁচ বাঁচিয়ে আলোটুকু উপভোগ করার আয়েসে যতখানি বিচক্ষণতা ও পিছুটান থাকে।   ভোরের আলো ফুটবার আগেই হাড়কাঁপানো উত্তুরে হাওয়ার শাসন তুচ্ছ করে মাতৃময়ী খেজুরগাছের কোল থেকে ছিনিয়ে আনা হবে অমৃতধারা। সুরাপ্রতিম বনেদি পানীয়। বিশালাকার লোহার কড়াইতে জ্বাল দিয়ে তার লাস্যময় তারল্যে যোগ হবে সান্দ্রতার আভিজাত্য, প্রস্তুত হবে পাটালিগুড়। যা নবান্নের ধান্যজাত চিঁড়ে-মুড়ি-খৈ এর মোয়ার এক ও অদ্বিতীয় সংযোজী উপাদান। এবং দুগ্ধজ মিষ্টান্নের সমাদৃত অলংকার। মুড়কি আর জয়নগরের ধাত্রীমাও বটে। মহানাগরিক এইসব স্বর্গসুখ থেকে অনেকাংশে  বঞ্চিত। তারা বালাপোষের আড়মোড়া মেখে  কেবল ঋতু উদযাপনের স্বার্থে চিনিদুধে সম্পৃক্ত বাজারচলতি কফির আস্বাদ নিয়ে 'শীতের সকাল' রচনা লিখতে শিখেছে।          ঝকঝকে রোদ উঠলে অবশ্য সবেতেই নিশ্চিন্তির মফস্বলী ছায়া নেমে আসে। দুপুরের আলসে রোদ্দুরে দার্জিলিং ও নাগপুরী কমলালেবুর স্বাদ এবং রূপটানে খোসার উপযোগিতা নি...

(অ)দরকারী

অভাব, অভাব আর অভাব। এখানে কচুর লতি পাওয়া যায় না, মেটে আলু পাওয়া যায় না, বিচেকলা পাওয়া যায় না, শীষপালং পাওয়া যায় না। অভাবের দেশে যা অপ্রতুল, আন্তর্জাতীয় সমারোহে তা দুষ্প্রাপ্য, বিপন্ন।  যেখানে পুকুরপাড় থেকে তুলে আনা কলমীশাকের সাহচর্যে লবণাক্ত ফেনাভাতের অমৃতসমান তৃপ্তি, বা খুচরো ভাজাভুজির সঙ্গতে ছাঁচিপেঁয়াজ আর পান্তাভাতের প্রশান্তি, নিদেনপক্ষে বাজরার ধোঁয়া ওঠা চাপাটির সাথে খেজুর কিংবা আখের গুড় - সেইসব বসুন্ধরা কোথায় ? এখানে যা সহজলভ্য, তা হলো একই সব্জীর বিবিধ প্রকার। এমনকি আলু-শসা-টমেটোর মত নিরীহ জিনিসপত্রেরও। আবার কীটনাশক বিহীন (organic) হলে তার অতিরিক্ত (ক)দর। তাদের চেহারা দেখে আলাদা করা, আর বাজারের শেষ অবধি লেবেলে সাঁটা দুর্বোধ্য নাম মনে রাখা ছোটদের পত্রিকার 'অমিল খোঁজো তফাৎ বোঝো'র চেয়ে ঢের মুশকিলের। স্বোপার্জিত অর্থ - সুতরাং দায়বদ্ধতার ঘোরপ্যাঁচ নেই - সবরকমই একবার করে ঘুরিয়েফিরিয়ে পরখ করা হল। নিজের ঘ্রাণশক্তি বা স্বাদকোরকের সংবেদনশীলতা নিয়ে আমার সংশয় নেই; তাই চেখে দেখতেই বোঝা গেল ...

অসংলগ্ন

জ্বরের ঘোরে সবকিছু অন্যরকম লাগে। কপাল জুড়ে কাঠকয়লার উনুন। ওমের বদলে ছ্যাঁকা। মর্গের মতো ভয়াল ঠান্ডা হাতপায়ের তালু। লক্ষণ সুবিধের নয়।  ইন্দ্রিয়ের আশেপাশে শেকল পড়ে গ্যাছে। অবসাদের চেয়েও ভারী। বা শান্তিনিকেতনী শাল। আরো ওজনদার। শাল বলতে আবার বনেদী কাঠের কথা মনে আসে। নিরক্ষীয় বর্ষাপ্রবণ অঞ্চলের আদিম মহারণ্য। ঘন, অন্ধকার। কারাগারের কুঠুরির মতো। চেনা আসবাব, দৈনন্দিন ব্যবহার্য সালভাদর দালির চিত্রকল্পের মতো, ধনুষ্টঙ্কারের যন্ত্রণার মতো গলে পড়তে থাকে এঁকেবেঁকে। সাততলার জানলার জাল দিয়ে রাতের নাগরিক আকাশ বা রাজপথ অলস আলকাতরার মতো কালো মনে হয়। ঘর গরম রাখার যন্ত্রে একঘেয়ে আওয়াজ। শ্রুতিনির্বন্ধ। ঝিঁঝির ডাকের মত আচ্ছন্ন লাগে। ঘর্মক্লান্ত গরমের দিনে পুরোনো পাখার আওয়াজে যেমন ঝিম ধরে আসতো। বেসিনে জল পড়ার শব্দ শুনে নোঙর মাস্তুল ডিঙি নৌকার কথা মনে পড়ে। ইন্দ্রনাথের কথা, হাকলবেরি ফিনের কথা, ফটিকচাঁদের কথা। অপক্ক হাতে দিনান্তের সৈকতে তাজা মাছ কেনাবেচার প্যাস্টেল ছবি আঁকার কথা।  খিদিরপুর  ডকে প্রথমবার বাণিজ্যিক জাহাজ...

বিলাসিতা

।।১।। মাঝরাত। দোকানপাট বন্ধ। যাত্রীবাহী গাড়ীঘোড়া দূরস্থ; অতন্দ্র সেপাইয়ের মত সারারাত যেসব লরি-ট্রাক-ম্যাটাডোর পায়চারী করে, কারো দেখা নেই আজ। আশেপাশের সমস্ত বাড়ীতেই আলো নিভে গেছে ততক্ষণে। ছাপোষা মধ্যবিত্ত গৃহস্থের এ সময়ে কোনো কাজ থাকবার কথাও নয়। আমাদের বাড়ীর সামনের রাস্তায় সমস্ত ল্যাম্পপোস্ট অচল। সামনের তিনমাথার মোড় থেকে যে গলিটা সামান্য বাঁদিকে বেঁকে গেছে সেখান থেকে একটুআধটু ম্লান  আ লো চুঁইয়ে এসেছে মাত্র। দু-একটা নেড়ী কুকুর ছড়িয়েছিটিয়ে শুয়েবসে  আ ছে এদিকসেদিক। বাতাসে অল্প গুমোট ভাব। নিঃঝুম থমথমে পরিবেশ।  তারপর, কেউ কিছু জানবার আগেই কাকিনী সরোবরের মত ঘন নীল-কালো আকাশ আস্তে আস্তে লালচে বেগুনী হতে থাকবে, আর অশুভ সংকেতের মত ধুলোটে আস্তরণে অস্পষ্ট হয়ে আসবে সে রঙ। চাঁদ তারা ইত্যাদি দূরসম্পর্কের আত্মীয়দের মাঝখানে দুর্ভেদ্য দেওয়াল উঠবে। মন্দ্রস্বরে মেঘ ডাকবে দরবারী গাইয়ের হরকতের মত। তাকে আড়াল করবার মত চারদিকে কোনো সভ্যজগতের শব্দ নেই। তাই একটু পরেই, পর্দান শী ন সালঙ্কারা অন্তঃপুরবাসিনীর অন্ধ করে দেবার মত রূপ নিয়ে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠবে বেপরোয়া। আকাশ ভেঙে প্রলয়ঙ্করী বৃষ্টি নামব...

পাড়া

ঘর-বারান্দা, বাড়ী, পাঁচিলের চৌহদ্দি। ছোটোখাটো বস্তি। সারিসারি জবরদখল হয়ে যাওয়া সরকারী খাসজমি। রেশন, তেলেভাজা-বইখাতা-বাসন আর মনিহারির দোকান, মুদিখানা, বস্ত্রালয়, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। দুবেলা সব্জী আর মাছের অস্থায়ী বাজার। খেলার মাঠ, পার্ক, বাঁধানো রক, ক্লাবঘর। পুরসভা বা পঞ্চায়েতের ব্লকের ভেতরে একখন্ড রাজনৈতিক সংজ্ঞাহীন অঞ্চল, স্বতন্ত্র সভ্যতা। তথাকথিত আত্মীয়তার ঊর্ধ্বে, নিছক পরিচয়ের সূত্রে গড়ে ওঠা স্বাজাত্যবোধ। পাড়া। সবাই সবার খোঁজ রাখে। পথেঘাটে দোকানবাজারে নিতান্ত সাধারণ বারোমাস্যার আদানপ্রদান। ডিগ্রী পাশ বা চাকরির খবরে স্বস্তি আসে, বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে রক্ষণশীল গুঞ্জন ওঠে, সুস্থসবল সন্তানের জন্মে খুশীর হাওয়া বয়। রাতবিরেতে শ্মশানবন্ধু জোগাড় করতে কখনো বেগ পেতে হয় না। সন্ততিত্যজ্য অশীতিপর বৃদ্ধা, কিঞ্চিৎ মানসিক ভারসাম্যহীন অবিবাহিতা প্রৌঢ়া বা বহুজনের সংসারে এককোণে খুদকুঁড়োর মত পড়ে থাকা স্নায়ুরোগাক্রান্ত যুবকের পারিবারিক ইতিহাস ছাপোষা জনজীবনে দুশ্চিন্তা, সহানুভূতি আর অনিশ্চয়তাবোধের সঞ্চার করে। কেউ বাড়ী বিক্রি কর...

পাক-ই-স্তান

এক চান্দ্রমাস হয়ে এলো প্রায়। পশ্চিম গোলার্ধের জলহাওয়া, গাছপালা, ঘরবাড়ী, লোকজন সবই মোটামুটি ধাতস্থ হয়ে এসেছে। নতুন যাপন, অপরিচিত সাংস্কৃতিক ধরণধারণ। যদিও আমাদের প্রজন্মে বিশ্বায়নের দাপটে কোনো কিছুই তেমন অপ্রত্যাশিত নয় আর। মূল ফারাক এই যে এখানে সব কিছু বড় বেশী মসৃণ, স্বচ্ছন্দ, পরিমিত। অনধিকার চর্চার বদভ্যেস কারো নেই, তেমনি পাড়াসুলভ এমনকি হাউজিং কমপ্লেক্সসুলভ আত্মীয়তাও আশা করে না কেউ। সম্ভবত রন্ধনপ্রণালী, পরিবেশন আর খাদ্যাভ্যাসে এর একটা বিচিত্র প্রতিফলন খেয়াল করা যায়। একেই যুক্তরাষ্ট্রের স্বতন্ত্র খাবারদাবার বলতে আদৌ কিছু আছে কিনা তা তর্কসাপেক্ষ। তার ওপর বহু পরিচিত বিদেশী খাবারই ভারতীয়করণের পর যে আদল নিয়েছে তা নিঃসন্দেহে এখানকার চেয়ে স্বাদে ও রূপে ভিন্ন। বহুজাতিক রসনার সাথে সামঞ্জস্য রাখতে গিয়ে এখানে কোথাও, সে রেস্তোরাঁ, পিকনিক বা পার্টি যাই হোক রেঁধেবেড়ে সাজিয়েগুছিয়ে খেতে দেবার প্রথা খুব একটা নেই -  সমস্ত সম্ভাব্য উপকরণ যে যার জায়গায় স্তূপীকৃত হয়ে থাকে, আন্দাজ বা পছন্দমত মিলিয়েমিশিয়ে নিলেই হল। তার না আছে ক্রমানুসার,...

পেশা : এক অপদার্থের কাহিনী

ছোটো থেকেই আমি বেশ কর্মবীর । জন্মেছি যখন কিছু তো একটা করে যেতে হবে - একথাটা ভেতরে শেকড় গেড়ে বসেছিল। ওই বয়সে সমাজের জীবিকাভিত্তিক শ্রেণী ও বর্ণভেদের ধারণা তৈরী হয়না , ফলে নির্বাচনে কোনো বাঁধন ছিল না। মা ' কে রসিয়ে রসিয়ে শোনাতাম সেইসব জল্পনার কথা। মায়েরা চিরকাল শিশুসন্তানের অসংলগ্ন কথাকে অতিমানবিক প্রতিভার স্ফূরণ বলে ভুল করে এসেছে। তাই দিব্যি ছিলাম। সময়ের দৈর্ঘ্য অনুযায়ী পেশার মোটামুটি দুরকম ভাগ। কিছু স্বপ্ন থাকে নেপথ্যে , অনেকবছর ধরে বাঁচে । বাদবাকি যা হয় , ওই মরসুমি শাকসবজির মত। একে একে বলা যাক। পাড়ার মুড়ি - চিঁড়ের দোকান। খইবাতাসা - ছোলাবাদাম - নকুলদানা এসবের সঙ্গে একটা গোটা তাক জুড়ে থরে থরে সাজানো চানাচুর - ঝুরিভাজার বয়াম। বিবিধ রূপরসবর্ণ ও স্বাদের। ভাজাভুজি বা মশলাদার খাবারে তখন নিষেধাজ্ঞা। ফলে মায়ের কাছে কাতর ঘ্যানঘ্যান করে কোনো লাভ হত না। এদিকে রবীন্দ্রভারতী থেকে ফেরবার সময় অনেক পড়ুয়াই (আ মার চেয়ে মাত্র বিশবছরের বড় !) অক্লেশে ওইসব দুর্লভ খাদ্যদ্রব্য কিনে নিয়ে যেত। অতঃপর , অসহায়  আমি সিদ্ধান্ত নিলাম , বড় হয়ে শুধু চানাচুর - ঝুরিভাজারই দোকান দেব ( হলদিরামের ...

ফেরা

সাতদিনের মেয়াদ শেষ। যে পথটুকু দিব্যি হেঁটে যাওয়া যায় , গত কয়েকদিন ব্যাঙ্ক ইত্যাদিতে অনায়াসে হেঁটে হেঁটেই যাতায়াত করেছি , আর অর্ধদশক আগেও নিজের ওজনের সমান বইপত্র পিঠে নিয়ে ইস্কুলে গিয়েছি - সেইটুকু রাস্তার জন্যেও রিকশা ভাড়া করা হয়। সঙ্গে সেই ছোটো দুটো ব্যাগ। আমি সারারাস্তা অনর্গল কথা বলে যাই। মা আর রিকশাচালক চুপচাপ শোনার ভান করে। ওই বিহারী ফুচকাওলার মাখার হাত ভালো অথচ কম দেয় - এই গলি দিয়ে কেমিস্ট্রি স্যারের বাড়ী পড়তে যেতাম - সেই জলাজমি, যেখানে বাবাদের ছাত্রাবস্থায় ( নকশাল আমলে ) জনসাধারণের মধ্যে ত্রাসসঞ্চার করতে মানুষের কাটা মাথা নিয়ে ফুটবল খেলা হত বলে শুনে এসেছি - ওইদিকে পৌলমীদিদিদের বাড়ী, যাদের রমরমা পৈতৃক ব্যবসার কারখানা অন্যায়ভাবে জবরদখল হয়ে গিয়েছিল এই রাস্তা চওড়া করবার সময় - ও -- ই গলিতে সেই সাইবার কাফে, যেখানে আমি কলেজে ভর্তির সময় থেকে স্কলারশিপের আবেদন করা পর্যন্ত নির্লজ্জের মত অসময়ে এসে এসে জ্বালাতন করেছি - এইসব। এর মধ্যেই রিকশা গন্তব্যস্থলে পৌঁছয়। পরিস্থিতির সুযোগ বুঝে রিকশাওলা খুচরো ফেরত দিতে অস্বীকার করে। বাবা প্রায় রিকশার গতিতেই হাঁটে , ফলে দু - এক মিনিটের...