Skip to main content

Posts

Showing posts from 2018

হে সই-সব,

আমিও যে কোনোকালে শিশু ছিলাম, আর প্রতিটি দিন বাঙ্ময় শিশুদিবস ছিল, তার প্রমাণ এই নিম্নোল্লিখিত 'কবিতা'গুচ্ছ।  জীবনবিমার কোম্পানি প্রতি বছর একটা করে ডাইরি দিত, কীজানি কার বারোমাস্যা লিখবার প্রেরণা। তার পাতায় পাতায় রীতিমত তারিখ দিয়ে, চার-পাঁচ লাইন জুড়ে জুড়ে ঈগলের ঠ্যাঙের মত হাতের লেখায় আমি হিজিবিজি জমিয়ে রাখতাম। আবার ভাবতুম পেন্সিলের কোম্পানির নাম কেন বেছে বেছে অপ্সরা বা নটরাজ হয়, আর খাতার কোম্পানি গুডবয়। তখন ধারণা ছিল, পৃথিবীর (একেবারে বিশ্বস্তরে না ভাবলে ঠিক সেই গুরুত্বটা অনুধাবন করা মুশকিল হয়ে যেত) স-ম-স্ত কবিতাই আট পংক্তির। ফলতঃ, সেই সাড়ে চার বছর বয়সে মৌলিক কিছু একটা লেখবার চেষ্টা করে দেখা গেল, "উঠল বাউল সকালেতে একতারাটি নিয়ে, একতারাটি পরের দিনই হায়রে, ভেঙে গিয়ে সে ভাঙা মনে কাঁদতে গেল বনের ধারে গিয়ে- " ছ'লাইনের বেশী এগোল না। এর পরে কী হওয়া উচিৎ কিছুতেই বুঝতে পারলাম না। আমার লেখা প্রথম 'কবিতা' একটি সার্থক ছোটগল্প হতে হতেও হল না।   এর পরেরটা সম্ভবত সদ্য উপেন্দ্রকিশোর পড়বার ফল। প্রথম শ্রেণীতে পড়তে বাংলা আর ইংরেজি ক্ল...

আলু-থালু

মেয়েটিকে একলা দেখে প্রৌঢ়া সহযাত্রিণী শুধোলেন, তাঁদের পরিবারের সঙ্গে রাতের খাবার ভাগ করে খেতে তার কোনো আপত্তি আছে কীনা। বাড়ী থেকে বানিয়ে আনা গরম খাবার, একেবারেই সাদামাটা; তবে সঙ্গে বাচ্চা ও বয়স্ক মানুষ আছে- তারা প্যান্ট্রির হাবিজাবি খেতে পারেনা। আর স্টেশনে দাঁড়ালেই খুচরো ভাজাভুজি মুখরোচক যা বিক্রি করতে আসে তার গুণমান তো কহতব্য নয়। একা মানুষের অবশ্য রান্না করে আনা ভারী ঝক্কি।    এর আগে মেয়েটিকে নিয়ে একপ্রস্থ আলোচনা হয়েছে ট্রেনের কুপে। ঢলঢলে টিশার্ট আর অনেকগুলো পকেটওয়ালা প্যান্ট, উবুঝুঁটি, মশমশে কেডস, ঢাউস ব্যাগপত্তর, তার ওপর এই দেড়দিনের দীর্ঘ যাত্রায় সঙ্গীহীন - এমন অসৈরণ ব্যাপার তাঁদের ছেলেবেলায় দেখা যেত না। আধুনিক না ছাই! ভয়ডর নেই মনে - সংস্কারের ঘটশ্রাদ্ধ করে ছেড়েছে। আর খাবারেরও বলিহারি - কীসব বার্গার-চিপ্স-আলুভাজা হ্যানাত্যানা! এইজন্যই অমন ঘাড়েগর্দানে একাকার। মেয়েমানুষ নয় একটু ভারী চেহারা হওয়া ভালো, তা বলে এতটা! মেয়েটি হেডফোনের আড়াল থেকে গুঞ্জনের আভাস পেয়েছে, আর করুণায় হেসেছে। সনাতনী আর সেকেলের মধ্যেকার কয়েক যোজন দূরত্ব যারা দেখতে পায়নি, তাদের অভিধ...

খুকির প্রত্যাবর্তন, ও ধন্যবাদগাথা

সেই সময়ের কথা। যখন পাশের পাড়াকে মনে হত পৃথিবীর শেষ প্রান্ত, আর মাসিক পত্রিকার শিশুবিভাগে কাঁচাহাতের গল্প-কবিতা লিখে পাঠাবার সময় বাদামী খামের বাঁদিকে গোটা গোটা অক্ষরে লিখতাম "প্রযত্নে.. বাবার নাম"। যখন যাবতীয় সৃষ্টিশীল শিল্পচর্চার বিপরীতে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানকে মনে হত গম্ভীর প্রাণহীন ব্যাপারস্যাপার; অন্যদিকে কল্পবিজ্ঞান আর খবরের কাগজে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কথা পড়ে রুশদেশী উপকথার অজানি-দেশের-না-জানি-কী এর মত অদ্ভুত ঘোরলাগা রোমাঞ্চ হত। তালগোল পাকিয়ে যেত সব। যখন বিদেশ মানে আমার কাছে বাংলার বাইরের সমগ্র বিশ্ব - কোনোকালেই যার ধারেকাছে পৌঁছানো হবে না আমার। এইসব ছাইপাঁশ ভাবতে ভাবতে যখন শীতের নিস্তব্ধ দুপুর বা গরমের ভ্যাপসা বিকেলে স্কুলের বারান্দায়-পার্কের মাঠে এমনকি জনবহুল বাজারহাটেও কেমন করে যেন নিজের মধ্যে ভীষণভাবে একা হয়ে যেতাম। অন্তরীপের মত।  তারপর, জীবন গিয়েছে চলে একটি দশক পার। যেসব মানুষের সাথে প্রতিদিন কথাবার্তা হয়, যাদের ওপর আমার দৈনন্দিন যাপন অনেকখানি নির্ভর করে থাকে, সেইসব মুখ বদলেছে। নতুন মুখের ভিড়ে ছোট্ট...

অ-লক্ষ্মীমন্ত(র)

বাল্যকালে আমি ভারী চঞ্চল ও বদবুদ্ধির অধিকারিণী ছিলেম। শান্ত নিস্তরঙ্গ জীবন ও পানাপুষ্করিণীতে আমি তেমন পার্থক্য দেখিনে। অত্যধিক প্রশ্রয়ে মালতীলতা কিংবা বনসাইতুল্য হইবার পরিবর্তে অনাদরের আগাছা ও পরিমিত যত্নের উদ্ভিজ্জ হইতেই আমার আগ্রহ বেশী। তদুপরি জন্মসূত্রে মেয়েমানুষ মাত্রেই যে গৃহলক্ষ্মীর ন্যায় অচলা অবলা মৃৎপুত্তলিকা হইবার নিমিত্ত বলিপ্রদত্ত  -  এইরূপ কুশিক্ষা কদাপি পাই নাই বলিয়া দিনে দিনে আমি এক সার্থক হনুমতীরূপে শ্রীবৃদ্ধি লাভ করিতেছিলাম। এতদকাল লৌকিক ও সামাজিক উপাচার বলিয়া যাহাসকল পালিত হইয়াছে ,  তাহার কোনোরূপ যৌক্তিক ব্যাখ্যা পাইবার পূর্বাবধি আমি নিয়মের অনুগামিনী হইতে অপারগ ছিলাম। যাহাই হউক ,  শাখামৃগের পক্ষে সাধুভাষা অবলম্বন স্বাস্থ্যহানিকর। এতে মাথা ভার হয়ে যায় ,  কিলবিল করতে থাকা দুশ্চিন্তনীয় পরিকল্পনাসমূহ কেমন গৃহপালিত লক্ষ্মীপেঁচার মত গুটিশুটি মেরে বসে। যে গল্প  ( পড়ুন :  নির্জলা সত্য ঘটনাবলী )  বলবার জন্য এই ভণিতা ,  সেটাই বরং বলে ফেলা যাক। বড়দাদার (হনুসং...

ডাল-পালা

ডাল, আমবাঙালীর জীবনের অনিবার্য অংশ। যখন নিজেকেই সময় দেবার অবসর হয় না, সেইসব অতিব্যস্ত দিন থেকে শুরু করে ছুটির মেজাজে বিশেষ কোনো উদযাপন, সর্বত্র রূপে-গন্ধে-স্বাদে ইন্দ্রিয়সুখের ডালি নিয়ে তারা হাজির। সেইসব  জড়ো করে এ অধম বুভুক্ষুর  দু-চারটি প্রলাপ।    সোনামুগডাল । বর্ষামুখর রাতে খিচুড়ির উপকরণ হিসাবে যার কদর কেবল অর্ধাঙ্গিনীর। তার আসল রূপ খোলে বিয়েবাড়ীর মধ্যাহ্নভোজে মুড়িঘন্টের ডালে। সঙ্গে জুঁইফুল ভাত। অনেকদিনের অসুস্থতার পর ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লে যেমন ঝরঝরে লাগে, তেমনি মুক্তকচ্ছ ধবল ভাত- যত্ন করে যা আঙুলে মেখে নেওয়া যায়। সন্ধ্যেবেলার চর্ব্যচোষ্যের আতিশয্যের মুখড়ায় এ একান্তই আত্মীয়তার আন্তরিক উদযাপন। অবশ্য অহিংস জনগোষ্ঠীর জন্য ফুলকপি-আলু-কড়াইশুঁটির সুযোগ্য বিকল্প থাকে। সকলের সঙ্গে পাত পেড়ে বসে খাবার যে ভরপেট আনন্দ, তা ছাড়া বোধহয় এই ডালের নবাবী স্বাদের ন্যায্য মূল্যায়ন হয় না।    নিজামতের কথা যখন উঠল, ছোলার ডালের কথা না বললেই নয়। নারকোলের ফিনফিনে টুকরো আর অর্ধচন্দ্রাকৃতি কাজুবাদামের বনেদিয়ানায় সে এক রাশভারী নৈবেদ...

বীণা ও বাণী

তথাকথিত আস্তিকতা বলতে যা বোঝায়, কোনোকালেই আমার তা ছিল না। আমাদের ঘরে সন্ধ্যেবেলার শাঁখবাতি নেই, নীলষষ্ঠীর উপোস নেই। ভাস্কর্য আর মৃৎশিল্পের নিদর্শন স্বরূপ বুদ্ধ-খৃষ্ট-নানকের মূর্তি সাজানো আছে। প্রাচীন সাহিত্যের অংশ হিসাবে ধর্মগ্রন্থ আছে। দেশবিদেশের সনাতন লোকাচারের ইতিহাস জানবার, এবং যুক্তিহীন বিশ্বাসজনিত আনুগত্যের অভ্যাসকে অতিক্রম করেও তাকে যথাসম্ভব নিরপেক্ষভাবে সম্মান করার শিক্ষাটুকু আছে। আছে হালখাতায় বাংলা বর্ষপঞ্জী সংগ্রহ। ঈদের বিরিয়ানি আর ফিরনির যুগলবন্দীতে জন্নতলাভ। চৌকাঠে আর ছাদে হেমন্তের শিরশিরে হাওয়া উপেক্ষা করে দীপাবলির মোমবাতি জ্বালানো আছে। আলো ভাগ করে নেবার আকুলতা আছে, আলোয় ফেরবার আর্তি আছে। আর আছে সরস্বতীপুজো, ঘরকুনো মুখচোরা কিশোরীর একমাত্র আপন উৎসব। সহপাঠিনীর ছোট্ট ফোকলা ভাইবোন, চাঁদা চাইতে এসে বানান বলতে গিয়ে ঘাবড়ে যাওয়া পাড়ার সমিতির ছেলেছোকরা, বা নির্বিবাদী গৃহপরিচারিকার অনভ্যস্ত উচ্চারণে শৈশবেই আমার পিতৃমাতৃদত্ত নামের দৈবী উত্তরণ ঘটেছিল। তারপর আর নিজের সারসত্য সন্ধানে বেরিয়ে পড়া ছাড়া উপায় ছিল না। সেই শুরু আজন্মের সারস্বত সাধনার। আমি চিরকাল কমপ্ল্যান আর আধগ্রাস ...

বন্দেমাতরম

আদিকাল থেকে যেসকল ধর্মচর্চা বিবর্তনের অলিগলি আর মহাসড়ক পেরিয়ে আজও বেঁচেবর্তে আছে, তার মধ্যে অন্যতম হিন্দুধর্ম। কোনো মহামান্য প্রচারকের মতবাদ ও বাণীর ঊর্ধ্বে নেহাতই দৈনন্দিন অভ্যাসে গড়ে ওঠা সনাতনী সংস্কার, যাকে পরবর্তীকালে একাধিক বিরুদ্ধ ও সংশোধিত ধর্মাধর্মের পাশাপাশি খানিক অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই 'ধর্ম' হিসাবে শনাক্ত করা হয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত মহাদেশেই নদীমাতৃক প্রাচীন সভ্যতায় পঞ্চভূতের আরাধনার রীতি ছিল। আর ছিল গুণ ও ঋপুর একনিষ্ঠ তপস্যা। একান্তই স্বাভাবিক প্রবৃত্তিজাত বিশ্বাস, তা থেকে সংগঠিত নিয়মনীতি। নিজেদের অসাধ্য যা কিছু, তা-ই অতিপ্রাকৃত, দৈব। তবু, বিমূর্ত ও অখন্ড ধারণাকে সহজবোধ্য করতে যখন ঈশ্বরের দরবারেও শ্রমবিভাজন হল, আর তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তৈরী হল সাকার সঙ্কেত, কল্পনার যাবতীয় স্পর্ধায় ভিড় করে এল মানুষ ও অন্যান্য পশুপাখির আদল। উপাসনার নামে শুরু হল গভীর আত্মবীক্ষণ। নিজের সামর্থ্যের পরিধি বিশ্লেষণের অনন্তযাত্রা। প্রজ্ঞা আর চেতনার আলো সেই উন্নয়নের পথে একমদ্বিতীয় হাতিয়ার। আশ্চর্য্যের বিষয়, প্রায় সমস্ত পিতৃতান্ত্রিক সমাজেই প্রকৃতির পাশাপাশি জ্ঞান ও শিল্পকলার প্র...